`পুরুষের সুন্দরী লাগে, তাই আমেনারা ‘এভ্রিল’ হয়’

॥ মো: আকতার হোছাইন কুতুবী ॥

প্রসঙ্গ বিশ্ব সুন্দরী উলঙ্গ হয় লক্ষ নারী হায়রে সংস্কৃতি এই দুনিয়াটা আসলেই আজব কারখানা। একজন বিশ্ব সুন্দরী নির্বাচিত করার জন্য উলঙ্গ হতে হয় লক্ষ লক্ষ নারীকে। তেমনি আমাদের স্বাধীন সার্বভৌমত্ব দেশ, যে দেশটিতে সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলায় ভরপুর সেই দেশের সুদর্শন নারীরাও অংশগ্রহণ করে বিশ্ব সুন্দরী নির্বাচিত হওয়ার জন্য তাতে আমার কোন আপত্তি নেই, থাকার কথাও না। আমি নিজেও সংস্কৃতিমনা একজন রোমান্টিক চিন্তুক। সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দিই অনেকটা বেশি। কারণ টুকটাক লেখালেখির অভ্যাসও আছে। আগে বলতে ভালবাসতাম, পড়তেও ভালবাসতাম বিখ্যাত সাহিত্যিকদের লেখা। এখন কেমন জানি কিছু সত্য কথা লিখতে মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠে। তবে এই নয় যে, যে মায়ের গর্ভ থেকে আমরা জন্ম নিয়েছি সে নারী জাতিকে অশ্রদ্ধা, অসম্মান ও কটু দৃষ্টিতে এ জাতি সমাজ দেখবে। আমরা একটা স্বকীয়তার মাঝে বেড়ে উঠেছি। সবাই চাই ধাপে ধাপে নিজের মেধা, সৌন্দর্য ও যোগ্যতাকে কাজে লাগানোর জন্য। কেউ সফল হয়, আবার কেউ পিছিয়ে পড়ে সবকিছু থাকার পরও। নিন্দুকরা সেটাকে ভিন্নভাবে দাঁড় করানোর জন্য বলে থাকেন নিজের দেহকে বিলিয়ে দিয়ে অনেকেই উচ্চাসনে আসীন হওয়ার জন্য। আমি সেটাতে কিছুটা দ্বিমত পোষণ করি। নিজের দেহকে মানুষরূপীকিছু বাঘ, ভাল্লুক, কুকুর, বিড়ালকে বিলিয়ে দেবে তা তো মেনে নেয়া যায় না। সভ্য সমাজে অসভ্যদের রং তামাশা দেখলে শরীরটা কেমন জানি শিউরে উঠে। অনায়াসে উপরে উঠার সিঁড়িকে টপকিয়ে মুকুট পড়ার জন্য অনেকেই আবার তার সবকিছু বিলিয়ে দিচ্ছে ওই মানুষরূপী হায়েনাদেরকে। পুরুষ শাসিত এই সমাজে অনেক পুরুষই আছেন এভ্রিলের মতো নামধারী সুন্দরীদের পুজারী।
গুগল সূত্রে দেখলাম সংস্কৃতির কতটা নৈতিক অধঃপতন হলে, শুধুমাত্র অন্তর্বাস পরে সমগ্র পৃথিবীর ৬শ কোটি মানুষের সামনে উলঙ্গ হতে এদেশের ২৫ হাজার তরুণী রেজিস্ট্রেশন করে ! এই ২৫ হাজার মেয়ে ও তাদের ফ্যামিলি চান, তাদের মেয়ে বাংলাদেশ থেকে বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করুক! তাদের মেয়ে পণ্যদাসী হিসেবে বিক্রীত হোক। সংক্ষিপ্ত রাস্তা ধরে খ্যাতি আর অর্থ উপার্জন করার জন্য কর্পোরেট যৌন দাসী হোক ! বাংলাদেশে এদের লাইফস্টাইল, পার্টি, বিয়ে, ডিভোর্স, বিলাসী জীবন আর সবশেষে বেশিরভাগেরই আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হওয়া দেখেও কোটি মেয়ের লালিত স্বপ্ন এখন মিডিয়ার রঙ্গমঞ্চে নিজেকে অন্যের বিনোদনের খোরাক বানানো ! ৮ কোটি বাঙালি নারী আর ২৫ হাজার আগ্রহী প্রার্থী থেকে বাছাই করে জান্নাতুল নাইম এভ্রিল নামের এই মেয়েকে বিজয়ী বানিয়ে পাঠানো হচ্ছিল বাংলাদেশের পতাকা বিশ্বের দরবারে বহন করার জন্য !! এই মেয়ের তো গুণের সীমা পরিসীমা নাই ! – মিসেস হয়ে অংশ নিয়েছে মিস বাংলাদেশ হবার জন্য – দরিদ্র বাবা মা কিংবা এই কৃষক পরিবারের সাথে কোন সম্পর্ক রাখেনি গত ৩/৪ বছর। বিভিন্ন ভাবে প্রচুর টাকার মালিক হলেও পরিবারের খবর নেয়নি। ওর বাবা জানিয়েছেন, এই মেয়ের সাথে সম্পর্ক রাখেননি এবং ভবিষ্যতেও রাখবেন না। তাকে মেয়ে হিসাবে স্বীকার করেন না। – মিস বাংলাদেশ প্রতিযোগিতায় ফর্ম পূরণ করেছে নিজের পরিচয় লুকিয়ে। বাবা সিঙ্গাপুরে থাকেন, ঢাকায় বাড়ি গাড়ির মালিক আর ভাই বড় ব্যবসায়ী এই মিথ্যা তথ্য দিয়ে। – ম্যাট্রিকের পর সৎ কাপড়ের ব্যবসায়ীকে বিয়ে করলেও উচ্চাকাক্সক্ষী এভ্রিল সংসার করেছে মাত্র আড়াই মাস। নিজেই বাবার বাড়ি যাবার নাম করে পালিয়ে গিয়েছিল। তারপর একটা ১৭/১৮ বছর বয়সী মেয়ে স্বামীকে চাপ প্রয়োগ করে নিজেই ডিভোর্স নিয়েছে। এই ৩/৪ বছর ঢাকায় বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে মিডিয়াতে প্রতিষ্ঠিত হবার জন্যই এতসব চেষ্টা। পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী বিয়ের আগে পরে বহু অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়েছে স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য। ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের সাক্ষ্য অনুযায়ী চট্টগ্রামের একটা হোটেল রেইডে অনৈতিক কাজে গ্রেফতার হয়েছিল। জানাজানি হবার পর সাংবাদিকরা বিয়ের গুজব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে এভ্রিল বলেন, সব মিথ্যা, বিয়ে হয়নি। এদিকে বিয়ের ছবি, ভিডিও আর কাবিননামা সব পত্রিকায় ভাইরাল। একজন মিথ্যাবাদী, প্রতারক, উচ্চাভিলাষী, অল্প শিক্ষিত আর চরিত্রহীন মেয়ে হল কিনা বাংলাদেশের সেরা মেয়ে !! আর তাকে নির্বাচিত করল কিনা দেশের বিখ্যাত সব কর্পোরেট হাউজ আর বাছাই করা সেলিব্রেটি বিচারকরা! এই মিস বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা আসলেই কি বাংলাদেশের সংস্কৃতি, আচার আচরণ আর শিল্পকে প্রতিনিধিত্ব করে? পত্রিকায় ছাপা হওয়া পোশাকে বাংলাদেশের কোন ছাপ নেই, অনেক খোলামেলা, উন্মুক্ত শরীরের প্রদর্শনী। ফাইনালের ফলাফলেও উল্টাপাল্টা ঘোষণা করে অনেক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে আয়োজক অন্তর শো বিজ আর অমিকন এন্টারটেইনমেন্ট। মনে হয়েছে এভ্রিলকে বিজয়ী করার জন্যই যেন সব ওলট-পালট করা হয়েছে। বিচারক শম্পা রেজা বলেছেন, বিচারকদের ফল উলটে দেয়া হয়েছে। আয়োজকরা ৩ মাস সময় পেয়েও বাছাই করা মেয়েদের ব্যাকগ্রাউন্ড ভেরিফাই করতে পারেননি এটা অবিশ্বাস্য। এই প্রতিযোগিতা তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। পুরো প্রোগ্রামটাকেই বাতিল ঘোষণা করা উচিত। এগুলো নারীকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করার হাতিয়ার মাত্র। এই ২৫ হাজার মেয়ের ফ্যামিলি চান তাদের মেয়ে শর্টকাট রাস্তা ধরে নিজেকে বিসর্জন দিয়ে হলেও একবার মুকুটটা পড়ুক, আর ভোগের বাজারে ডিমান্ডটা আরও বাড়ুক ! এরা কেউই চায় না, – মেধা কাজে লাগিয়ে শিক্ষিত হবে আর পরিশ্রম করে নিজ পায়ে দাঁড়াবে। – নিজের একটা সৎ ব্যক্তিত্ব আর পরিচয় গড়ে তুলবে। পরিবার, সমাজ আর দেশকে ভাল কিছু দেয়ার চেষ্টা করবে। সবার ফোকাস – খ্যাতি, বিত্ত, বৈভব, ক্যামেরা, লাইট… একশন!! যেভাবে আর যে পথেই আসুক না কেন!! পরিশেষে একটি কথা বলতে চাই মা বাবার অবহেলা আর বিদেশী চ্যানেলের দৌরাত্ম্যের কারনে আজ কিছু তরুণ সমাজ অধপতনের পথে… ফলশ্রুতিতে, রাস্তা ও নালা-নর্দমায় পাওয়া যায় পলিথিনে মোড়ানো পরিচয়হীন নবজাতক শিশু! আমরা কেউ কি পারি না, এসব অন্যায় কাজকে কে অন্যায় বলতে? বিদেশী নোংরা সংস্কৃতির আগ্রাসনকে বন্ধ করতে?? আসুন, আবার ফিরে যাই আমাদের চিরায়ত বাংলামাতৃকার সামাজিক ঐতিহ্যে, মিশে যাই প্রাণের বাঙালির পারিবারিক সংস্কৃতির লালিত অতীতে !! আমরা কী ওরা? আমরাতো আমরাই !
জাগো নিজউ ২৪ ডট.কম সূত্রে দেখলাম পুরুষদের সুন্দরী লাগে, তাই আমেনারা ‘এভ্রিল’ হয়। ‘৩৬-২৪-৩৬’ এটিই তোমার পরিচয়। এই মাপের বাইরে চুল পরিমাণ গেলেই তুমি সুন্দরী নও। তোমার সুন্দর একটা মন থাকতে পারে, তাতে পুরুষের মন গলবে না। বুকের মাপ ৩৬ ইঞ্চি হলেই তোমাতে সৌন্দর্যের আয়না মেলে ধরবে পুরুষ। তোমার কোমর ২৪ ইঞ্চি হলেই তুমি কেবল আবেদন রাখতে পার। পশ্চাৎদেশের বেড় ৩৬ ইঞ্চির বেশি হলেই নারী তুমি পুরুষের কাছে অযোগ্য।
সুন্দরী প্রতিযোগিতা নিয়ে ওঠা সাম্প্রতিক বিতর্ক প্রসঙ্গে কথা হচ্ছিল নারীবাদী লেখক, কলামিস্ট জব্বার হোসেনের সঙ্গে। একটি বিশেষ মানদ-ে এমন সুন্দরী প্রতিযোগিতার বিরোধিতা করেন জব্বার হোসেন।
এভ্রিল ঝড়ে কাঁপছে মিডিয়াপাড়া। এভ্রিল খবরে অস্থির সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোও। যেন এভ্রিলের রূপে দুনিয়ার সব নারীর রূপই উবে গেছে। আবার এভ্রিল কান্নায় রোহিঙ্গা কান্নাও যেন চাপা পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। নানা বিতর্ক সৃষ্টির মধ্য দিয়ে ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে ‘অন্তর শোবিজ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। চূড়ান্ত ফলাফলে বিচারকদের উপেক্ষা করে জান্নাতুল নাঈম এভ্রিলের নাম ঘোষণা করে ব্যাপক সমালোচনায় পড়ে প্রতিষ্ঠানটি। এমন সমালোচনায় ঘি ঢালে যখন এভ্রিলের বিয়ের কথা ফাঁস হয়ে যায়। আত্মপক্ষ সমর্থন করে এভ্রিলও ফেসবুক লাইভে এসে কান্না করেন। বাল্যবিয়ের বিপক্ষে অবস্থান নেন তিনি। ‘অনেকে বলেছে, আমার বিয়ে হয়েছে, কেন আমি এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছি? এটা একটা প্রতারণা। কিন্তু আমি মনে করি না, আমার বিয়ে হয়েছে। যেখানে আমি একটা দিনও ছিলাম না। তখন আমি অনেক ছোট ছিলাম’- বিয়ে নিয়ে প্রতারণার বিপক্ষে এমন মন্তব্য এভ্রিলের। তবে তার (এভ্রিল) আত্মপক্ষ সমর্থন নিয়েও আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে নানা মহলে।
এই ‘প্রতারণার ফাঁদ’ কি এভ্রিলের একার গড়া-এমনটি মনে করেন না রাজনীতিক ও নারীনেত্রী আমেনা কোহিনুর। তিনি বলেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ফাঁদে পড়া আর দশজন নারীর মতোই একজন এভ্রিল। তবে এভ্রিলও তার প্রতারণার দায় এড়াতে পারেন না।
তিনি মনে করেন, বাল্যকালে যদি এভ্রিল বিয়ে করে থাকেন, তাহলে সেটাও পুরুষের (তার বাবা) মতে হয়েছে। আমেনার নাম যদি জান্নাতুল নাঈম এভ্রিল হয়, তবে সেটাও পুরুষের চাহিদার কারণে। আবার বিচারকদের মতামত উপেক্ষা করে এভ্রিলকে চ্যাম্পিয়ন করা হয়েছে, সেই পুরুষের ইচ্ছাতেই। আমার মনে হয় না, এভ্রিলকে এভাবে চ্যাম্পিয়ন করার ক্ষেত্রে কোনো নারীর হাত আছে!
এই নারীনেত্রী সুন্দরী প্রতিযোগিতার বিরোধিতা করে বলেন, ‘পুরুষের সুন্দরী লাগে। আর এমন সুন্দরী হয়ে উঠতে পুরুষের পাতা ফাঁদেই নারীরা পা দেয়। এভ্রিল যদি প্রতারণা করে থাকেন সেটাও কোনো না কোনো পুরুষের প্ররোচনাতেই।’
নারীবাদী লেখক জব্বার হোসেন বলেন, এমন একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা, যেটা সমাজের দৈন্যতাই প্রকাশ করে। নারীর যে কোনো স্বাধীনতা নেই, তারই প্রমাণ মেলে এসব প্রতিযোগিতায়। সুন্দর পুরুষ নির্বাচনে এমন কোনো আয়োজন নারীরা করে বলে আমার জানা নেই।
‘নারী কতটুকু পোশাক পরবে আর কতটুকু খুলবে, তা সম্পূর্ণ পুরুষের ইচ্ছাতেই হয়। আর বোকা নারীরা পুরুষের এসব লালসার শিকার হন।’
তিনি বলেন, একজন নারীর কুমারিত্বই (ভার্জিনিটি) এখন সৌন্দর্যের বা সম্মানের মাপকাঠি। রূপ প্রকাশের একমাত্র কারণ যেন অবিবাহিত থাকা। বিবাহিত হলে তার আর রূপ থাকে না, তাই প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়াও তার জন্য পাপ হয়ে দাঁড়ায়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে একজন নারীকে কখনই মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। এ কারণেই সুন্দরী প্রতিযোগিতায় আমেনারা এভ্রিল হয়ে ওঠে।