হাফেজ মুহাম্মদ আবুল মঞ্জুর


‘জিলহজ্ব’ হিজরী বর্ষের শেষ মাস। মুসলিম উম্মাহর নিকট এ মাসটি অত্যন্ত মহিমান্বিত ও তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এমাসেই মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের অদম্য বাসনা নিয়ে সারা বিশ্বের সক্ষম ও সামর্থবান মুসলমানেরা পবিত্র হজ্বব্রত পালন করেন। মহান রবের নিকট একনিষ্ঠ আত্মসমর্পণের উদ্দেশ্যে সমবতে লাখো মু’মিনের কন্ঠে ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠে মহানবী হযরত মুহাম্মদ স. এর প্রিয় জন্মভূমি মক্কাতুল মুকাররমা। সকলের পরনে একই ধরণের সাদা কাপড় (ইহরাম), সবার কন্ঠে এক আল্লাহর বড়ত্বের ঘোষণা এবং একই তরিকায় মহান আল্লাহর প্রতি ভালবাসার বহিঃপ্রকাশের মধ্যদিয়ে সৃষ্টি হয় তাকওয়ার এক অনুপম পরিবেশ। আধ্যাত্মিক চেতনায় দীপ্তিমান হয়ে উঠে মু’মিনের আত্মা। মহান প্রভূর সান্নিধ্যে বান্দাহর আত্মসমর্পণের কি অভূতপূর্ব মায়াবী দৃশ্য!
শুধু তাই নয়; এ মাসে রয়েছে ইসলামের আরো দুটি শাশ্বত বিধান তথা কুরবানী ও ঈদুল আয্হা। যা মুসলিম উম্মাহর মাঝে তাকওয়ার অনুভূতি জাগ্রত করে, আর ঈমানী স্পৃহাকে করে অধিকতর শাণিত। সর্বোপরী কুরবানী একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত এবং ইসলামের অন্যতম ঐতিহ্য। তথাপি ঈদুল আযহা আত্মত্যাগের আনন্দমূখর ও সম্প্রীতির বার্তাবহ একটি উপলক্ষ। তাই কুরবানী ও ঈদুল আয্হার তাৎপর্য, শিক্ষা ও মাসায়েল জেনে তদানুযায়ী আমল করা মু’মিন-মুসলমানদের জন্য অবশ্য করণীয়। আসুন, জেনে নিই এসব অপরিহার্য বিষয়াবলী ও নির্দেশনা।

কুরবানীর শাব্দিক অর্থ:
কুরবানী আরবী শব্দ। আরবী ‘কুরবানুন’ কুরবুন শব্দ থেকে নির্গত। যার অর্থ নৈকট্য, উৎসর্গ, বিসর্জন ও ত্যাগ ইত্যাদি।
শরিয়তের পরিভাষায় কুরবানী:
আল্লাহর তা’আলার সন্তুষ্টি তথা নৈকট্য লাভের মহান উদ্দেশ্যে জিলহজ্ব মাসের ১০, ১১ ও ১২ তারিখ এই তিনটি দিনের যে কোন দিন আল্লাহর নামে নিদৃষ্ট নিয়মে হালাল পশু যবেহ করাই হলো শরিয়তের পরিভাষায় কুরবানী। প্রতি বছর দশ-ই জিলহজ্ব ত্যাগ ও আনন্দের বার্তা নিয়ে মুসলমানদের দ্বারে হাজির হয় পবিত্র ঈদুল আয্হা। এ দিন সকালে ঈদুল আযহার দু’রাকাত ওয়াজিব নামাজ আদায়ের পর মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সামর্থবান মুসলমানেরা শরীয়ত অনুমোদিত পশু কুরবানী করেন।

কুরবানী কার উপর ওয়াজিব:
প্রাপ্ত বয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন, স্বাধীন ও মুকিম (মুসাফির নয় এমন ব্যক্তি) মুসলিম নর-নারী যে জিলহজ্ব মাসের ১০তারিখ সুবহে সাদিক থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনাতিরিক্ত নিসাব (সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা কিংবা সে পরিমাণ স্বর্ণ বা রুপার মূল্য) পরিমাণ সম্পদের মালিক হবে তার ওপর কুরবানী ওয়াজিব (বাদায়েউস সানায়ে ৫/৬৩)। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেন, সুতরাং আপনার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে নামায পড়ুন এবং কুরবানী করুন। (সূরা কাউছার, আয়াত- ০২)।

