সোহরাব হাসান

আগারগাঁওয়ে বিশাল নির্বাচন কমিশন ভবন। অনেক দূর থেকে দেখা যায়। কিন্তু বাংলাদেশের গণতন্ত্র কত দূর থেকে দেখা যায়, সে প্রশ্ন না উঠে পারে না। কমিশন ভবন যতটা চাকচিক্যময়, আয়োজন ততটা প্রাণবন্ত ছিল না। গতকাল গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সঙ্গে প্রথম দফা আলোচনায় বসেছিলেন তাঁরা। দ্বিতীয় দফা কথা হবে আজ। এর আগে নির্বাচন কমিশন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংলাপ করেছে। বৃষ্টির কারণে আলোচনা শুরু হতে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। আয়োজকদের আন্তরিকতার অভাব না থাকলেও পরিবেশ ছিল নিরুত্তাপ।

নির্বাচন গণতন্ত্রের একমাত্র না হলেও প্রধান পূর্বশর্ত। পৃথিবীর অনেক দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়ার পরও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সংহত না হওয়ার বহু উদাহরণ আছে। কিন্তু সুষ্ঠু নির্বাচন ছাড়া কোনো দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এ রকম নজির একটিও নেই। অতএব আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে হলে একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও হানাহানিমুক্ত নির্বাচনের বিকল্প নেই।

ইভিএম পদ্ধতি থেকে অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া, নির্বাচনী সীমানা পুনর্নির্ধারণ থেকে সব দলের অংশগ্রহণ কিংবা সেনাবাহিনী মোতায়েন করা না-করা—সবকিছুই আলোচনায় এসেছে। কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ছিল নির্বাচন কমিশনের ওপর জনগণের আস্থার বিষয়টি। সেই কাজটি কত দ্রুত ও কত সুচারুভাবে কমিশন করতে পারে, তার ওপরই বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। এবারের নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে বলে প্রায় সবাই মত দিয়েছেন। কিন্তু সেই সঙ্গে তাঁরা এ কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলেই সুষ্ঠু হয় না।

কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে যে কর্মপরিকল্পনা পেশ করেছে, তা শেষ পর্যন্ত কোনো কাজে আসবে কি না, কিংবা একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের নিশ্চয়তা দেবে কি না, সে বিষয়ে চূড়ান্ত কথা বলার সময় এখনো আসেনি। তবে তাদের সাম্প্রতিক তৎপরতা দেখে জনমনে এই প্রতীতি জন্মেছে যে তারা পূর্বসূরি রকিব কমিশনের মতো চোখে ঠুলি ও কানে তুলো দিয়ে পথচলার মতো গোঁয়ার্তুমি দেখাবে না।

অংশীজনের সঙ্গে আলোচনায় বসে বর্তমান কমিশন সদিচ্ছা দেখিয়েছে, কিন্তু সক্ষমতা ও সততা দেখাতে পারবে কি না, সে প্রশ্নের জবাব ভবিষ্যৎই দেবে। নাগরিক সমাজ কিংবা সাংবাদিকদের সঙ্গে কমিশনের আলোচনার প্রয়োজন আছে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন নির্বাচনের অংশীজন প্রতিযোগী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা। ২৬ আগস্ট থেকে সেটি শুরু করতে যাচ্ছে কমিশন।

যেকোনো নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু করতে প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলগুলোর সহায়তা জরুরি। আবার প্রধান বাধাটিও আসে তাদের তরফ থেকে। এখন নির্বাচন কমিশন সেই বাধা বা চ্যালেঞ্জ কীভাবে মোকাবিলা করবে, সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নব্বইয়ে স্বৈরাচারের পতনের পর আন্দোলনে বিজয়ী তিন জোট রূপরেখা দিয়ে নির্বাচন সুষ্ঠু করার ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করেছিল। পরবর্তীকালে চারটি নির্বাচন হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। সে সময় যাঁরা ক্ষমতায় ছিলেন, তাঁরা নির্বাচনের অংশীজন ছিলেন না। এবারের পরিবেশ-পরিস্থিতি ভিন্ন। সংবিধান সংশোধন না হলে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকতেই নির্বাচন হবে। কেবল তা-ই নয়, দশম জাতীয় সংসদও বহাল থাকবে। এ অবস্থায় নির্বাচন কমিশন কীভাবে সুষ্ঠু নির্বাচনের পূর্বশর্ত পূরণ, তথা সবার জন্য মাঠ সমতল করবে, নাগরিক সমাজ তথা গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের কথায় ঘুরেফিরে সেই প্রশ্নই এসেছে।

নির্বাচন কমিশনের পদাধিকারীরা বলেছেন, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য যা যা প্রয়োজন তাঁরা তা করবেন।

সত্যি কি তাঁরা করতে পারবেন? পারলে সেটি বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে অনন্য নজির হয়ে থাকবে এবং তাঁরা সংবর্ধিত হবেন ‘বীর’ হিসেবে। আর না পারলে তাঁদের নামও লিখিত হবে রকিব-আজিজদের পাশে।

বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় কেউ মনে করেন না, নাগরিক সমাজ বা অন্য কেউ বিবদমান দুই পক্ষকে এক জায়গায় বসিয়ে একটি সমঝোতায় আনতে পারবে। সাংবিধানিক ও নৈতিকভাবে কাজটি করতে পারে নির্বাচন কমিশন। কেননা, রাজনৈতিক দলের হাত যত লম্বাই হোক, তা নির্বাচন কমিশনকে সংবিধান যে ক্ষমতা দিয়েছে, তার চেয়ে লম্বা নয়।

নুরুল হুদা কমিশন ঘোষিত কর্মপরিকল্পনায় যেসব আইনি কাঠামো সংস্কার ও সংশোধনের কথা বলা হয়েছে, তার সঙ্গে দ্বিমত না করেও যে কথাটি বলা প্রয়োজন তা হলো বর্তমান জটিল ও কঠিন রাজনৈতিক পরিবেশে এসব আইনি সংস্কারই যথেষ্ট নয়। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার জন্য প্রতিষ্ঠানের পদাধিকারীদের যেমন সদিচ্ছা থাকতে হবে, তেমনি সেটি বাস্তবায়নের সক্ষমতাও দেখাতে হবে। অন্যথায় এসব সংলাপ-আলোচনা নিষ্ফল রোদনে পরিণত হবে।

-সৌজন্যে: প্রথম আলো