– তানভিরুল মিরাজ রিপন :
সড়ক দুর্ঘটনা বাংলাদেশে মহা-ব্যাধি হয়ে দাড়িয়েছে।দিন দিন অসংখ্য সড়ক দুর্ঘটনা হচ্ছে। মানুষের আবেগ ও আফসোস অনুভূতি হয়ে দাড়িয়েছে শূন্য। সুতরাং মানুষকে যে ঘটনা প্রতিমুহূর্তে নাড়া দিবে না সেসব ঘটনাগুলো কাগজ-পত্রিকার মুখ্য খবর হয়ে প্রকাশিত হয় না,মানুষকে মোটামুটি রকমভাবে চমকে(নাড়া) দেয় দুর্ঘটনার মৃতর সংখ্যা। অতিগুরুত্বপূর্ন কোন ব্যক্তি-বিশেষ না হলে সেটির মূল্যায়নও খুব একটা মানুষের কাছেও পায় না। অথচ, এই সড়ক দুর্ঘটনার সুনির্দিষ্ট কারন রয়েছে,সেগুলোর সমাধানও আছে। বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতি বছর ২০ হাজার লোক মারা যাচ্ছে, বিকলাঙ্গ হচ্ছে ৩ লাখ।

এটির বাস্তবিক কোনো প্রতিকার,দৃষ্টান্ত মূলক আইনের প্রয়োগ না হওয়ার ফলে এই ব্যাধী মহামারিতে রূপ নিয়েছে। তার ফলে প্রতিবছর ২০ হাজার মানুষের হত্যাকে স্রেফ ‘দুর্ঘটনা’ বলে চালিয়ে দিচ্ছে। সরকারি হিসেবে; পুলিশের রিপোর্টে উল্লেখ্য হিসেব দাড়ায় ৩ থেকে ৪ হাজার জন। পুলিশ দেখে শুধু দুটো বিষয়, দুটো বাহনের সংঘর্ষ, মালিকের বীমা সংক্রান্ত বিসয় জড়িত থাকা বিষয়গুলো। অথচ সারাদেশে মোট নিহতের ৫৪ শতাংশ পথচারী।যেখানে মালিকের বীমা সংক্রান্ত কোন বিষয়ই আসে না৷

বাংলাদেশের সড়ক ব্যবস্থাকে এতো বেশি সচল করে রাখা হয়েছে, যেখানে প্রতিবছর রেল এবং নৌ যানের আধুনিকায়ন ফাঁকা বুলির বাজেট দেওয়া হলেও আদতে এগুলোর কোনো বাস্তবরূপ নাই যুগের পর যুগ।অথচ আমাদের ৫ হাজার কিমি নৌপথ চলাচলের উপযোগী । দীর্ঘ অনিয়ম, অবহেলার ফলে রেল ও নৌ পথের চেয়ে ডুর টু ডুর সড়ক পরিবহন সবার কাছে এখন পছন্দের। অনর্থ মন্ত্রনালয়ের তথ্য মতে শতকরা ৮৮ ভাগ যাত্রী এবং ৮০ ভাগ মালামাল সড়ক পথে পরিবহন করা হয়। অথচ জাতীয় বাজেটের ২০ ভাগই খরচ হয় যোগাযোগব্যবস্থায়।যানজট নিরসনে উঁচু উঁচু ফ্লাইওভার, সড়ক সম্প্রসারনের, দুই লেইন থেকে চার লেইনে রাস্তা করেও কমছে না দুর্ভোগ,বাড়ছে মহামারীর মত সড়ক দুর্ঘটনা । দোষ,দ্বায়,দ্বায়িত্বে কারোরই জবাবদিহিতা নাই। অপরদিকে পথচারীদের পারাপারের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট পয়েন্ট নাই,নেই পর্যাপ্ত সচেতনতা,নেই সিগন্যাল ও কড়া পর্যবেক্ষণ। বিআরটিএর তথ্য বলছে,বাংলাদেশে গাড়ি আছে ২১ লাখ,ড্রাইভার আছে ১৩ লাখ। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ দিয়েছিলেন দূরপাল্লার যানবাহনে দুজন করে ড্রাইভার রাখার জন্য। কর্তৃপক্ষ তা আমলে নেয়নি। কর্তৃপক্ষ ঠিকই ১৫ থেকে লাখ ড্রাইভারের ঘাটতি রেখে দিয়েছে। মাত্র ৩ শতাংশ ক্ষেত্রে ১ জন প্রশিক্ষিত ড্রাইভার হওয়ার সুযোগ পায়। বিপরীতে ৯৬.৬ শতাংশ ড্রাইভার হয় ওস্তাদ মারফতে হেল্পার থেকে একসময় ড্রাইভার হয়ে উঠে। সড়ক পরিবহন আমরা এতোই এগিয়ে নিয়ে এসেছি যে সারাদেশে ২১ লাখ গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষা করেন মাত্র ৪১ জন।