কুরবানীর ফযিলত:
হযরত আয়েশা (রা.) সূত্রে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘কুরবানীর দিন কুরবানীর চেয়ে উত্তম ও প্রিয় কোন আমল নেই। কিয়ামত দিবসে কুরবানীর জন্তু শিং, পশম, খুরসহ উপস্থিত হবে এবং কুরবানীর জন্তুর রক্ত মাটিতে পতিত হওয়ার পূর্বেই আল্লাহ তা’আলার কাছে কবুল হয়ে যায়। তাই তোমরা আনন্দ চিত্তে কুরবানী কর।’ (তিরমিযি-১৪১৩)। সাহাবায়ে কেরাম (র.) নবী করীম (স.) এর কাছে জানতে চাইলেন কুরবানী কি? উত্তরে তিনি ইরশাদ করেন, ‘কুরবানী হলো তোমাদের পিতা হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর সুন্নাত। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন এতে আমাদের জন্য কি বিনিময় রয়েছে? মহানবী (স.) বললেন কুরবানী জন্তুর প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে সওয়াব রয়েছে। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ (স.) তাহলে ভেড়ার হুকুম কি? নবীজী (স.) বলেন, ভেড়ার প্রতিটি পশমের বদলায়ও একটি করে সওয়াব রয়েছে।’ (ইবনে মাজাহ -২৬৬)।

সামর্থবান হওয়া স্বত্ত্বেও কুরবানী না করার পরিণাম:
রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানী করে না সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।’ (ইবনে মাজাহ- ৩১১৪)। তাই সামর্থ্য থাকা স্বত্ত্বেও কুরবানীর মত এই মহিমান্বিত ইবাদত থেকে বিরত থাকা কোনভাবেই কাম্য নয়। বরং সর্বোচ্চ ইখলাস ও তাকওয়ার অনুভূতি নিয়ে কুরবানীর মত তাৎপর্যপূর্ণ আমলটি পালন করা সামর্থ্যবান মুসলমানদের ঈমানী কর্তব্য। তবে এক্ষেত্রে কোন ধরণের লৌকিকতার আশ্রয় নেয়া জায়েয নেই। যেমন- অনেকে কুরবানীর জন্তকে পুষ্পমাল্য, লাল কাপড় ইত্যাদিতে সজ্জিত করে লোক দেখানের উদ্দেশ্যে ঘুরা-ঘুরি করান, যা শরীয়তের দৃষ্টিতে অত্যন্ত গর্হিত কাজ।

আইয়্যামে তাশরীক ও তাকবীরে তাশরীক:
আরাফার দিন অর্থাৎ ৯জিলহজ্ব থেকে ১৩ তারিখ পর্যন্ত সময়কে আইয়্যামে তাশরীক বলে। এ দিন গুলোতে তথা ৯জিলহজ্ব এর ফজর থেকে ১৩ জিলহজ্ব এর আসর পর্যন্ত প্রত্যেক ফরজ নামাজান্তে একবার করে তাকবীর বলা সব প্রাপ্ত বয়স্ক মুসলিম নর-নারীর (একাকী নামাজ আদায়কারী হোক বা জামাতে নামাজ আদায়কারী হোক) উপর ওয়াজিব। এ তাকবীরের নাম তাকবীরে তাশরীক। তাকবীর পুরুষেরা উচ্চঃস্বরে এবং মহিলারা নিম্নস্বরে বলবে। যার উচ্চারণ- ‘আল্লাহু আকবর আল্লাহু আকবর লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবর আল্লাহু আকবর ওয়া লিল্লাহিল হামদ্’। জামাতের পর যদি ইমাম সাহেব তাকবীর বলতে ভূলে যান মুক্তাদির উচিত উচ্চঃস্বরে তাকবীর পড়া, যেন ইমাম ও অন্যান্য নামাজির স্মরণ হয় এবং তারাও তাকবীর বলে।

কুরবানীর নির্ধারিত সময়:
জিলহজ্ব মাসের ১০ তারিখ সূর্য উদিত হওয়ার পর থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্তের আগ পর্যন্ত কুরবানীর নির্ধারিত সময়। তবে যবেহ অবশ্যই ঈদুল আযহার নামাজের পর আরম্ভ করতে হবে। উল্লেখ্য ১০ জিলহজ্ব কুরবানী করা সবচেয়ে উত্তম। তার পর পর্যায়ক্রমে ১১ ও ১২ তারিখ। সুতরাং অনিবার্য কোন কারণ ছাড়া দেরী না করাই ভাল।

