আতিকুর রহমান মানিক :

এগিয়ে আসছে ১৪ ফেব্রুয়ারী, সেন্ট ভ্যালেন্টাইনস ডে অর্থাৎ বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। প্রতিবছর ১৪ ফেব্রুয়ারী এলেই ভালোবাসা নিয়ে আনলিমিটেড মাতামাতি শুরু হয়ে যায়। ফুল দেয়া-নেয়া বেড়ে যায়, ফেসবুক-টুইটার ও অন্যান্য সামাজিক মাধ্যম ভালোবাসার জোয়ারে ভাসতে ভাসতে ডুবে যাওয়ার উপক্রম হয়। ভালোবাসায় ধন্য হওয়াদের বাকবাকুম ও বঞ্চিত হয়ে ছ্যাঁকা খানেওয়ালাদের হায় হায় টাইপ স্ট্যাটাস আবার কারো কারো উপদেশমূলক বাণীতে ভরপুর হয়ে যায় সোশ্যাল মিডিয়া। এদিন গুজুর গুজুর করা যুগলরা সৈকতে-ঝাউবনে ঘুরাঘুরি করে ভালোবাসার ফুলঝুরি ঝরায়, আবার ভালোবাসা বঞ্চিতরা বদ্ধ ঘরে কাথা মুড়ি দিয়ে ফেসবুকে দীর্ঘশ্বাস-হাহাকারের তুফান ছোটায়। অনেকেই আবার বিড়িতে সুখটান দিয়ে ধোঁয়ার মাধ্যমে কষ্ট উড়িয়ে দিতে চায়। এদিকে আঁতেল শ্রেণীর ব্যপারটা কিন্তু ভিন্ন। এরা ভালোবাসা কারে কয়, ভালোবাসার শ্রেণী বিন্যাস, পৌরাণিক যুগে ভালোবাসার ডিজিটালাইজেশন জাতীয় লেকচার মারে। ভালোবাসা দিবস সম্পর্কে এক প্রবীণের মতামত নিয়েছিলাম, তিনি আবার আমার নানা সম্পর্কীয়। বললেন, “আমাদের সময়তো এসব হাবিজাবি দিবস ও ছ্যাবলামি ছিলনা। তবে বছর ছ-মাসে তোর নানী দুই দিন বাপের বাড়ী গেলে আমার জগৎ-সংসারও সেখানে চলে যেত”। নানার কথায় বুঝলাম বারোমাসী ভালোবাসার প্রকৃত রূপ।

পল্লীকবি জসিম উদ্দীনের অমর সৃষ্টি “কবর” কবিতার অংশবিশেষে ভালোবাসার প্রকৃত রূপ ফুটে উঠেছে।

“এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ,
পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক।
এখানে ওখানে ঘুরিয়া ফিরিতে ভেবে হইতাম সারা,
সারা বাড়ি ভরি এত সোনা মোর ছড়াইয়া দিল কারা!
সোনালি ঊষার সোনামুখ তার আমার নয়নে ভরি
লাঙল লইয়া খেতে ছুটিলাম গাঁয়ের ও-পথ ধরি।
যাইবার কালে ফিরে ফিরে তারে দেখে লইতাম কত
এ কথা লইয়া ভাবি-সাব মোরে তামাশা করিত শত।
এমনি করিয়া জানি না কখন জীবনের সাথে মিশে
ছোট-খাট তার হাসি ব্যথা মাঝে হারা হয়ে গেনু দিশে।
বাপের বাড়িতে যাইবার কাল কহিত ধরিয়া পা
আমারে দেখিতে যাইও কিন্তু উজান-তলীর গাঁ।
শাপলার হাটে তরমুজ বেচি দু’পয়সা করি দেড়ী,
পুঁতির মালার একছড়া নিতে কখনও হত না দেরি।
দেড় পয়সার তামাক এবং মাজন লইয়া গাঁটে,
সন্ধাবেলায় ছুটে যাইতাম শ্বশুরবাড়ির বাটে!
হেস না- হেস না- শোন দাদু, সেই তামাক মাজন পেয়ে,
দাদি যে তোমার কত খুশি হত দেখিতিস যদি চেয়ে!
নথ নেড়ে নেড়ে কহিত হাসিয়া, এতদিন পরে এলে,
পথ পানে চেয়ে আমি যে হেথায় কেঁদে মরি আঁখিজলে।
আমারে ছাড়িয়া এত ব্যথা যার কেমন করিয়া হায়,
কবর দেশেতে ঘুমায়ে রয়েছে নিঝুম নিরালায়!”

