রহিম আব্দুর রহিম

কয়েক বছর আগে, এক শুভাকাঙ্খী আইনজীবির সাথে কথা হয়েছিলো, তিনি তার আইন পেশার অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘ তিনি এক গরু চুরির অপরাধে অভিযুক্ত আসামীর মামলা পরিচালনা করছিলেন। বিচার চলাকালীন এই আসামীর জামিন হয়। জামিনের পর আইনজীবি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, একটি গরু চুরি করলে কত আয় হয়? এই প্রশ্নের জবাবে সে বলেছিলো, ৩শ টাকা। আইনজীবি আশ্চার্য! একটি গরুর মূল্য ৩শ টাকা? উত্তরে তিনি বলেছিলেন; না। থানা পুলিশ থেকে শুরু করে, গ্রামের চকিদার, টাউট- বাটপার, মেম্বার- চেয়ারম্যানদের ভাগ বাটোয়ারা দেওয়ার পর তার ৩শ টাকা থাকে। আইনজীবি তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, তুমি গরু চুরি ছেড়ে দিয়ে অন্য কাজ করে খাও। বিবাদী বলেছিলো, ‘উপায় নাই।’ কোথাও চুরি হলেই থানা পুলিশ আমাকে গ্রেফতার করে। আমি চুরি করি নাই বলে, থানা পুলিশকে চাঁদা দিতে পারি নাই;। চাঁদা দেই নি বলেই আমি আজ গরু চোর হয়েছি, গ্রেফতার হয়েছি, জেল হাজতে ঢুকেছি। যদি চুরি করতাম, চাঁদাও দিতে পারতাম, তবে আর আমাকে হাজতে আসতে হতো না। এখন বুঝন, আমরা কোথায় আছি কিভাবে আছি?

পাঠকদের ধৈর্যচ্যুতি না ঘটিয়ে মুল আলোচনায় যাচ্ছি। দুর্গমপাহাড়ে পণ্য বহনের জন্য ঘোড়ার গাড়ি কিংবা ঘোড়াকে বাহন হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এই ঘোড়া যাতে ক্লান্ত এবং দুর্বল হয়ে না পড়ে এবং ঘোড়ার ৮০ বছরের সকল শক্তি চুষে টেনে বিশ বছরের মধ্যে এনে এই ঘোড়ার কৃত্রিম শক্তি বৃদ্ধির জন্য আবিস্কার ‘ইয়াবা’ নামক মরণ ট্যাবলেট। এই ট্যাবলেট উৎপত্তিস্থল মিয়ানমার। যে ট্যাবলেট এখন বাংলাদেশে গ্রাম-গঞ্জে শহর বন্দরে সহজ প্রাপ্য পণ্য হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে। কৌতুহল যুব সমাজ এই ইয়াবা সেবনে আসক্ত হয়ে অকালে প্রাণ হারাচ্ছে। ফেন্সিডিল নামক তরল মেডিসিনটি সর্দি কাশির সিরাপ হিসাবে ব্যবহৃত হয়। যে সিরাপটি, অতি মাত্রায় সেবন করলেই সেবনকারী মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। আজ থেকে ২০ বছর আগেও এই মরণ নেশা ইয়াবা ট্যাবলেট ছিল না। যার অবাধ উৎপাদন ভারত। বাংলাদেশের পশ্চিম, উত্তর এবং পূর্ব সীমান্ত হয়ে অবাধে ফ্যান্সিডিল চোরাই পথে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। ইয়াবা উৎপাদনকারী দেশ মিয়ানমার সরকার বৈদেশিক ভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ইয়াবা পাচার শুরু করে। ওই দেশের টার্গেট ভারত, বাংলাদেশ এবং থাইল্যান্ড। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের অর্থাৎ সমুদ্র সীমান্ত অরক্ষিত থাকায় ইয়াবা সহজেই বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। ইয়াবার ট্রানজিট পথ বাংলাদেশ ব্যবহার হওয়ায় দেশের নারী-পুরুষ, শিক্ষক, সাংবাদিক, পুলিশ প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গরা অল্প টাকার পুঁজিতে, অতি দ্রুত কোটিপতি হওয়ার লোভে ইয়াবা ফ্যান্সিডিল ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী সারাদেশে ৭৭ লাখ জন-মানুষ মাদকের সাথে জড়িত। এর মধ্যে মাদকের ৫০ হাজার গডফাদার নেপথ্যে কলকাটি নাড়ছে। মদ, আফিম, ভাং, গাঁজা, প্যাথেডিনের মত মাদক পূর্বেও দেশে ছিল। সম্প্রতি ইয়াবা এবং ফ্যান্সিডিলের মত মরণ নেশা, দেশের যুব সমাজে সৌখিন নেশায় পরিণত হয়েছে। সমাজ রাষ্ট্র এই নেশার রাজ্যে তলিয়ে যাওয়ার মুহুর্তে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি র‌্যাবের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে প্রধান অতিথির বক্তব্য প্রদান কালে মাদকের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে যাওয়ার ইঙ্গিত দেন। তাঁর বক্তব্যের পরই গত ৪ মে থেকে র‌্যাব, ১৮ মে থেকে পুলিশ মাদক বিরোধী অভিযানে নামে। গত ১৫ মে থেকে ০৩ জুন পর্যন্ত সারাদেশে প্রায় ১৩০ জন ব্যক্তি মাদক বিরোধী অভিযানে নিহত হয়েছে। গ্রেফতার হয়েছে প্রায় ১৩ হাজার, মামলা হয়েছে ৮ হাজারের মত। এই অভিযানে প্রত্যন্ত অঞ্চলে জনমানুষ অত্যন্ত খুশি। তবে মানবাধিকার কর্মীরা এ ধরনের হত্যা মেনে নিতে পারছে না। কারণ, ‘আত্মপক্ষ সমর্থন পূর্বক লাখ অপরাধী বেঁচে গেলেও যেমন বিচারের ব্যতয় ঘটে না, তেমনি কোন অপরাধী বিনা বিচারে সাঁজা হোক এমনটা মানবতায় সমর্থন করে না, বেঁচে থাকার অধিকার সবারই রয়েছে।’

মাদকবিরোধী শক্ত অবস্থানে শুধু কি বাংলাদেশ সরকারই? না, এর আগেই ১৯৭১ সালের ১৮ জুন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে মাদক বিরোধী যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। ওই ঘোষনায় তৎকালীন মাদক নির্ভর কলম্বিয়া, ব্রাজিল, মার্কিন সীমান্তবর্তী মেক্সিকোসহ পুরোদক্ষিণ- আমেরিকায় মাদকাসক্ত ৪ লাখ জন মানুষ প্রাণ হারায়। এর মধ্যে কলম্বিয়ায় মারা যায় প্রায় ৬০ হাজার মাদাকসক্ত। মাদকের ভয়াবহ ছোবল যখন ফিলিপিন্স ও থাইল্যান্ডের যুব সমাজ ধ্বংসের চরমপ্রান্তে অবতীর্ণ হয়েছিল। ঠিক ওই সময় অর্থাৎ ২০১৬ সালের ১ জুলাই ফিলিপাইন পেসিডেন্ট রড্রিগো দুতের্তে মাদক বিরোধী যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। এই ঘোষনায় ওই দেশে ২০১৭ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মারা যায় প্রায় ৪ হাজার; আত্মসমর্র্পন করে ১৩ লাখ। থাইল্যান্ডে মারা যায় ১০ হাজার। বলতে চাচ্ছি না, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশের মাদক অপরাধীদের মেরে ফেলা হোক। হত্যা-খুনের মধ্যে দিয়ে নয়, অন্য কোন উপায় অবলম্বন করা যায় কিনা? সেটা ভাবা দরকার। বাংলাদেশের মাদকবিরোধী অভিযানে কিছু বিষয়ে আরো কিছু সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। এর মধ্যে প্রথমত: যারা মাদক ব্যবসায় জড়িত হওয়ায় মামলায় জড়িয়ে পড়েছে, তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা। দ্বিতীয় অভিযান পরিচালনাকারীরা মাদকের গডফাদারদের কাছ থেকে ঘুষ বাণিজ্য করে, সেবনকারী ছেচরাদের মেরে ফেলছে কিনা তা খতিয়ে দেখা। তৃতীয়: সংশ্লিষ্ট আইন শৃঙ্খলার বাহিনীর সদস্যরা এটা গ্রেফতার ঘুষ বাণিজ্য হিসাবে ফায়দা নিচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখা। চতুর্থত: মাদক বিরোধী র‌্যাবের অভিযান শুরু হলো ৪ মে। পুলিশ বাহিনী অভিযান শুরু করলো ১৮ মে। এখনো অভিযানে নামেনি সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বিজিবি। এক্ষেত্রে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি’র যৌথ এবং পরিকল্পিত সাঁড়াশি অভিযান সরকার চালাতে পারে। লেখাটি তৈয়ার করার পূর্বে ছোট-খাটো একজন মাদক ব্যবসায়ীর সাথে কথা বলেছি, মাদক ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে অন্য ব্যবসা কেন করছেন না? এমন প্রশ্নের জবাবে, আমার আজকের লেখাটি প্রারম্ভিক অভিজ্ঞতার সাথে হুবুহু মিলে গেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সৎ হলে, দেশ প্রেমিক প্রশাসন হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দেশ মাদক মুক্ত হবে। একদিকে ক্রসফায়ার, অন্য দিকে ঘুষের দরকষাকষিতে এই অভিযানের সফলতা আসতে পারেন না। অপরাধ বিজ্ঞানীদের মতে অপরাধীর ৩ ধরণের সাজা নিশ্চিত করা দরকার। ক. অর্থনৈতিক খ. মানসিক গ. শারীরিক। তাই বলে তাই বলে এই নয়, জটিল পরিস্থিতে অটেল কিছু পাওয়ার প্রতিযোগিতা। গত ২৯ মে অনিবার্য কারণে হাইকোর্টে গিয়েছিলাম। উকিলের চেম্বারে অপেক্ষা করছি। কক্ষে ফিরবেন কোর্ট শেষে বিকেল পৌনে ৪ টায় উকিলদের বিশাল একটি বহর তাদের কক্ষে প্রবেশ করলেন। চেয়ারে বসেই সিনিয়র আইনজীবি এক বাদীকে বুঝাচ্ছেন। বিচারক নাকি তাদেরকে বলে দিয়েছেন, একটি ট্যাবলেট পাওয়া গেলেও ৬ মাসের মধ্যে কোন কথা শুনবেন না। কৌতুহল মনে জানতে চাইলাম, বিষয়টি কি? জানলাম ৫ গ্রাম হিরোইন সহ ৬০ উর্ধŸ বাদীর এক আপনজন ধরা পড়েছে। তাকে জামিন করার জন্য তিনি হাইকোর্টে এসেছেন। মহামান্য হাইকোর্ট সোজা জবাব দিয়েছেন, জামিন দেননি। মাদকের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী, মাদকের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালত, মাদকের বিরুদ্ধে জনমানুষ এর পরও কেন মাদক নির্মুল হবে না? এই প্রশ্নের অন্তরালে ্ওই যে গল্পটি। এক চালাকশিয়াল কুমিরের সাথে বন্ধুত্ব করেছিলো। শিয়াল বন্ধু কুমীরের আস্তানায় বেড়াতে গিয়ে দেখতে পেলো, তার আস্তানায় কঁচি কঁচি অনেক কুমিরছানা, সে আর লোভ সামলাতে পারলো না। কুমীরকে শিয়াল বলল, বন্ধু তোমার অনেক সন্তানাদের কেন লেখা পড়া শিখাচ্ছো না? কুমীর বলল, কোথায় শিখাবো? শিয়াল বলল, আমার আস্তানায় তো পাঠশালা রয়েছে, সেখানে পাঠাও। কুমীর রাজি হলো, সহজ সরল কুমীর, তার সব সন্তানদের শিয়ালের পাঠশালায় পাঠালো। শিয়াল, সুযোগ বুঝে যা করার তাই করলো। শেষমেষ কুমীর বুঝতে পারলো, তার সাথে শিয়াল প্রতারণা করেছে, তাঁর সন্তানদের খেয়ে ফেলেছে। ক্ষুব্ধ কুমীর সুযোগ খুঁজছে, কবে তাকে পাকড়ানো যায়। একদিন সমুদ্রে তীরে শিয়াল আহার খুঁজতে গেলে, কুমীর শিয়ালের একটি ঠ্যাং কামড়ে ধরলো, শিয়াল বুঝতে পেরে বলছে, একি করছো তুমি, তুমি তো ঠ্যাং রেখে আমার লাঠি ধরেছো। এমনটি বলা মাত্র কুমীর যেই না ঠ্যাং ছেড়েছে দিল, শিয়াল ভোঁ-দৌড়।

সরকার যখন দেশের সাধারণ জন মানুষ রক্ষার্থে প্রশংসনীয় অভিযান চালাচ্ছে, ঠিক ওই মুহুর্তে কোন শিয়াল কুমীরের নাটক চলুক, এটা জাতি যেমন আশা করে না, তেমনি বিবেবেকের কাম্য নয়।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট, শিক্ষক ও নাট্যকার।
ইমেইল- rahimabdurrahim@hotmail.com
মোবাইল : ০১৭১৪২৫৪০৬৬।