কুরবানীর পশু :
শরীয়ত মোতাবেক গরু মহিষ ও উট, ছাগল ভেড়া, দুম্বা দ্বারাই কুরবানী করতে হয়। অন্য কোন পশু দিয়ে কুরবানী করা বৈধ নয়। সুতরাং হরিণ বা বন্য পশু দ্বারা কুরবানী করা বৈধ হবে না। ছাগল, ভেড়া, দুম্বা এক ব্যক্তির পক্ষ থেকে কুরবানী করতে হয়। গরু, মহিষ, উটে সাত ব্যক্তি অংশীদার হতে পারে। কিন্তু সকলেরই সওয়াবের নিয়্যত হতে হবে। একজনেরও কেবল গোশত খাওয়ার নিয়্যত হলে কারও কুরবানী আদায় হবে না।

কুরবানীর জন্তুর বয়স:
ছাগল, খাসি, ভেড়া ও দুম্বা পূর্ণ একবছর বয়স্ক হতে হবে। গরু, মহিষ দুই বছর এবং উট ৫বছর বয়স্ক হতে হবে। উল্লেখিত বয়সের চেয়ে কম বয়স্ক পশু দিয়ে কুরবানী জায়েজ হবে না। তবে হ্যাঁ এক বছরের কম বয়স্ক ভেড়া ও দুম্বা যদি এক বছর বয়স্ক ভেড়া দুম্বার সমকক্ষ মোটা তাজা মনে হয় তবে সে ভেড়া ও দুম্বা কুরবানী করলে আদায় হবে। (জাওয়াহিরুল ফিক্হ)

কুরবানীর জন্তুর বৈশিষ্ট্য:
কুরবানীর জন্তু শরীয়ত বর্ণিত সর্বপ্রকার দোষ ত্রুটি হতে মুক্ত হওয়া অপরিহার্য। যে পশুর জন্মগতভাবে শিং নেই বা মাঝখানে ভেঙ্গে গেছে তা দিয়ে কুরবানী বৈধ। হ্যাঁ যে পশুর শিং মূলসহ উঠে গেছে, যা দ্বারা তার মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া স্বাভাবিক এরূপ পশু দিয়ে কুরবানী বৈধ নয়। অন্ধ, কানা (এক চক্ষু দৃষ্টিহীন) খোড়া এরূপ পশুতে কুরবানী জায়েয নয়। অনুরূপভাবে যে পশু এত রুগ্ন যে পায়ে হেটে যবেহ স্থলে যেতে সক্ষম নয় তা দ্বারা কুরবানী জায়েয নয়। যে পশুর লেজ, কান ইত্যাদি তিন ভাগের একভাগ হতে বেশি কাটা হবে তা দ্বারা কুরবানী যায়েয হবে না। যে পশুর দাঁত সম্পূর্ণ নেই অথবা অর্ধেকের চেয়ে বেশি নেই ওইরূপ পশু দ্বারা কুরবানী জায়েয হবে না। যে পশুর জন্মগত ভাবে মোটেই কান নেই তা দ্বারাও কুরবানী জায়েয হবে না। (ফতোয়ায়ে শামী)।

অংশীদারী কুরবানী:
গরু, মহিষ ও উটে সাত ব্যাক্তি শরীক হওয়া জায়েয আছে। কিন্তু শর্ত হলো যেন কারও অংশ সাত ভাগের একভাগের কম না হয়। কম হলে কারও কুরবানী সহীহ হবে না। অংশীদারদের মধ্যে যদি সকলেরই কুরবানীর নিয়ত হয় অথবা সকলেরই আকিকার নিয়্যত হয় কিংবা কতিপয়ের আকিকার নিয়্যত এবং কতিপয়ের কুরবানীর নিয়্যত হয় তবুও কুরবানী সহীহ হবে। কুরবানীর অংশের সাথে আকিকার অংশ মিলানো জায়েয। দুই বা ততোধিক ব্যক্তি শুধু মাত্র এক অংশে শরীক হয়ে কুরবানী করা জায়েয হবে না।

