– শাহজাহান চৌধুরী

দেখতে দেখতে আরো একটি বছর চলে গেল আমার জীবন থেকে। ৬৮ বছরে পা দিয়েছি আমি। মানে ধীরে ধীরে কবরের নিকটস্থ হচ্ছি। সেকথা আমাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে আমার অনুরাগী রাজনৈতিক সতীর্থরাই। যেন জন্মদিনের পুস্পাঞ্জলির অন্তরালে মৃত্যুর নিকটবর্তী হওয়ার বার্তা! সবাইকে একদিন সেখানেই চলে যেতে হবে। যদিও পৃথিবীটা খুব সুন্দর। তাকে ফেলে চলে যেতে ইচ্ছে করেনা মোটেও। সকলেই চায় পৃথিবীতে দীর্ঘ সময় সুখে-শান্তিতে বাঁচতে। কিন্তু আমরা কি ভাল আছি? আমাদের নতুন প্রজন্ম কি ভাল আছে? তাদের ভবিষ্যত হবে কেমন? এসব ভাবনার মাঝে আমার ফেলে আসা দিনগুলোকে মনে হয় অনেক মধুর। কিন্তু আমি যখন আমার উখিয়া-টেকনাফসহ কক্সবাজারের ভবিষ্যত প্রজন্মকে নিয়ে ভাবি, তখন সত্যিই আমার চোখে-মুখে আসে ঘোর অমানিশা। আসে দম বন্ধ হয়ে। চোখ বুঝলেই মনে হয় প্রতিবেশী দেশ থেকে বিষধর কিছু সাপ এসে আমাদের তরুণ প্রজন্মকে বিষাক্ত ছোবলে নিথর এক লাশে পরিণত করছে। এভাবে লাশের পর লাশের উপর দিয়ে বিষাক্ত সর্পগুলো এগিয়ে যাচ্ছে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্তপ্রান্তে। দেশের তরুণ সমাজকে ধ্বংস করে দিতে। এই বিষধর সাপকে থামানো না গেলে দেশের সর্বশেষ যুবকটিও রেহাই পাবে না। এরপর মরা লাশের উপর শকুনের আনাগোনা শুরু হবে!
হ্যাঁ, ভাবছিলাম ইয়াবা নিয়ে। ইয়াবা উখিয়া-টেকনাফবাসী তথা কক্সবাজারবাসীর কপালে নতুন এক কলংক তিলকের নাম। এ কলংক তিলক ছিলনা মাত্র গত ১০ বছর আগেও। এর জন্য দায়ী কে? বিবেচনা জনগণই করবে। তবে মাত্র এক দশকে দেশব্যাপী এর বিস্তার এত দ্রুতই ঘটেছে যে, তা অভাবনীয়। ঘরে ঘরে ইয়াবার ছোবলে এখন দিশেহারা সমাজকর্তা-গৃহকর্তা। শক্তিশালী শত্রু যেন আমাদের ঘরে ঢুকে পড়েছে! যেন যুদ্ধকালীন সময়ে ধ্বংসযঞ্জের শেষ পর্যায়ের পরিস্থিতি! এটা কি যুদ্ধ পরিস্থিতি? কোন প্রক্সিওয়ার?
অবশ্যই, যুদ্ধইতো। তবে যুদ্ধে দুপক্ষইতো মরে! কিন্তু আমরা একতরফা মরছি কেন? আমাদের সামর্থ্য কি এতই সীমিত? এই যুদ্ধে কি আমরা হেরেই যাব? ভাবনায় আরো অস্থির হয়ে ওঠে আমার মন। লক্ষ প্রাণের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীনতা আমরা এভাবে ইয়াবার হাতেই তুলে দেব? সীমান্তে ইয়াবা ঠেকাতে আমরা ব্যর্থ কেন? কী আমাদের দূর্বলতা? কীভাবে ইয়াবা অনুপ্রবেশ রোধ করা যায়? ইতোমধ্যে এ বিষয়ে অনেকেই অনেক ধরনের প্রস্তাব দিয়েছেন। কেউ বলেছেন, জাতীয় রাজস্ব রোর্ডের মাধ্যমে সন্দেহভাজন ইয়াবা কারবারীদের সম্পদের খোঁজ নিয়ে তা জব্দ করার কথা। কেউ বলছেন, আরো কঠোর আইন করে তা প্রনয়নের কথা। কিন্তু সরকার এ পর্যন্ত লোক দেখানো ছাড়া কোন কার্যকর পদক্ষেপই নেয়নি। এ কারণে ইয়াবা নিয়ে অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে আমার মনও। উত্তরে আমার মনের অবয়বে ভেসে ওঠছে কিছু লোভী ও বিশ্বাসঘাতক মানুষের মুখচ্ছবি, যেসব মোনাফেক মানুষ সামান্য লাভের জন্য আমার এ সোনারবাংলাকে মৃত রক্তপিন্ডে পরিণত করার পথে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। অবশ্য সময়ও তাদের অনুকূলে। কি দু:সহ পরিস্থিতি! ভাবাই যায় না। জন্মদিনে আরো বিষন্ন হয়ে ওঠে আমার মন।
তবে জাতিকে যদি আমরা আলোর পথ দেখাতে না পারি তাহলে রাজনীতি করছি কেন? দায় আমারও কম নয়। দেশপ্রেমের শর্তে এ দায় কারো এড়ানো সম্ভব নয়। এই দায় থেকেই আমি সীমান্তে ইয়াবা ঠেকাতে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীকে দায়িত্ব দেওয়ার আহবান জানাচ্ছি। তারা দেশের নিরাপত্তা বাহিনী। তারা দল নিরপেক্ষ ও বহি:শত্রুর আক্রমণ ঠেকানোর প্রধান প্রশিক্ষিত বাহিনী। দেশের এমন দূর্যোগ মুহুর্তে তাদের কাজে না লাগিয়ে দেশের সর্বনাশ ডেকে আনবেন না। ইয়াবা ঠেকানোর দায়িত্ব যদি তাদেরই হাতে দেয়া হয়, তাহলে সাধারণ আম জনতাও সাহস নিয়ে নিরাপত্তাবাহিনীকে সহযোগিতা করবে। আমরা যদি এ বিষয়ে এখনই প্রতিবাদমুখর না হই, তাহলে একদিন হয়ত আমাদের সকলের ঘরেও হানা দেবে এই বিষাক্ত সর্পগুলো। তাই আসুন ইয়াবার বিরুদ্ধে আমরা সকলেই সোচ্চার হই।
লেখক : উখিয়া-টেকনাফের সাবেক এমপি ও কক্সবাজার জেলা বিএনপির সভাপতি