কক্সবাজারে কেজি ২৫ টাকা, ইউরোপে ১৫ হাজার টাকা!

আহমদ গিয়াস:
ইউরোপ-আমেরিকার অভিজাত শ্রেণির প্রিয় খাদ্য বার্নাকলের চাষ হতে পারে আমাদের বঙ্গোপসাগরেও। খোলা সমুদ্রে খাঁচা বা বাঁশ-কাঠের মাধ্যমে এই সামুদ্রিক প্রাণীর চাষ হতে পারে আর এর মাধ্যমে দেশের ব্লু-ইকনোমি তথা সমুদ্র সম্পর্কিত অর্থনীতির নতুন দুয়ার খুলে যেতে পারে।
বার্নাকল্সকে স্থানীয় ভাষায় ‌ছিলইন’ বলা হয়। কক্সবাজারে পোল্ট্রি ও ফিশারিজ খাদ্য হিসাবে বার্নাকল্স গুঁড়া প্রতিকেজি সর্বোচ্চ ২৫ টাকা দরে বিক্রি হয়। অথচ ইউরোপে আস্ত বার্নাকল্স বিক্রি হয় প্রতিকেজি ২শ ডলারের কাছাকাছি। যা বাংলাদেশী মুদ্রায় ১৫ হাজার টাকার মত। সম্প্রতি কক্সবাজার সৈকতে ভেসে আসা জৈব ও অজৈব বর্জ্যে বার্নাকল্স এর ব্যাপক উপস্থিতি বঙ্গোপসাগরে বার্নাকল্স চাষের বিপুল সম্ভাবনার একটি ইঙ্গিতও বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।
বার্নাকল্স দেখতে মলাস্ক বা শামুক-ঝিনুকের মত মনে হলেও এটি আসলে ক্রাস্টাসিন; যা কাঁকড়া ও লবস্টারের কাছাকাছি একটি সামুদ্রিক প্রাণী। খাদ্য হিসাবেও এর স্বাদ কাঁকড়ার মতোই বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এবিষয়ে রাজধানী ঢাকার ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের পরিবেশ বিজ্ঞান বিষয়ের বিভাগীয় প্রধান ও বিশিষ্ট জীববিজ্ঞানী প্রফেসর রাগিবউদ্দিন আহমদ বলেন, আমাদের বঙ্গোপসাগরে অনেক প্রজাতির বার্নাকেলস আছে। খুব ছোট থেকে গভীর সাগরে অনেক বড় প্রজাতির বার্নাকেলস আছে। এরা পাথর, কাঠসহ যেকোনো শক্ত পদার্থে আটকে থাকে তাদের পা সদৃশ আঁঠালো অংশ দিয়ে। এরা লোনা পানিতে বেঁচে থাকে এবং দ্রæত প্রজনন করে। ভাটার সময় দেখা যায় জোয়ারে তলিয়ে যায়, সেইন্টমার্টিন’স এর এমন ডুবো পাথরে ভিন্ন প্রজাতির বার্নাকেলস দেখা যায়। মহেশখালীর ল্যান্ডিং ব্রিজ এর পিলারের গায়ে এক প্রজাতির বার্নাকেলস দেখা যায়। এদের শরীরের কিনারা বেøডের চেয়েও বেশি ধারালো। সামুদ্রিক কচ্ছপের পিঠে, তিমি মাছের গায়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির বার্নাকেলস দেখা যায়।
তিনি জানান, ইউরোপের স্পেন ও পর্তুগালসহ উত্তর আমেরিকার অভিজাত মার্কেটগুলোতে প্রতিকেজি বার্নাকল্স এর দাম ২ শ ডলারের কাছাকাছি বা বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ১৫ হাজার টাকা। জাপান, থাইল্যান্ড ও চীনেও এটা মানুষের খাদ্য। এরা সাগরে অয়েষ্টারের মতোই বার্নাকল্স এর চাষ করে।
বিশিষ্ট সামুদ্রিক মৎস্য বিজ্ঞানী, বাংলাদেশ ফিশারিজ রিচার্স ইন্সটিটিউটের (বিএফআরআই) সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশরাফুল হক বলেন, সম্প্রতি কক্সবাজার সৈকতে ভেসে আসা জৈব ও অজৈব বর্জ্যে যে বার্নাকল্স এর ব্যাপক উপস্থিতি দেখা গেছে, সেটি গুস বার্নাকল্স (Goose Barnacles) বা হংসমুখ বার্নাকল্স। এটি খাদ্য হিসাবে ইউরোপে পেরিসিবিস নামেই বেশি পরিচিত।
তিনি বলেন, বার্নাকল্স দেখতে মলাস্ক বা শামুক-ঝিনুকের মত মনে হলেও এটি আসলে ক্রাস্টাসিন; যা কাঁকড়া ও লবস্টারের কাছাকাছি একটি সামুদ্রিক প্রাণী। খাদ্য হিসাবেও এর স্বাদ কাঁকড়ার মতোই।
কক্সবাজারস্থ সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ শফিকুর রহমান বলেন, পৃথিবীতে প্রায় ১০০০ প্রজাতির বার্নাকল্স দেখা যায়। এরমধ্যে কাছিমের গায়ে আটকায় এমন ২৯ প্রজাতির বার্নাকল্সও রয়েছে। বার্নাকল্স হল এনক্রাস্টার, যারা অস্থায়ীভাবে একটি শক্ত সাবস্ট্রেটে সংযুক্ত থাকে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় ‘অ্যাকোন বার্নক্লেসস’ (স্যাসিলিয়া), যা দেখতে ক্রিস্টাল বা নির্মল। এদের স্তুপগুলি সরাসরি স্তরটিতে বাড়ানো হয়। আর গুস বার্নাকল্স বা হংসমুখ বার্নাকল্সসহ অন্যান্য বার্নাকল্সগুলো একটি ডাঁটার মাধ্যমে নিজেকে সংযুক্ত করে। আমাদের কক্সবাজারের কাঁকড়া ঘেরেও বার্নাকল্স এর ব্যাপক উপস্থিতি দেখা যায়। এরা কাঁকড়ার শরীরেও বাসা বাঁধে।
