সোলায়মান মোহাম্মদ:
বছর ঘুরে ২১ এলেই সবার মুখেই ভাষা শহীদ ও মাতৃভাষার কথা শুনা যায়। যদিও এখন এর ধরণ অনেকটাই পাল্টে গেছে। আগে শুনতাম এখন দেখি। অর্থাৎ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে সবাই ২১ ফেব্রুয়ারির গুরুত্ব নিয়ে নানা ধরণের পোস্ট করে থাকে। ২১ বাংলা ভাষাভাষি মানুষের অহংকার। রফিক, সালাম, আব্দুল জব্বার, বরকতসহ অনেকের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছিলো। ভাষার জন্য হারাতে হয়েছে সেদিন তাজা তাজা তারুণ্যেভরপুর কিছু প্রাণ। তাদের স্মরণে তাদের সম্মানার্থেই মূলতঃ আমাদের এই দিনকে উদযাপন করা। পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো বাংলা ভাষাকে সম্মান জানিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। তার পর থেকেই প্রতি বছর সারা পৃথিবীতে এ দিনটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করা হয়।

বর্তমান বিশ্বের প্রায় ৩৫ কোটি মানুষের মাতৃভাষা বাংলা। যার অবদান সবটুকুই ভাষা শহীদদের। যাদের রক্ত ও জীবনের বিনিময় আজকে আমরা পেয়েছি বর্ণমালা ও ভাষার অধিকার তাদের ঠিক কতটুকু সম্মান ও মূল্যায়ন বর্তমান সময়ের এই আমরা করতে পারছি বা করছি। ফেসবুকে দু’চার লাইন লেখা, ভোরের কুয়াশা ভেজা সকালে নগ্ন পায়ে শহীদ মিনারে পুস্পস্তবক অর্পন, কালো ব্যাজ পরা, রাজপথ ও শহীদ মিনারে দৃষ্টিনন্দন আলপনা আঁকা ও গান গাওয়া ‘আমার ভাইয়ের রক্ত রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’ ব্যাস এটুকুই কি যথেষ্ঠ শহীদদের সম্মান জানানোর জন্য। পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে অধিকাংশ স্কুল-কলেজগুলো শুধুমাত্র সরকারি আদেশ পালনের তাগিদে কোনোমতে একুশ পালন করে থাকে। প্রকৃতপক্ষে আমরা মাতৃভাষাকে কতোটুকু ভালোবাসি তার প্রমাণ কিন্তু আমাদের চালচলনে পাওয়া যায়। পারিবারিক ও সামাজিক বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানে একুট খেয়াল করলেই আমরা হাতে নাতে ধরা পরবো। সবাই যেনো ইউরোপিয়ান জ্বরে দিন দিন আক্রান্ত হয়ে যাচ্ছি। বাংলা রেখে পশ্চিমাদের কৃষ্টিকালচার অনুসরণ করছি। ছেলেমেয়েদেরকে ইংরেজী স্কুলগুলোতে পাঠিয়ে যেন গর্ববোধ করছি। এমনকি নিজেরা যখন টিভি সেটের সামনে বসছি ঠিক তখনও বাংলা রেখে ভীনদেশি কোনো সিরিয়ালে মজে উঠছি। অনেকেই ভেবে থাকেন এগুলো তেমন কিছু না কিন্তু এই করে করে কিন্তু আজকে আমাদের অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্য ধূলিস্যাতের পথে।

বাংলা ভাষা যেখানে জাতিসংঘের ৭ম দাপ্তরিক ভাষা করার দাবী জানানো হচ্ছে সেখানে এখনও আমরা ফেসবুকে নিজেদের নাম ইংরেজীতে রাখছি। অনেকেই বলে থাকেন আমার দেশ বিদেশে অনেক বন্ধু আছে- যারা বাংলা বুঝে না। তাই ফেসবুক আইডিতে ইংরেজী নাম রাখছি।

তাহলে আমার প্রশ্ন হলো- আপনার যে বন্ধুর কারণে আপনি ওটা করছেন তিনি কি আপনার কারণে তার আইডি তার মাতৃভাষা রেখে আপনার ভাষায় পরিবর্তন করেছে? নিশ্চয়ই করেনি তাহলে আমি,আপনি কেনো করবো বা করছি?

মনে রাখতে হবে নিজেরা নিজেদেরকে যতদিন সম্মান দিতে না জানবো পৃথিবীর অন্য কেউ ততদিন সম্মান দিবে না। অন্যের ভাষা ও কৃষ্টিকালচারকে আমরা অবশ্যই সম্মান জানাই তবে সেটি করতে যেয়ে যেন আমার মাতৃভাষাকে সামন্যটুকুই খাটো করা না হয় সেদিকে সবার আগে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। আসুন মহান ভাষা শহীদ ও ২১ কে সম্মান জানাতে শুধুমাত্র পুস্পস্তবক অর্পনে সীমাবদ্ধ না থেকে কার্যকর কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করি। আর তা শুরু হতে পারে ফেসবুক আইডির ইংরেজী নাম পরিবর্তন করে বাংলায় করার মাধ্যমে। তাছাড়া সরকারের ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় ইচ্ছে করলে এ বিষয় কার্যকর পদক্ষেপ নিতেই পারে। এতে করে বাংলা বর্ণমালার জন্য যারা জীবন দিয়েছেন তাদের স্বপ্ন কিছুটা হলেও পূরণ হবে।

সোলায়মান মোহাম্মদ, কলামিস্ট।
sulaymansir87@gmail.com