এটাই হল প্রকৃত ভালবাসা, যা মৃত্যুর পরেও বহমান থাকে।
কিন্তু আজকাল ভালোবাসাটাই কেমন যেন মেকি হয়ে গেছে। কারন বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে ওই ১৪ ফেব্রুয়ারী ১ দিনই ভালোবাসা নিয়ে মাতামাতি, অার ৩৬৪ দিন যেন ভালোবাসার দরকার নেই! আসলে ভালোবাসা প্রতিদিনের অন্ন-বস্ত্রের মতই অত্যাবশ্যকীয় একটা বিষয়। আমাদের সমাজ ব্যবস্হায় মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্নীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া প্রতিবেশী ও অন্যান্য সকলের সাথেই আমাদের ভালোবাসা ও হৃদ্যতাপূর্ন সম্পর্ক। তাই আমাদের পুরো জীবনটাই ভালোবাসায় পূর্ন। উপরোক্ত সবার সাথে আমাদের চলাফেরা-বসবাস যেমন প্রতিদিনের, সারামাসের, সারাবছরের। তাই ভালোবাসাও চাই সারাবছরের। এখানে শুধুমাত্র একটা দিন ভালোবাসা দিবস পালন করা কেন ?
এবার আসি ভালো “বাসা” অর্থাৎ ভাল বাসস্হানের কথায়। বাসা মানে বাড়ী অর্থাৎ মাথা গোঁজার ঠাই। সারাদিন কর্মব্যস্ততার পর সন্ধ্যায় এসে বিশ্রাম ও পরিবারের সবার সাথে সুখ-দুঃখ-অনুভূতি ভাগাভাগি করা, রাতের খাবার খেয়ে ঘুমানোর মাধ্যমে পরবর্তী আরেকটি কর্মব্যস্ত দিনের জন্য নিজকে প্রস্তুত করার যে ঠিকানা, তাই হল বাসা অর্থাৎ বাসস্হান। মানুষের পাঁচটি মৌলিক অধিকারের

আতিকুর রহমান মানিক
(সংবাদকর্মী)

অন্যতম জিনিস এই বাসস্হান। বাসস্হান অথবা বাসারও কিন্তু রকমফের রয়েছে। সাধারণতঃ গ্রামের বাসাগুলো হয় খোলামেলা, সুপরিসর। সামনে পুকুর ও প্রশ্বস্ত উঠান, নারকেল-সুপারী বাগান, গরু-মহিষের গোয়াল, হাঁস-মুরগী-ছাগলের খোঁয়াড় ইত্যাদি গ্রামের বাড়ীর অন্যতম অনুসঙ্গ। গাছ-গাছালির ছায়ায় প্রকৃতির একান্ত সান্যিধ্যে বসবাস করে জীবনের জীবনের মানে খুঁজে পাওয়া যায় গ্রামের বাসায়। তাই এসব বাসা আসলেই “ভাল বাসা”।
আর শহুরে বাসাগুলো গুদামসদৃশ, ঘিঞ্জিটাইপ। অাঙ্গিনা, পুকুর ও অন্যান্য সব এখানে নেই। ড্রয়িং, ডাইনিং, কিচেন, বেড ও মাষ্টার বেডরুম নামের খুপরি গুলো যেন এক একটা খোঁয়াড়। এসব বাসায় বসবাস মানেই কোনরকমে মাথা গুঁজে রাত-দিন পার করা। শহুরে বাসাকে তাই “মন্দ বাসা” বললেও বাড়িয়ে বলা হবেনা।
কিন্তু জীবন-জীবিকার তাগিদে শহরে এসব মন্দ বাসায় থাকতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকে।
বিশ্ব ভালোবাসা দিবস নামের আমদানীকৃত যন্ত্রনার পরিবর্তে তাই বিশ্ব ভাল বাসা অর্থাৎ ভাল বাসস্হান দিবস পালন করলে ক্ষতি কি ?
এতে মন্দ বাসার পরিবর্তে ভাল বাসা অর্থাৎ ভাল আবাসন নিশ্চিত করার দাবী জোরালো হবে।
আর ভাল বাসা নিশ্চিত হলে ভালোবাসাও নিশ্চিত হবে।
জয় হোক প্রকৃত ভালোবাসার।