শিল্পোন্নত উন্নয়নশীল দেশগুলোর কারণেই বাংলাদেশ আজ মারাত্মকভাবে ঝুঁকিতে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি কাটানো এবং ঝুঁকি মোকাবিলায় তহবিল প্রয়োজন। কিন্তু ক্ষতিপুরণ দিতে শিল্পোন্নত দেশগুলো চুপ মেরে আছে। আমরা বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতের কক্সবাজার থেকে দাবি জানাচ্ছি, জলবায়ূ ঝুঁকি মোকাবিলায় বাংলাদেশের জন্য তহবিল চাই, চাই জলবায়ূ ক্ষতিপুরণ । ক্ষতিপুরণ পাওয়ার অধিকার রাখে বাংলাদেশ।

প্রথম আলো বন্ধুসভার ২৩ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আজ সোমবার ( ১৫ নভেম্বর) দুপুরে সৈকতের লাবনী পয়েন্টে ‘ জলবায়ু বিপযয়, সবাই মিলে করবো জয়’ এ শ্লোগানে আয়োজিত মানববন্ধন কর্মসূচিতে বক্তারা এমন দাবি তুলে ধরে বলেন, নইলে পযটন রাজধানী খ্যাত কক্সবাজারকেও বাচানো যাবেনা।

দিন ব্যাপী কর্মসূচির মধ্যে ছিল, সৈকত ভ্রমণে আসা পযটকসহ নানা শ্রেণিপেশার পাঁচ শতাধিক মানুষকে বিনামূল্যে ডায়াবেটিস পরীক্ষা ও ফিজিও থেরাপি সেবাদান, মাক্স বিতরণ, তিন কিলোমিটার সৈকত পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার পাশাপাশি সমুদ্রে নিরাপদ গোসলের বিষয়ে পযটকদের সতেচনমূল প্রচারণা চালায় বন্ধুসভার সদস্যরা।

প্রথম আলো বন্ধুসভা ও মাদকবিরোধী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘ নোঙর’ যৌথভাবে এই কর্মসূচির আয়োজন করে। মানবন্ধন কর্মসূচিতে স্বাগত বক্তব্য দেন, প্রথম আলো কক্সবাজার আঞ্চলিক অফিস প্রধান আব্দুল কুদ্দুস রানা। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য শিল্পোন্নত দেশগুলোকে দায়ী করা হয়। দূষণের সিংহভাগ দায় শিল্পোন্নত দেশগুলোর। অথচ তাদের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। বৈশ্বিক উঞ্চায়নে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের উপকূলীয়াঞ্চল তলিয়ে যেতে পারে। ঝুঁকিতে দুই কোটি শিশুর ভবিষ্যত। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে কক্সবাজার উপকূলের ১৫ লাখ মানুষ।

জলবায়ূ পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষতিকর দিক এবং কারণসমূহ তুলে ধরে মানববন্ধনে বক্তব্য দেন অনুষ্টানের প্রধান অতিথি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ( রাজস্) আমিন আল পারভেজ, বিশেষ অতিথি ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ও কক্সবাজার (উত্তর) বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ( ডিএফও) মো. আনোয়ার হোসেন সরকার।

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আমিন আল পারভেজ বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি কাটানো এবং ঝুঁকি মোকাবিলায় বাংলাদেশের তহবিল প্রয়োজন। কিন্তু এ তহবিল কিংবা ক্ষতিপুরণ শিল্পোন্নত দেশগুলোকেই দিতে হবে। আমরা বাসযোগ্য একটা পৃথিবী চাই।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, জালবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম নেপথ্য নায়ক হচ্ছে মানুষ। মানবসৃষ্ট কারণেই জালবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে, সমুদ্রে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর তাতেই বাড়ছে ঝুঁকির পরিমান। জনসচেতনতার মাধ্যমে এসব রোধ করতে হবে।

বিভাগীয় বনকর্মকর্তা মো. আনোয়ার হোসেন সরকার বলেন, জলবায়ূ ঝুঁকি মোকাবিলায় সরকার ব্যাপক বনায়ন করছে। বনাঞ্চল উজার রোধ ও পাহাড় নিধন বন্ধে নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে বনবিভাগ। জীববৈচিত্র সংরক্ষণসহ পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষায় সবাইকে আন্তরিক হতে হবে।

অনুষ্টান সঞ্চালনায় ছিলেন প্রথম আলো বন্ধুসভা কক্সবাজারের সাধারণ সম্পাদক উম্মে সাদিয়া হোসেন সিকদার। বক্তব্য দেন, বন্ধুসভা কক্সবাজার সিটি কলেজ শাখার সভাপতি মো. আবদুল্লাহ, কক্সবাজার সরকারি কলেজ শাখার সভাপতি মোরাদ মুক্তাদির ত্বোহা প্রমুখ।

সমাবেশে জলবায়ূর ক্ষতিকর দিক মোকাবিলায় ১১ দফা দাবি তুলে ধরেন প্রধম আলো বন্ধুসভার উপদেষ্টা ও নোঙর-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা দিদরুল আলম রাশেদ। দাবিসমূহ হচ্ছে ঃ

১. উন্নয়নশীল দেশগুলোর কারণে বাংলাদেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। আজকের এই সমাবেশ থেকে আমরা জলবায়ূ পরিবর্তন জনিত ক্ষতিপুরণ দাবি করছি। ক্ষতিপুরণ পাওয়াটা আমাদের অধিকার।

২. জলবায়ূ মোকাবিলায় বনায়নের পাশাপাশি দরকার বনাঞ্চলের গাছ কাটা বন্ধ করা। পাহাড় কাটা বন্ধ করা, সৈকতে জীববৈচিত্র সংরক্ষণ, যানবাহনে কালো ধোঁয়া বন্ধকরণ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি সহজলভ্যকরণ এবং উপকূল রক্ষার ব্যাপক ম্যানগ্রোভ সৃজন করতে হবে ।

৩. কক্সবাজারের পাহাড় দখল করে তৈরি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ, বনাঞ্চলের তিন কিলোমিটারের ভেতরে তৈরি ইটভাটা উচ্ছেদ চাই ।

৪. সমুদ্রসৈকত ভ্রমণে আসা পযটকদের নিরাপদ গোসলের জন্য নেটিং সিস্টেমের মাধ্যমে ‘সুইমিং জোন’ প্রতিষ্টা করা।

৫. সমুদ্রে বিষাক্ত বৈর্জ্য নিক্ষেপ বন্ধ এবং সৈকতে বালুচরে লাল কাঁকড়াসহ জীববৈচিত্র সংরক্ষণে বিচ-বাইক ও দ্রুতগতির জলযান চলাচল সীমিতকরণ করতে হবে। সংরক্ষিত সৈকত এলাকায় বিচ বাইক চলাচল বন্ধ করতে হবে।

৬. বাঁকখালী নদীর অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ এবং বর্জ্য নিক্ষেপ বন্ধ করতে হবে।

৭. মাদক নির্মুলে যৌথবাহিনীর সাড়াশি অভিযান পরিচালনা করতে হবে। ইদানিং ইয়াবার বড়বড় চালান ধরা পড়ছে। ইয়াবার সঙ্গে আইসের চোরাচালানও বাড়ছে। মাদকাসক্তের হারও বাড়ছে দ্রুতগতিতে।

৮. মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের পুর্নবাসন ও সুস্থজীবনে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে।

৯. উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪ আশ্রয়শিবিরে ১১ লাখ রোহিঙ্গার বসতি। রোহিঙ্গারা ক্যাম্প থেকে পালিয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে। মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানসহ নানা অপরাধকর্মে জাড়িয়ে পড়েছে। কেউ কেউ সন্ত্রাসী ও জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে, যা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি স্বরুপ। তাই ক্যাম্প ছেড়ে কোনো রোহিঙ্গা যেন বাইরে যেতে না পারে, তার জন্য কাটাতারের বেড়ার সাথে সিসিটিভি ক্যামরা স্থাপন জরুরি।

১০. চাহিদার অতিরিক্ত ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে কক্সবাজার শহরের চার ভাগের তিনভাগ নলকুলের পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। বেশ কিছু এলাকার নলকুপে লবনাক্ত পানি উঠছে । ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে লবণাক্ত পানিকে শোধনের মাধ্যমে খাওয়ার উপযোগি করার ট্রিটম্যান্ট প্ল্যান্ট স্থাপন জরুরি। পাশাপাশি প্রাকৃতিক পানির ধরে রাখার জন্য একাধিক স্থানে জলাধার তৈরি করতে হবে।

১১. পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতি হয়-এমন কাজ থেকে দূরে থাকতে লোকজনকে সচেতন করতে হবে। এ জন্য দরকার তৃণমূল পযায়ে বাস্তবমুখি কর্মসূচি প্রণয়ন করতে হবে ।

মানববন্ধন শেষে লাবনী পয়েন্টে থেকে সুগন্ধ পয়েন্ট পযন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার সৈকত পরিস্কার-পরিচ্ছনতা করে বন্ধুসভার শতাধিক সদস্য। এসময় ভ্রমণে আসা পযটকদের নিরাপদ গোসলের নিয়ম কানুন জানানো, অরক্ষিত এবং ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে গোসলে নামতে নিষেধ এবং ভাটার সময় সমুদ্রে গোসলে নামতে সতর্কতা, সচেতন করা হয়। পাশাপাশি করোনা ঝুঁকির কথা মাথায় রেখে মুখে মাক্স পড়ার তাগিদও দেওয়া হয়। এসময় বন্ধুসভার সদস্যরা কয়েকশ পযটকের মধ্যে মাক্স বিতরণ করেন।

সুগন্ধ পয়েন্টে সকাল ৯টা থেকে শুরু হয় বিনামুল্যে ডায়াবেটিস পরীক্ষা ও ফিজিও থেরাপি সেবা দান কর্মসূচি। বিকাল পাঁচটা পযন্ত ভ্রমণে আসা পযটকসহ অন্তত পাঁচশ জন নানা শ্রেণিপেশার মানুষ এসব সেবা নেন। প্রথম আলো বন্ধুসভা ও নোঙর যৌথভাবে এর আয়োজন করে।

রাজশাহী থেকে ভ্রমণে আসা ব্যবসায়ী সাদেকুর রহমান (৪৫) বলেন, জীবনের প্রথম তিনি সৈকতের এই কেন্দ্রে এসে ডায়াবেটিস পরীক্ষা করেন এবং তাঁর ডায়াবেটিস শনাক্ত হয়েছে। অথচ তিনি জানতেন না-তিনি ডায়াবেটিস রোগী।

ডায়াবেটিস পরীক্ষার পর অবাক হন ভিক্ষুক রশিদা আক্তার (৪৮)। তাঁর অতি নিম্ন রক্তচাপ। রশিদা আক্তার বললেন, টাকার জন্য এত দিন পরীক্ষা করতে পারিনি, আজ প্রথম আলোর সেবা ক্যাম্পে ডায়াবেটিস পরীক্ষা করে জীবনের ঝুঁকির কথা জেনে নিলাম।

একই কথা বলেন, ভ্যানচালক নাছির উদ্দিন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি উচ্চ রক্ত চাপে ভুগলেও এতদিন তিনি জানতেন না, তিনি ডায়াবেটিস রোগী ।

পাশের আরেকটি কক্ষে ফিজিও থেরাপি সেবা নিচ্ছেন পযটকসহ নানা পেশার মানুষ। ফিজিও থেরাপিষ্ট শাহিনুর খন্দকার বৃষ্টি বলেন, দুপুর ১২টা পযন্ত তিনি ১৪ জনকে সেবা দিয়েছেন। বেশীর ভাগের হাত, ঘাড়, হাটু ও কোমড়ের ব্যথা। কয়েক জন এসেছেন প্যারালাইসি রোগী।

রাজধানীর উত্তর থেকে আসা পযটক ওসমান গণী ফিজিও থেরাপি সেবা নিয়ে বলেন, প্রথম আলো শুধু একটি দৈনিক পত্রিকা না, সমাজের নানা পেশার মানুষের জীবন-মানের উন্নয়নেও অনেক কিছু করছে। শিক্ষার্থীদের মেধার বিকাশ এবং তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যত গড়তে নানা কিছু করে চলেছে এই দৈনিকটি । আর এজন্যই প্রথম আলো বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণমাধ্যম হতে পেরেছে।

-প্রেস বিজ্ঞপ্তি