সৌরভ শর্মা


বসের হাত থেকে আজ আর রক্ষা নেই। অফিসে দেরী, তার চোখে সবচেয়ে ভয়ংকর অপরাধ। কাকে দেখে যে আজ ঘুম থেকে উঠলাম! বাসা থেকে বেরুলাম এমনিতে লেট করে।তার উপর রিকশা পাচ্ছিনা। অবশেষে হাঁটা দিলাম। অফিস আমার বাসা থেকে পনেরো মিনিটের পথ। রাস্তার বামে হাই স্পিডে হাঁটছি।আর ঘনঘন ঘড়ি দেখছি।

সামনের মোড়টা ক্রস করলেই অফিস। হঠাৎ বাসের জানালায় আমার চোখ আটকে গেলো।এক অসম্ভব সুন্দরী মেয়ে বাইরে থাকিয়ে আছে। আর তার চুল বাতাসে উড়ছে। অনেক চেষ্টা করেও চোখ সরাতে পারলাম না। যেনো মেয়েটি আমাকে অদৃশ্য আদেশ দিচ্ছে, এইযে অফিসগামী, অফিসে তো এমনিতে লেট করে ফেলেছেন। আমার জন্য না হয় আরেকটু লেট করেন। আমার দিকে এক্ষুনি তাকান। নয়তো আপনাকে আমার রুপের আগুনে ভস্ম করে দিবো।

আমি থাকিয়েই আছি। আর মেয়েটি আমার দিকে ভুলেও তাকাচ্ছেনা।একি আমি এতো বেহায়ার মতো তাকিয়ে আছি কেনো?কি হবে আজ একটু বেহায়া হলে! আজ নাহয় তার রুপের নেশায় একটু বেহায়া হলাম। শহরে এরকম মেয়ে সচরাচর দেখা যায় না। যান্ত্রিক শহরে বাস করছে।অথচ দেখে মনে হয় প্রকৃতির মেয়ে।যেনো প্রকৃতি তার সবটুকু দিয়ে মেয়েকে সাজিয়ে দিয়ে বলেছে,যাও মা এবার শহরবাসীকে একটু তোমার রুপের বাহার দেখিয়ে আসো। আর মেয়েটিও বাধ্য সন্তানের মতো মায়ের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে।

যাত্রী নামিয়ে বাস আবারো চলা শুরু করলো।আমার নিজের চেয়ে বাসকেই বেশি সৌভাগ্যবান মনে হলো।আমি শুধু দূর থেকেই কয়েকমিনিটের জন্য তাকে দেখলাম। আর বাস তাকে ছুঁয়ে দেখছে। তার পরশ পাচ্ছে। তাকে পরশ দিচ্ছে। ইচ্ছে করছে বাস হতে।

কয়েকদিন আগে আব্বা ঢাকায় এসেছে।ডাক্তার দেখাতে। আব্বাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলাম। ডাক্তার কিছু টেষ্ট দিলো।টেষ্ট করাচ্ছি এমন সময় এক জটলা দেখতে পেলাম। সামনে এগিয়ে যেতেই বুঝলাম তাদের সমস্যা।রক্ত জোগাড় হচ্ছেনা। অথচ আর আধঘন্টার মধ্যে রোগীকে রক্ত দিতে হবে।

জটলার এক কোণে দেখলাম বাসের সেই মেয়েটি। একজন বয়স্ক মহিলার পাশে বসে আছে। মলিন চেহারা। একজন থেকে জানলাম মেয়েটির নাম অগ্নিলা। রোগীটি মেয়েটির বাবা। আরো জানলাম কোন গ্রুপের রক্ত লাগবে। বলল,বি নেগেটিভ। আরে, এতো আমার রক্তের গ্রুপ! ভাবলাম তবে আর দেরী কেনো। এ সুযোগে হয়তো মেয়েটির সাথে পরিচিত হওয়া যাবে। রক্ত দিলাম। কিন্তু মেয়েটির সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেলাম না।

কারো অজান্তে কাউকে সাহায্য করার অভ্যাস আমার ছোটবেলা থেকে । একাজ করে আমি ভীষণ আনন্দ পেতাম। আজো পাই। কাউকে সাহায্য করলাম অথচ সে জানালোনা। ভাবতেই মজা। সেদিন রুমমেট ছোটভাইয়ের সাথে ভার্সিটিতে গেলাম। ও অফিসে স্যারের সাথে কথা বলতে যাবে। ভাবলাম এই ফাঁকে ভার্সিটি আনাচে-কানাচে একটু চষে বেড়ানো যাক।