‘ সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের মতে ড্রাইভিং করার জন্য শুধু গরু ছাগল চিনলে হয়! ‘ যেনো বাংলাদেশে সড়ক আইন বলতে কিছু নেয়।যেনো আইনই শিখতে হবে না। অন্যদিকে ড্রাইভারদের নূন্যতম মজুরিও কম, পরিশ্রম করতে হয় ৮-১০ ঘন্টা। যাত্রী পরিবহনে তাই তারা দ্রুত ‘ ট্রিপ ‘ ধরতে প্রতিযোগিতার সৃষ্টি করে, প্রতিযোগিতা করে। তারই ফলে ৫৪ শতাংশ পথচারী গাড়ি চাপায় নিহত হচ্ছে। পণ্যবাহী ট্রাকের ড্রাইভার ‘ উপরি ‘ পাওয়ার আশায় ওভারটেকিং,ওভারলোডিং,ওভারস্পিডিং এখন খুবই স্বাভাবিক। এক গবেষণার তথ্য মতে, প্রতি ঘন্টায় মাত্র ১০ কিমি ওভারস্পিডিংয়ের জন্য দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার ৫ শতাংশ থেকে ৪৫ শতাংশে উঠে দাড়ায়।সুতরাং সড়কে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার কমার একমাত্র কারন প্রশিক্ষিত ড্রাইভার । যোগাযোগ মন্ত্রীর ভাষ্যমতে মাত্র ৩৬ শতাংশ ড্রাইভার ভূয়া লাইসেন্স নিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। অন্যদিকে টিআইবির এক জরিপ বলছে, পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে যেসব পরিবার ঘুষ দিতে বাধ্য হয়েছে তাদের মধ্য ৮০.৭ শতাংশ ঘুষ দিয়েছে হাইওয়ে পুলিশকে। যার গড় পরিমান ৬৩২ টাকা এবং ৮০.৬ শতাংশ ঘুষ দিয়েছে ট্রাফিক পুলিশকে যার গড় পরিমান ৩ হাজার ২৫ টাকা।

অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজার যানবাহনে ৬০ টি দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়,যা একই সংখ্যার যানবাহনে ২৫টি, শ্রীলঙ্কায় ১৬,আমেরিকা ২ জন৷ সৃষ্টিশীল কাজ করার মতো বয়স,অর্থোপার্জনের বয়স ২৫-৪৪ বছরের লোকজন। অথচ বাংলাদেশে ৫৭ শতাংশ দুর্ঘটনায় নিহত হচ্ছে এই বয়সী লোকজন। অন্যদিকে দুর্ঘটনায় মৃত ৫৩ শতাংশই পরিবারের প্রধান উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তারই কারনে তাদের হাত পাততে হয়,বাড়িঘর, জায়গা জমি বিক্রি করে দিতে হয়।

এই দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ কি আদৌ সম্ভব? সম্ভব তখন হবে যখনই ড্রাইভার প্রশিক্ষিত হবে।পর্যাপ্ত পরিমান বাস,ট্রাফিকে আধুনিকায়ন, সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ক সচেতনতা,আইনের প্রয়োগ,জবাবদিহিতা,রেল ও নৌপথের প্রতি জনসাধরনকে আকৃষ্ট করার মাধ্যমেই নিরাপদ জীবন,নিরাপদ সড়ক আমরা পাবো।অন্যথায় এই ব্যাধী প্রতিনিয়তই বিশাল মহামারী আকারে ধারন করবে।

লেখক: টকশো উপস্থাপক