তিনি জানান, ভাসমান কোন কিছু পেলেই ওরা আটকে থাকে বলে এদেরকে নাছোড়বান্দা সঙ্গী বলা হয়। বার্নাকল্স গুগলিশামুক নামেও পরিচিত।

কক্সবাজারের স্থানীয় ভাষায় বার্নাকল্সকে ‘ছিলইন’ বলা হয়। এটি কক্সবাজারের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী রাখাইন সম্প্রদায়ের লোকজনের ঐতিহ্যবাহী খাবার। তবে বাঙালীরা এটি খায় না। সাধারণত: বার্নাকল্সকে গুড়ো করে পোলট্টি ও ফিশারিজ খাদ্য হিসাবে কেজি প্রতি সর্বোচ্চ ২৫ টাকা দরে বিক্রি করা হয়। অথচ স্পেনের বন্যতম ও সবচেয়ে দর্শনীয় খাবারটি হল গুস বার্নাকল্স বা ছিলইন। এ খাবারটি ঐতিহ্যগতভাবে স্পেনের উত্তরে গ্যালিসিয়ায় ওয়েভ বাটারড শিলা থেকে কাটা হয়। খাবারটি পেরিসিবিস নামে বেশি পরিচিত। মরক্কো থেকেও বার্নাকল্স এর আমদানী করে ইউরোপের দেশগুলো। সম্প্রতি উত্তর আমেরিকায় উত্তর পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় একটি উৎস থেকেও বার্নাকল্স সংগ্রহ করা হচ্ছে বলে জানান বিজ্ঞানীরা।
বিজ্ঞানীরা জানান, বার্নাকল্স হল ক্রাস্টেসিয়ানগুলির একটি অত্যন্ত বিশেষায়িত গোষ্ঠী। তারা প্রাপ্তবয়স্ক হিসাবে একটি নির্লজ্জ ভ্রাম্যমান জীবনধারা বিকাশ করে এবং পাথর, জাহাজ, তিমি বা সমুদ্রের কচ্ছপের মতো বিভিন্ন স্তরগুলিতে নিজেকে যুক্ত করে। এরা প্রাথমিকভাবে খন্ড লার্ভা আকারে জন্ম নেয়। এরা প্রথম ছয়টি মাস নপলিয়াস লার্ভা পর্যায়ে, আর সপ্তম মাসে সাইপ্রিড লার্ভা পর্যায়ে নতুন স্থরটিতে বিকশিত ও স্থির হয়। সাইপ্রিড লার্ভাতে এন্টেনা আটকানোর কাপের মত একটি বিশেষ সংযুক্তি ডিভাইস রয়েছে, যা দিয়ে এরা নিজেকে সাবস্ট্রেটে আটকে রাখতে পারে। এরা একবার আটকাতে পারলে এরপর প্রাপ্তবয়স্ক হিসাবে বিকশিত হয় এবং বিভিন্ন উপায়ে সংযুক্ত হয়। ফলে এদের চাষবাসও সহজ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। আর তাঁদের মতে, খোলা সমুদ্রে মেরিকালচার প্রযুক্তির মাধ্যমে এই সামুদ্রিক প্রাণীর চাষের মাধ্যমে দেশের বøু-ইকনোমি তথা সমুদ্র সম্পর্কিত অর্থনীতির নতুন দোয়ার খুলে যেতে পারে।
মেরিকালচার প্রজনন-প্রযুক্তির মাধ্যমে ২০১৯ সালের ফেব্রæয়ারি মাসে দেশের সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে মৎস্য মন্ত্রণালয়। ‘উপকূলীয় ও বঙ্গোপসাগরের জলজসম্পদ উন্নয়নে’ গৃহীত প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার একটি মেগাপ্রকল্পের অধীনে মেরিকালচার নিয়ে গবেষণার কথাও বলা হয়েছে। বর্তমানে মেরিকালচার প্রযুক্তিতে শীর্ষস্থানে রয়েছে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া। এসব দেশে মেরিকালচার লাভজনক হওয়ায় আমাদের দেশেও এই প্রজনন-প্রযুক্তি অর্জনের জন্য গবেষণা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছিছেন বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের (বিএফআরআই) মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ।
তিনি জানান, খোলা সমুদ্রে ট্যাংক বসিয়ে বা অন্যকোন উপায়ে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে সামুদ্রিক মৎস্যচাষ হল মেরিকালচার। মানুষের খাদ্য চাহিদা মেটানোর জন্য উন্নত বিশ্বে এ পদ্ধতিতে চিংড়ি, ওয়েস্টার, সেলফিশ, ফিনফিশ ও সী-উইড বা সামুদ্রিক শৈবাল উৎপাদন করা হয় । তবে বার্নাকল্স এর চাষ সম্পর্কে এখনও আমরা গবেষণা শুরু করতে না পারলেও আশা করি অদূর ভবিষ্যতে পারব।
বিএফআরআই মহাপরিচালক বলেন, প্রধানমন্ত্রী প্রচেষ্টায় ভারত ও মিয়ানমারের ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় যুক্ত হয়েছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে উত্তরণ এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রেও এ সামুদ্রিক সম্পদের গুরুত্ব ও অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে।