আবদুর রহমান খান


একদা ভূস্বর্গ বলে পরিচিত রাজ্য কাশ্মীর এখন এক নরক যন্ত্রনার নাম।

ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী ১৯৪৭ সালের আগষ্টে ভারত বিভক্ত করার সময় ৭৭ শতাংশ মুসলিম আর ২২ শতাংশ হিন্দু অধ্যুষিত কাশ্মীরের তৎকালিন মহারাজা হরি সিং স্বায়ত্ব শাসন সহ কতিপয় শর্তে যোগ দিয়েছিল ভারতের সাথে। ভারতীয় সংবিধানে ৩৭০ ধারায় কাশ্মীরের সে অধিকার সংরক্ষিত ছিল। কিন্তু ভারতের ক্ষমতাসীনরা বিশেষ করে উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক সংগঠনগুলি বরাবরই কাশ্মীরকে মনে করে এসেছে একটি মূল্যবান সম্পদ হিসেবে যেটিকে তারা পরিপূর্ণ গ্রাস করার পরিকল্পনা করেছে শুরু থেকেই। এ ক্ষেত্রে নেহেরু থেকে নরেন্দ্র মোদী পর্যন্ত ভারতের সব সরকারেই কাশ্মীরের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গী ছিল অভিন্ন।

অত:পর ভারতের হিন্দুতববাদী বিজেপি সরকার নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে সংবিধানের সেই ৩৭০ ধারা সংশোধন করে তাদের স্বপ্ণ পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে। এক বছর আগে ১৯১৯ সালের ৫ আগষ্ট ভারতীয় পার্লামেন্টে সংবিধান সংশেধন করার আগেই বিপুল সংখ্যক সেনা পাঠিয়ে, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে জেলে পুরে আর জরুরী অবস্থা জারি করে কাশ্মিরকে পরিপূর্ণভাবে দখলে নিয়ে নেয়া হয়। এরপর কাশ্মীরকে দু’টি অঞ্চলে ভাগ করে কেন্দ্রীয় শাসনের আধীনে নিয়ে আসা হয়।

ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে কাশ্মীরীদের রয়েছে গৌরবময় ইতিহাস। তারা তাদের স্বাধীনতার জন্য বরাবরই লড়াই করে এসেছে। এখনো চলমান কাশ্মীরীদের সে লড়াই । কাশ্মীরীদের প্রতিরোধ সংগ্রাম মোকাবেলায় ভারত সরকার চরম নির্যাতন আর দমন অভিযান পরিচালনা করছে । কারফিউ, ঘেরাও করে বাড়ী বাড়ী তল্লাসী, সন্দেহভাজনদের বিশেষ করে যুবকদের বেছে বেছে হত্যা, নারীদের ওপর নির্যাতন- এসব এখন কাশ্মীরের দিনলিপি।

ভারত সরকার কাশ্মীরকে দখলে নেবার পর এখন সেখানে ইসরায়েলের প্যালেষ্টাইন দখলের কৌশল নিয়ে এগুচ্ছে। এর আগে কাশমীরের জমি-সম্পত্তি ক্রয়, চাকুরি, খনিজ আহরণ- এসবের ওপর সম্পূর্ণ অধিকার ছিল কাশ্মীরীদের। এখন তা উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে ভারতীয়দের জন্য। কাশ্মীরে অভিবাসন আইনের সংশোধন এনে সেখানে জমি-সম্পত্তি ক্রয় করে স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য ভরতের অন্য রাজ্য থেকে আগত সরকারী কর্মকর্তা ও সেনাসদস্যদের আইনগত অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে এরকম কয়েক হাজার অভিবাসন অনুমোদন দিয়েছে সরকার।

আরো নগ্নভাবে, একদা ব্রিটিশ সরকার যেমনটি করেছে, কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামী ব্যক্তি বা কথিত জঙ্গী যুবকদের পরিবারগুলি চিহ্নিত করে তাদের সকল সম্পত্তি দখলে নেবার উদ্যোগ নিয়েছে ভারত সরকার। এ লক্ষ্যে ৪৪ সেনা কর্মকর্তা নিয়ে একটি টাস্ক ফোর্সও গঠন করা হয়েছে।

ওদিক ক্যান্টনমেন্টের বাইরে সেনাদের দখলে থাকা বিপুল পরিমান জমি আইন করে তাদেরকে স্থায়ীভাবে ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়েছে। সেখানে সেনারা তাদের ঘর-বাড়ী বা স্থায়ী অবকাঠামো নির্মান করতে পারবে। এর আগে ২০১৬ সালে কাশ্মীরের তৎকালীন চীফ মিনিষ্টার মেহবুবা মুফতি রাজ্যের আইন সভায় জানিয়েছিলেন যে, ভারতের সেনাবাহীনী জম্মুতে ৫১,১১৬ কানাল সরকারী জমি এবং কাশ্মীর ও লাদাখে ৩৭৯, ৮১৭ কানাল সরকারী জমি বেআইনী ভাবে দখল করে রেখেছে । কাশ্মীরে জমির মাপ – এক কানালে ৫১০ বর্গ মিটার অথবা এক একরের আট ভাগের একভাগ জমি।

সম্প্রতি ভূমি বিষয় আইন – ডেভলপমেন্ট এ্যক্ট ১৯৭০ এবং কন্ট্রেআল আব বিল্ডিং অপারেশনস এ্যাকট ১৯৮৮ সংশোধন করে এবার এসব জমির ওপর সেনাবাহিনীর আইনগত অধিকার, পাকা স্থাপনা নিমানের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। এ নিয়ৈ স্থানীয়দের কোন মতামত দেবার আর সুযোগ থাকল না।

অপরদিকে চীনের সাথে সাম্প্রতিক সীমান্ত সংঘাতের প্রেক্ষাপটে জরুরী অবস্থার নামে যুদ্ধের কৌশলগত কারন দেখিয়ে যে কোন স্থানে ভূমি দখল করার সূযোগ করে দেয়া হয়েছে সেনাবাহীনিকে। নির্মান করা হচ্ছে গণ-বাংকার।

কাশ্মীরে দখলদারিত্ব নির্বিঘ্ন করতে বন্দুকের নিশানা বানানো হয়েছে কাশ্মীরের প্রতিবাদী যুবকদের, ঠিক যেভাবে ইসরাইলিরা করছে প্যালেষ্টাইনে। বৃহৎ গনতন্ত্রে দাবীদার ভারতে কাশ্মীরীদের নেই কোন নাগরিক অধিকার, ঈদ বা জুম্মার নামাজে জমায়েত হতে পারেন না মুসলিশ অধ্যুষিত রাজ্যের মানুষেরা। রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ তো দূরে থাক , স্বাধীনভাবে চলাচল করতে পারছেন না কাশ্মীরের মানুষ। রাজনৈতিক লক-ডাউনের সাথে জুড়েছে কোভিড-১৯ জনিত লক-ডাইন। জরুরী ওষুদ, চিকিৎসাসেবা, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষপত্রের সংকট। ইন্টারনে টেলিফোন সেবা ব্যহত। আইন করে গনমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রনে রেখে বন্দী করা হচ্ছে সাংবাদিকদের। দীঘদিন কারাগারে বা গৃহবন্দী রাখা হচ্ছে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে।

এরকম একটা শ্বাসরূদ্ধকর অবস্থার কথা উল্লেখ করে ভারতের সাবেক অর্থমন্ত্রী এবং বর্তমানে রাজ্যসভার সদস্য পি চিদাম্বরম রবিবার ( ০২ আগষ্ট) ইন্ডিয়ান একপ্রেস পত্রিকায় প্রকাশিত একটা নিবন্ধে বলেছেন, কাশ্মীরে সকল মৌলিক অধিকার স্থগিত, জন নিরাপত্তা আইনের যথেচ্ছা প্রয়োগ, ঘেরাও-তল্লাসী নিত্যদিনের বিপদ, গণমাধমের স্বাধীণতা লুন্ঠিত। এমন পরিস্থিতিকে একজন রাজনৈতিক নেতা বলেছেন জম্মু-কাশ্মীর হচ্ছে এখন একটা বিশাল জেলখানা।

পি চিদাম্বরম উল্লেখ করেছেন, ভারত সরকারের জম্মু-কাশ্মীর নীতিটাই ছিল –রাজ্যটিকে ভেঙ্গে ফেলা, এর মার্যাদা ক্ষুন্ন করে কেদ্রের শাসন চাপিয়ে দেওয়া, রাজনৈতিক অধিকার হরণ করা, সাড়ে সাত কোটি মানুষকে ভয় দেখিয়ে পদদলিত করে রাখা এবং স্বাধীনতাকামী জঙ্গিদের নির্মুল করা।

নিবন্ধের উপসংহারে ভারতীয় এ রাজনীতিবিদ বলেছেন, ২০১৯ সালের ৫ আগষ্ট কাশ্মীরে যে সংকটের সৃষ্টি করা হয়ছে সে ব্যাপারে দেশের পার্লামেন্ট, বিচার বিভাগ বা বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা এখনো কোন সমাধান দিতে পারে নি। ভারতবাসীদের জন্য এটা একটি করুন ব্যর্থতা।


লেখক আন্তর্জাতিক গনমাধ্য্যধ্যমের সাথে যুক্ত ঢাকাভিত্তিক সিনিয়র সাংবাদিক, কমনওয়েলথ জার্নালিষ্ট এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের ভাইস-প্রেসিডেন্ট, ই-মেল arkhanpress@gmail.com