মান্নত কুরবানী:
কোন কাজ সিদ্ধির জন্য কুরবানীর মান্নত করলে উক্ত কাজ সিদ্ধির পর তার ওপর কুরবানী ওয়াজিব হবে। চাই সে ব্যক্তি ধনী হোক বা দরিদ্র হোক। মান্নতের কুরবানীর সমস্ত গোশত ফকির-মিসকিনকে সদ্কা করে দিতে হবে। যদি নিজে খায় অথবা কোন ধনী ব্যক্তিকে খাওয়ায় তবে উক্ত পরিমাণের মূল্য সদকা করা ওয়াজিব হবে। (ফতোয়ায়ে শামী)।

কুরবানীর গোশত:
অংশীদারী কুরবানীর গোশত ওজন করে বন্টন করা ওয়াজিব। অনুমান করে বন্টন করা জায়েয হবে না। কুরবানীর গোশত তিন ভাগ করে একভাগ নিজ পরিবার-পরিজনের জন্য রাখা এবং একাংশ বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনকে দেওয়া আর এক অংশ ফকির-মিসকিনদেরকে দান করা উত্তম। (ফতোয়ায়ে শামী ও হেদায়া)।

কুরবানীর সুন্নাত তরিকা:
কুরবানীর জন্তু নিজ হাতে যবেহ করা মুস্তাহাব। হযরত আনাস (র.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) দুটি দৃষ্টি নন্দন শিং ওয়ালা ভেড়ার দিকে এগিয়ে গেলেন এবং নিজ হাতে সে দুটিকে যবেহ করলেন। (বুখারী-৫১৮)। হ্যাঁ নিজে অপারগ হলে অপরকে দিয়েও যবেহ করানো যেতে পারে। তবে যবেহ’র সময় কুরবানীর স্থলে উপস্থিত থাকা ভাল। শুধু অন্তরে তথা মনে মনে নিয়্যত যথেষ্ট হবে মৌখিক বলা জরুরী নয়। কিন্তু যবেহের সময় ‘বিছমিল্লাহি আল্লাহু আকবর’ মুখে বলা জরুরী। যবেহের জন্য পশু কেবলামূখী করে শুয়াতে হবে এবং যবেহ কালে ওই দু’আ পড়তে হবে যা রাসুল (স.) পড়তেন। যথা- ‘ইন্নি ওয়াজ্জাহতু ওয়াজহিয়া’ থেকে ‘ওয়ামা আনা মিনাল মুশরিকিন’ এবং ‘কূল ইন্না সালাতি’ থেকে ‘ওআনা আওয়ালুল মুসলিমিন’। তারপর ‘বিছমিল্লাহি আল্লাহু আকবর’ বলেই যবেহের কাজ সম্পন্ন করবে এবং যবেহের পর এই দু’আটি পড়বে যথা- ‘আল্লাহুম্মা তাকাব্বালহু মিন্নী’ থেকে ‘আলাইহিমাচ্ছালাম’ পর্যন্ত। যদি অন্যজনের পক্ষ থেকে হয় ‘মিন্নি’র স্থলে ‘মিনকা’ বলতে হবে। তবে যবেহের ক্ষেত্রে আরও কিছু বিষয়ে সতর্ক থাকা উচিত। যথা কুরবানীর এক জন্তুকে অন্য জন্তুর সামনে যবেহ না করা। যবেহ করার পূর্বে কুরবানীর জন্তুকে খুব ভাল ভাবে খেতে দেয়া এবং ছুরি ধার দিয়ে নেয়া। ভোতা ছূরি দিয়ে যবেহ করা উচিত নয়। কারণ এর দ্বারা জন্তুর কষ্ট হয়। যবেহ করার সময় যথাসম্ভব সহজভাবে যবেহ করা এবং কষ্ট থেকেও সাধ্যনুসারে জন্তুকে বাঁচানো। জন্তু দিনে যবেহ করা মুস্তাহাব। রাতে যবেহ করা মাকরুহে তানযীহী। হযরত ইবনে আব্বাস (র.) সূত্রে বর্ণিত তিনি বলেন, মহানবী (স.) রাতে কুরবানী করতে নিষেধ করেছেন। (আল-মুজামুল কাবীর ১১৪৫৮)।

