লাবলু আনসার, বিডি প্রতিদিন, যুক্তরাষ্ট্র:
দীর্ঘ ৩০ বছর ধরেই শুধু গলাবাজি হয়েছে। অভিবাসনের ভঙ্গুর অবস্থা ঢেলে সাজাতে কেউই আন্তরিক অর্থে উদ্যোগ নেননি। এখন হচ্ছে তাকে ফিক্স করার। ১১ মিলিয়ন নথিপত্রহীন কঠোর পরিশ্রমী অভিবাসীর জন্যে সঠিক দিক-নির্দেশনার সময় এটি। বিশেষ করে যারা শিশুকালে মা-বাবার হাত ধরে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছে এবং এই দেশের আলো-বাতাসে বেড়ে উঠেছে, যারা যুক্তরাষ্ট্রকেই নিজের দেশ হিসেবে গ্রহণ করেছে, সেই ড্রিমারদের সিটিজেনশিপ প্রদানে কালক্ষেপণের অবকাশ নেই। একইভাবে কৃষি শ্রমিক এবং নানা দুর্যোগে সর্বস্ব হারা অথবা দাঙ্গা-হাঙ্গামার কারণে বসতি ছাড়া মানুষদের জন্যে অবশ্যই কিছু একটা করতে হবে। এমন আহবান উচ্চারিত হলো প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের যৌথ অধিবেশনে ভাষণের সময়।

২৮ এপ্রিল বুধবার রাত ৯টা ৬ মিনিটে শুরু এ ভাষণ শেষ হয় ১০টা ১১ মিনিটে অর্থাৎ দীর্ঘ এক ঘণ্টা ৫ মিনিটের ভাষণে করোনায় লন্ডভন্ড যুক্তরাষ্ট্র তথা গোটাবিশ্বকে দিপ্ত প্রত্যয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর রোডম্যাপ উপস্থাপিত হয়েছে। বাইডেন বলেছেন, চলতি শতাব্দির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সবকিছু ঢেলে সাজাতে হবে। শুধু হাই স্কুল পর্যন্ত বিনা বেতনে লেখা-পড়ার সুযোগে প্রত্যাশিত সুফল আসছে না। পাবলিক কলেজ অথবা কমিউনিটি কলেজে ব্যাচেলর ডিগ্রি পর্যন্ত ফ্রি শিক্ষা কার্যক্রম চালু করতে হবে। এটি সময়ের দাবি।

বাইডেন বলেছেন, করোনায় বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড়াতে বহুমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন তথা ভবন নির্মান, সগক-মহাসড়ক-সেতু নির্মাণ, পুননির্মাণ করতে হবে। প্রবীন স্বজনের সেবা নিকটাত্মীয়রা যাতে করতে পারেন সে ববস্থাকে স্থায়ী করতে হবে। বিরাটসংখ্যক পরিবারের শিশুরা অপুষ্টিতে বেড়ে উঠছে। দারিদ্রতার কষাঘাত থেকে তাদেরকে রক্ষা করতে হবে। এজন্যে চাইল্ড এ্যান্ড ফ্যামিলি সাপোর্ট পরিকল্পনা উপস্থাপন করা হয়েছে। ধনীর চেয়েও ধনীদের ট্যাক্সেও পরিমাণ বাড়িয়ে গরিবের চেয়ে গরিবদের সার্বিক কল্যাণের প্রকল্প বাস্তবায়িত করতে হবে।
বাইডেনের দীর্ঘ এ বক্তব্যে আমেরিকানদের ঐক্যের সুদীর্ঘ ঐতিহ্যেরও ধারাবিবরণী ছিল।
তিনি বলেছেন, আমেরিকানরা যখনই ঐক্যবদ্ধ হয়েছে তখোন কোনকিছুই অসাধ্য থাকেনি। অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার এ অভিযাত্রায়ও আমেরিকার বিজয় ঘটবে। যেমনটি ঘটছে করোনাকে পর্যুদস্ত করার চলমান কার্যক্রম।

বাইডেন উল্লেখ করেন, ক্ষমতা গ্রহণের ১০০ দিনের মধ্যে ১০০ মিলিয়ন টিকা প্রদানের লক্ষ্য ধার্য করেছিলাম। সেটি পূর্ণ হয়েছে, এবং দ্বিগুনেরও বেশী টিকা প্রদান করা সম্ভব হয়েছে। বাইডেন বলেন, ১০০ মিলিয়নের স্থলে ২২০ মিলিয়ন টিকা প্রদান করা হয়েছে আজ পর্যন্ত। ১০০ দিনে ১৩ লাখ আমেরিকানের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আমেরিকা আবারো ঘুরে দাঁড়িয়েছে এবং অদম্য গতিতে সম্মুখে এগিয়ে চলছে।

বিশ্বনেতাদের সাথে সাম্প্রতিক ভার্চয়াল মিটিংয়ের প্রসঙ্গ টেনে বাইডেন বলেন, আন্তর্জাতিক নেতৃত্বে ফেরা যুক্তরাষ্ট্র কতদিন টিকে থাকবে-এমন সংশয় প্রকাশিত হয়েছে অনেকের মধ্যে। তাদের উদ্দেশ্যে বাইডেন বলেন, আমেরিকা ফিরেছে স্থায়ীভাবে নেতৃত্বে থাকতে। এ নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবকাশ নেই। বাইডেন বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায়ও যুক্তরাষ্ট্রে যথাযথ ভূমিকা অব্যাহত থাকবে।