একটা রুমের সামনে আসতেই এক তেজী কণ্ঠ শুনলাম। মানুষটি গলা ফাটিয়ে বলছে,আগামী পরশুর মধ্যে ভার্সিটির মাসিক ফি না দিলে তোমাকে বহিষ্কার করা হবে। মেয়েটি কোন কথা না বলে চলে যাচ্ছে। একি!এ তো সেই মেয়েটি। সে চলে যেতেই আমি তার ফি পরিশোধ করে দিলাম। ভাবলাম সে নিশ্চয়ই একদিন জানবে।

মেয়েটি বেশ কয়েকদিন আমাকে খুব জ্বালিয়েছে। ইচ্ছে মতো আমার স্বপ্নে এসেছে।খুব ভোরে আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দিয়েছে। চা দিতে দিতে কড়া আদেশ করে বলেছে,চা খাওয়া শেষ হলেই বাজারে যাবে।এই নাও বাজারের লিষ্ট। অফিসে যাবার সময় আমার টাই ঠিক করে দিতে দিতে বলেছে,তাড়াতাড়ি বাসায় এসো। আমার খুব একা একা লাগে।

ব্যস্ততা আমাদের অনেক কিছু ভুলিয়ে দেয়। অফিসের কাজের চাপে আমিও ভুলে গেলাম তাকে।এখন সে আর আমার স্বপ্নে আসেনা। তাকে ভেবে আমিও আর হিসাবে গোলমাল করিনা।

অফিসিয়াল কাজে এক বন্ধুর অফিসে গেলাম। অফিসে ঢুকতেই আবারো তাকে দেখলাম। হাতে ফাইল। বুঝতে বাকি রইলোনা চাকরির জন্য এসেছে। কাজ শেষ হবার পর বন্ধুকে রিকুয়েস্ট করলাম যাতে ঝিনুক নামে কোনো মেয়ে আসলে তার চাকরিটা হয়ে যায়। বন্ধু আমাকে আশ্বস্ত করলো।পরদিন খবর নিলাম। জানলাম তার চাকরি হয়ে গেছে।

আগেই আন্দাজ করেছিলাম আজ আমার ঘুম আসবেনা। দীর্ঘ বিরতি দিয়ে মেয়েটি আবার আমার ঘুমে হানা দিবে। মনে মনে ভাবলাম, এবার আমার কাজ সহজ হলো। তার সাথে পরিচিত হওয়া যাবে। তার পছন্দ অপছন্দ জানা যাবে। আমি তাকে জানবো। সে আমাকে জানবো।একসময় সুযোগ বুঝে তাকে বলব প্রথম দেখার ঘটনা। অবশ্য উপকারের কথা কখনোই বলবোনা। সে যদি জানতে পারে তা ভিন্ন কথা।

আমার বন্ধু সিয়াম। বেশকিছু দিন ধরে খুব ফোন করছে। তার সাথে পাত্রী দেখতে যাবার জন্য। আমার যেতে ইচ্ছে করছিলো না। সে নাছোড়বান্দা। আমাকে যেতেই হবে। অবশেষে এক ধরনের বাধ্য হয়ে রাজি হলাম। গেলাম তার সাথে।

পাত্রীকে আমাদের সামনে আনা হলো।ঘোমটা তুলতেই আমার হার্টবিট বেড়ে গেলো।আমি একি দেখছি! এ তো বাসের সেই মেয়েটি। যাকে নিয়ে আমি প্রতিদিন নিজের অজান্তেই স্বপ্নের বীজ বুনেছি। ঘন্টাখানেক এক ধরণের ঘোরের মধ্যে ছিলাম। কখন যে বাসার সামনে চলে এসেছি বুঝতেই পারিনি।

গাড়ি থামিয়ে সিয়াম বলল,তোর বাসার সামনে চলে এসেছি। নামবিনা?
আমি বললাম, নামবো।
সিয়াম বলল,নামার আগে বল মেয়েটিকে তোর পছন্দ হয়েছে। তোর যদি পছন্দ না হয় তাহলে এ বিয়ে নট।
আমি গাড়ি থেকে নেমে একবুক কষ্ট নিয়ে বললাম,অনেক পছন্দ হয়েছে।


সৌরভ শর্মা ,কক্সবাজার।