সিরাজী এম আর মোস্তাক

বাজেটে দেশের আয়-ব্যয়ের সকল বৈধ খাত দেখানো হয়। ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বাজেটে একটি অবৈধ খাতকে বৈধ দেখিয়ে ৩৯৮৬ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ খাত বাঙ্গালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাজেটে ছিলনা। তাই এতে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে দেশে বৈষম্য ও বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে। কোটি কোটি মানুষ বঞ্চণার শিকার হয়েছে। কারো এসেছে পৌষমাস আর বেশিরভাগের সর্বনাশ। বাংলাদেশের গৃহপালিত বিরোধীদলের সদস্যগণ এ বিষয়ে নিরব। তাদের লক্ষ্য, ‘সরকারি মাল দরিয়া মে ঢাল, তাতে কার কি বাল’।
অবৈধ এ খাতটির নাম- মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। এতে শুধু দুই লাখ তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা ও বিবিধ সুবিধা দেয়া হয়। বলা হয়, এ মুক্তিযোদ্ধাগণই দেশ স্বাধীন করেছেন। তারা লড়াই না করলে দেশ স্বাধীন হতোনা। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বরূপ এ বরাদ্দ অতি সামান্য। তাদের সন্তান-সন্ততি ও নাতি-নাতনিদেরও এতে অধিকার রয়েছে। তাই দেশের সকল চাকুরি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তিতে তাদের ৩০ভাগ কোটাসুবিধা দেয়া হয়েছে। ১৯৭৫ সাল থেকে এযাবতকালে ত্রিশভাগ মুক্তিযোদ্ধা কোটা পালনে যেটুকু ঘাটতি হয়েছিল, তাও পূরণ করা হয়েছে। যেমন ধরুন, ১৯৭৫ সাল থেকে কোনো প্রতিষ্ঠানে এযাবত ৫০০ জন নিয়োগ হয়েছে। তাতে ত্রিশভাগ মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ১৫০ জন নিয়োগের কথা। বিভিন্ন সরকারের গাফলতি বা বিশেষ কারণে কোটাপদে হয়তো ১০০ জন নিয়োগ পেয়েছে। অর্থাৎ ৫০টি পদে নিয়মভঙ্গ হয়েছে। বর্তমানে উক্ত প্রতিষ্ঠানে ৭০টি পদ খালি হয়েছে। এর ত্রিশভাগ কোটায় ২১টি এবং অতীতে নিয়মভঙ্গের ৫০টি পদ গুরুত্বসহ বের করে বর্তমান পুরো নিয়োগ শুধু মুক্তিযোদ্ধা কোটাতেই হয়েছে। কয়েকবছর যাবত এভাবেই চলছে। বিসিএস, ব্যাংক-বীমা, সরকারি-বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তিতে শুধু মুক্তিযোদ্ধা কোটা পরিপালন হয়েছে। ফলে দেশে এখন মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহির্ভূত ২৬ লাখ উচ্চশিক্ষিত বেকার চরম যন্ত্রণা পোহাচ্ছে। এ যন্ত্রণা না বুঝে শুধু দুই লাখ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে ভাতা দেয়ার জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা বাজেট-বরাদ্দ দেয়া কতোটা অবৈধ, তা স্পষ্ট। এতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে জনগণ শ্রদ্ধাশীল নাকি বিতৃঞ্চ হয়েছে, তা নির্বাচনে বোঝা যাবে।
অবৈধ খাতটিতে বরাদ্দের ফলে মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ বিসর্জনকারী ত্রিশ লাখ বীর শহীদের বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ত্রিশ লাখ শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন নাকি রাজাকার ছিলেন, তাতে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। শহীদগণ মুক্তিযোদ্ধা হলে, বর্তমান দুই লাখ মুক্তিযোদ্ধা তালিকা কোনোভাবেই বৈধ নয়। কারণ, পৃথিবীর কোথাও ত্রিশ লাখ শহীদের বিপরীতে মাত্র দুই লাখ যোদ্ধার নজির নেই। শহীদদের যোদ্ধা তালিকা থেকে বাদ দেয়ার প্রমাণও নেই। বঙ্গবন্ধু এ সত্য অনুধাবন করেই ত্রিশ লাখ শহীদ ও দুই লাখ সম্ভ্রমহারা মা-বোনের সংখ্যাটি সুনির্দিষ্ট করেছেন। সাতজন শহীদকে সর্বোচ্চ তথা বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব দিয়ে ৬৭৬ জন মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত করেছেন। জাতিকে শিক্ষা দিয়েছেন যে, ৬৭৬ যোদ্ধার মধ্যে যেমন মাত্র সাতজন শহীদ রয়েছেন; তেমনি ত্রিশ লাখ শহীদের তুলনায় অনেক বেশি মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। সাতজন শহীদ যেমন বীরশ্রেষ্ঠ, তেমনি ত্রিশ লাখ শহীদই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। এদেরকে বাদ দিয়ে শুধু দুই লাখ মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত করা এবং তাদের জন্য বাজেট-বরাদ্দ দেয়া সম্পুর্ণ অবৈধ।
যে সকল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বাজেট-বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চার নেতা, মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ বিসর্জনকারী লাখো বীর শহীদ, আত্মত্যাগী, বন্দী, শরণার্থী ও সাধারণ যোদ্ধাদের নাম বা তালিকা নেই। অর্থাৎ এ সকল তালিকা বহির্ভূতগণ মুক্তিযোদ্ধা নন। মুক্তিযুদ্ধে তাদের কোনো ভূমিকা নেই। তাদের সন্তানেরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান নয়। তাই বাংলাদেশে ত্রিশ লাখ শহীদের বংশ ও পরিবারের অস্তিত্ব নেই। অথচ বঙ্গবন্ধুর সময়ে দেশে মুক্তিযোদ্ধা-অমুক্তিযোদ্ধা-শহীদ বিভাজন ছিলনা। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভাতা ও কোটাসুবিধা ছিলনা। বঙ্গবন্ধুর বাজেটে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অস্তিত্ব ছিলনা। তিনি দেশের সবাইকে মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদের পরিবারভুক্ত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর এ মহান আদর্শ অনুসারে, বর্তমান বাজেটে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক খাতটি সম্পুর্ণ অবৈধ।
তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা সমুন্নত রাখতে উচিত, বাজেটের অবৈধ খাতটি বাতিল করা। বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতাসহ শহীদ, বন্দী, আত্মত্যাগী, শরণার্থী, আহত, পঙ্গু ও সাধারণ বীর বাঙ্গালি সবাইকে মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি দেয়া। বাংলাদেশের ১৬কোটি নাগরিককে তাদের প্রজন্ম ঘোষণা করা।
শিক্ষানবিশ আইনজীবী, ঢাকা।