কুরবানীর পশুর চামড়া:
কুরবানীর পশুর চামড়া কোন কাজ বা খিদমতের বিনিময়ে দেওয়া জায়েয নেই। ওই চামড়া দ্বীনি মাদ্রাসার এতিম-দুঃস্থ ছাত্রদেরকে দান করা উত্তম। কারণ তাতে দুই দিকের সওয়াব অর্জন হয়। এক. গরীবকে দান করার সওয়াব, দুই. দ্বীনে ইসলামের প্রচার ও প্রসারের সওয়াব। কুরবানির চামড়া বিক্রি না করে স্বয়ং কুরবানীদাতা নিজেও অবিকল তা ব্যবহার করতে পারবেন। তবে ফকির-মিসকিনকে দান করাই উত্তম। যদি টাকা-পয়সার বিনিময়ে বিক্রি করা হয় তবে সেই বিক্রিত মূল্যের হকদার ফকির-মিসকিনই। কুরবানীর চামড়া বিক্রি করে তার মূল্য দিয়ে মসজিদ মেরামত, রাস্তা বাঁধা, মাদ্রাসা, মক্তব নির্মাণ করা, ইমাম সাহেব ও শিক্ষকদের বেতন দেয়া জায়েয হবে না। (জাওয়াহিরুল ফিক্হ)।

কুরবানীর শিক্ষা:
হযরত ইব্রাহীম (আ.) ও হযরত ইসমাঈল (আ.) এর ঈমানদ্বীপ্ত সুমহান আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে আল্লাহর জমিনে ইসলামের ঝান্ডা বুলন্দ করার জন্য নিজেদের জান-মাল কুরবানীসহ সর্বোচ্চ ত্যাগের নজরানা পেশ করতে হবে। মহান আল্লাহর নির্দেশ বাস্তবায়নে কঠিন থেকে কঠিনতম কষ্টও মেনে নিতে হবে। এটিই কুরবানীর প্রকৃত তাৎপর্য ও মহান শিক্ষা। এই শিক্ষা ধারণ করতে হবে। তথাপি পশু কুরবানীর সাথে সাথে পশুত্বকেও কুরবানী দিয়ে আত্মাকে করতে হবে পরিশুদ্ধ ও নির্মল। তখনই অন্তরে জাগ্রত হবে তাক্বওয়া তথা খোদাভীতি। সেই তাক্বওয়া-ই কুরবানী থেকে আল্লাহ তা’আলার একমাত্র চাওয়া। এ প্রসঙ্গে কুরআন মজীদে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহর নিকট কুরবানীর গোশত ও রক্ত কিছুই পৌঁছেনা; বরং তার কাছে পৌঁছে একমাত্র তোমাদের তাক্বওয়া। (সূরা হজ্ব, আয়াত- ৩৭।)

ঈদুল আয্হার তাৎপর্য:
মুসলিম মিল্লাতের পিতা হযরত ইব্রাহীম (আ.) ও তাঁর প্রিয় পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ.) এর তাক্ওয়া ও আত্মত্যাগের অবিস্মরণীয় স্মৃতিস্মারক পবিত্র ঈদুল আয্হা। এই ঈদ আমাদেরকে ভোগ-বিলাসিতার মানসিকতা পরিহার করে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের শিক্ষা দেয়। সাথে সাথে ঈদুল আয্হা আমাদের মাঝে জাগিয়ে তুলে মানবিক সম্প্রীতি ও নৈতিক চেতনাবোধ। দূর করে দেয় হিংসা-বিদ্বেষপ্রবণ মানসিকতা। ছড়িয়ে দেয় সাম্য, শান্তি ও সৌহার্দ্যরে বার্তা। অটুট করে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন। এমনটাই ঈদুল আয্হার মূল তাৎপর্য। এ তাৎপর্যের মহিমায় মানব জীবন আলোকিত হলেই সকল অনাচার, দূরাচার ও পাপাচার সমাজ থেকে দূরীভূত হবে। নির্মল হবে মানবাত্মা। পরিশুদ্ধ হবে সমাজ ব্যবস্থা।
আসুন, পবিত্র কুরবানীর উল্লেখিত ফযীলত অর্জনে সচেষ্ট হই। সহীহ্ মাসায়িল জেনে তদানুযায়ী কুরবানী করার দৃঢ় প্রত্যয়ের মধ্যদিয়ে মহান আল্লাহর রাহে পূর্ণ আত্মসমর্পনের দৃপ্ত শপথ নিই। কুরবানী ও ঈদুল আয্হার প্রকৃত তাৎপর্য ও শিক্ষার আলোয় আলোকিত করি নিজেদের জীবনধারা। মহান আল্লাহ আমাদের সেই তাওফিক দান করুন। ॥আমীন॥

লেখক:
খতীব-
শহীদ তিতুমীর ইনস্টিটিউট জামে মসজিদ, কক্সবাজার।
যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক-
কক্সবাজার ইসলামি সাহিত্য ও গবেষণা পরিষদ।