নারী ক্ষমতায়ণের বর্ণাঢ্য অভিযাত্রা এবং বর্ণ-বিদ্বেষমূলক মনোভাবের পরিসমাপ্তির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা ঘটলো বাইডেনের বক্তব্যের মধ্যদিয়ে। কংগ্রেসের যৌথ-অধিবেশনে প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেনের প্রথম এই বক্তব্যের সময় উদ্ভাসিত হলো মাস্ক পরিহিত দুই নারী নিকটেই মঞ্চে বসা। একজন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস, আরেকজন স্পিকার ন্যান্সি পেলসি। কমলা বসেন ইউএস সিনেটের প্রেসিডেন্ট হিসেবে। আর পেলসি হচ্ছেন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার। উভয়েই ডেমক্র্যাট। এটি যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম ঘটনা। অপরদিকে, ৪৭ বছরের রাজনৈতিক জীবনে জো বাইডেনেরও এটি প্রথম ঘটনা। এর আগে বারাক ওবামার ৮ বছরের প্রেসিডেন্সির সময়ে তিনি মঞ্চে বসেছেন ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে। তারও আগে অর্থাৎ প্রায় ৩৬ বছর তিনি সিনেট সদস্য হিসেবে বরাবরই সাথী সিনেটরদের সাথে অধিবেশনে বসেছেন। প্রেসিডেন্ট রনাল্ড রিগ্যানের আমলে অন্তত: দু’বার যৌথ অধিবেশনে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টের প্রদত্ত ভাষণের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন ডেমক্র্যাট হিসেবে। এমন ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রে আর কোন রাজনীতিকের জীবনে এখন পর্যন্ত ঘটেনি।

এসব কারণে এবারের বক্তব্যেও অকপট সত্য উচ্চারিত হলো বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন। বেশ কদিন থেকেই বক্তব্য কী দেবেন তা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সাথে শলাপরামর্শ করছেন বাইডেন। স্ক্রিপ্ত তৈরী করেছেন। তা পরখ করছেন। সংযোজন-বিয়োজন করছেন নিজেই। তবে ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম ৯৯দিনের কৃতিত্ব/সাফল্য উপস্থাপনের সময় বাইডেনের মধ্যে এক ধরনের প্রত্যয় দেখা গেছে। অর্থাৎ করোনাকে চিরতরে পরাজিত করতে আমেরিকানরা যেভাবে জেগে উঠেছেন তার সিড়ি বেয়েই সামনের দিনগুলো আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠবে বলে অনেকে মনে করছেন। তিনি বলেছেন হেলথ কেয়ার সহজলভ্য করার পাশাপাশি করোনায় বিপর্যস্ত আমেরিকানদের জন্যে আরো আর্থিক-সহায়তার প্রয়োজন রয়েছে। সর্বশেষ ১.৯ ট্রিলিয়ন ডলারের ‘আমেরিকা উদ্ধার পরিকল্পনা’র প্রসঙ্গ টেনে বাইডেন বলেন, মানুষের মধ্যেকার হতাশা কেটে যাচ্ছে।

করোনার কারণে এবার কংগ্রেসম্যান কিংবা সিনেটররা কোন অতিথি আনতে পারেননি। মন্ত্রী পরিষদের মাত্র দু’জন আমন্ত্রিত হন। সুপ্রিম কোর্টের ৯ বিচারপতির মধ্যে মাত্র প্রধান বিচারপতি জন জি রবার্ট ছিলেন ফ্লোরে। জয়েন্ট চীফ অব স্টাফের চেয়ারম্যান জেনারেল মার্ক এ মিলি উপস্থিত ছিলেন সামরিক বাহিনীর প্রতিনিধি হিসেবে। ফার্স্ট লেডি জিল বাইডেন এবং সেকেন্ড জেন্টেলম্যান ডোগ ইমহোফও কোন অতিথি আনতে পারেননি। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে সামান্যসংখ্যক কংগ্রেসম্যান ও সিনেটর বসেন ফ্লোরে। অন্যেরা বসেন গ্যালারিতে। প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য যে. সচরাচর ১৬০০ জনের সমাগম ঘটে প্রেসিডেন্টের যৌথ অধিবেশনে বক্তব্যের সময়। এবার মাত্র ২০০ জন ছিলেন চেম্বারে। আরও উল্লেখ্য, এই অধিবেশনকে ‘জাতীয় বিশেষ নিরাপত্তা ইভেন্ট’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। এজন্যে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারি সংস্থাসমূহের পদস্থ কর্মকর্তারা তাদের অধিনস্ত লোকজন দিয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থার তদারকি করেন। গত ৬ জানুয়ারিতে ক্যাপিটল হিলে ট্রাম্প সমর্থকদের জঙ্গি তৎপরতার কথা বিবেচনায় রেখে সর্বোচ্চ নিরাপত্তার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।