ইসমাইল সাজ্জাদ
১৫ আগস্টের রহস্যময় ভূমিকার জন্য প্রশ্নবিদ্ধ ব্রিগেট কমান্ডার কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) সাফায়াত জামিল তাঁর লেখা ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর’ বইটিতে তখনকার সেনাবাহিনীর কিছু প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছেন। তিনি এই বইতে লিখেছেন,আমি পেছন ফিরে দেখি, সেনাবাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধা ও অমুক্তিযোদ্ধ অফিসারদের মধ্যে একটা রেষারেষি ছিল। কিছুসংখ্যক অমুক্তিযোদ্ধা অফিসার যারা মূলত যুদ্ধ শেষে পাকিস্তান প্রত্যাগত, তারা মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের সহ্যই করতে পারতেন না। কয়েকটি ঘটনার বরাত দিয়ে তিনি ওই বইতে লেখেন, অমুক্তিযোদ্ধা সিনিয়র কিছু অফিসার সরকার ও সেনাবাহিনী দু’জায়গাতেই একটা পরিবর্তন চাচ্ছিলেন। বিভিন্ন সময়ে তাদের বিভিন্ন উস্কানিমূলক কথাবার্তা ও কর্মকাণ্ড অসন্তুষ্ট ও বিভ্রান্ত মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের প্ররোচিত করত। সরকারের বিভিন্ন ব্যর্থতা আর দুর্নীতির অভিযোগে সাধারণ মানুষের মত সেনাবাহিনীতেও ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছিল। তবে সেনাবাহিনীর নিয়ম-শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে জঘন্য একটি হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের জন্য এগুলো কোনো অজুহাত হতে পারে না।
আবার ক্ষুব্ধ কিছু সামরিক অফিসারদের সঙ্গে তখনকার আওয়ামী লীগের কিছু রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে রেষারেষির কিছু খবরও তখনকার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে উঠে আসে। বিশেষ করে মেজর ডালিমের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা গাজী গোলাম মোস্তফার দ্বন্দ্বের বিষয়টি। এ বিষয়ে কর্নেল হামিদ ‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা’ বইয়ে লেখেন যে, বিয়ের পার্টিতে নব-বিবাহিত ডালিম ও তার স্ত্রী। গাজীর ছেলে ডালিমকে অপমান করে। এ নিয়ে কথা কাটাকাটি। ডালিম কর্তৃক গাজীর ছেলেকে চপেটাঘাত। কিছুক্ষণের মধ্যে গাজীর ছেলে দলবল নিয়ে হাজির। ডালিম ও তার স্ত্রীকে একটি গাড়িতে উঠিয়ে অজ্ঞাত স্থানে যাত্রা। ক্যান্টনমেন্টে খবর শুনে ডালিমের বন্ধু মেজর নুর এক গাড়ি সৈন্য নিয়ে গাজী গোলাম মোস্তফার বাড়ি ঘেরাও করে এবং ডালিমকে ফেরত দেবার দাবি জানায়। তাকে বঙ্গবন্ধুর সামনে হাজির করা হল। মেজর ডালিমও তার বইয়ে এমনটা দাবি করেন। ডালিমের ফরিয়াদ, বঙ্গবন্ধু, আমরা আপনার ডাকে লড়াই করেছি। আর এই ছেলেরা ফুর্তি করেছে। আজ তারা আমাকে অপমান করেছে। আপনি বিচার করুন। শার্ট খুলে সে দেখায় পিঠের আঘাত। বঙ্গবন্ধু বিচার করলেন! তিনি সেনা শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে মেজর ডালিম ও মেজর নুরকে চাকুরি থেকে বরখাস্ত করলেন। ঘটনাটি ক্ষুদ্র হলেও এর প্রতিক্রিয়া ছিল সুদূরপ্রসারী।
তবে তখনকার ডিজিএফআই কর্মকর্তা মেজর জিয়াউদ্দিন এই ঘটনার বিবরণ দিলেন ভিন্নভাবে। ডালিম ও তার স্ত্রীকে ধরে নিয়ে গেছিল, এই কথাগুলো সম্পূর্ণ ভুল। ঐতিহাসিক ভুল। কারণ বিয়ের পার্টি থেকে ডালিম ও তার স্ত্রী সরাসরি গেছিলেন বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে। নালিশ করার জন্য। আর এই ঘটনাটি অতিরঞ্জিত হওয়ার কারণে পরবর্তী সময়ে যারা ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যায় অংশ নিলেন, তারা কিন্তু ওই রাতেই একটা সামরিক অভ্যুত্থান করার চেষ্টা করেছিলেন। এ বিষয়ে কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) সাফায়াত জামিল তাঁর লেখা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর’ বইটিতে লেখেন, ঢাকায় আসার কিছুদিন পরই অন্য অফিসারদের মুখে শুনি, মেজর ফারুক এর আগে অর্থ্যাৎ ১৯৭৩ সালের শেষ দিকে একটি অভ্যুত্থানের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তার সমর্থনে কুমিল্লা থেকে সৈন্যদল ঢাকায় আসার কথা ছিল। কিন্তু সেই সেনাদল শেষ পর্যন্ত ঢাকায় না আসায় ফারুকের অভ্যুত্থান বানচাল হয়ে যায়। উল্লেখ্য, তখন সেনাবিহনীতে ট্যাংক ছিল মাত্র তিনটি। সেই তিনটি ট্যাংকই কব্জা করে অভ্যুত্থানের ফন্দি এঁটেছিল ফারুক। উর্ধতন অফিসারদের সবাই ফারুকের অভ্যুত্থান সংগঠনের ফন্দির কথা জানতেন। কিন্তু বিষ্ময়ের ব্যাপার এজন্য তার বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আরো আশ্চার্যের ব্যাপার ১৯৭৪ সালে মিশরের কাছ থেকে শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসেবে ৩২টি ট্যাংক পাওয়ার পর গঠিত ট্যাংক রেজিমেন্টটি সেই ফারুকের দায়িত্বেই ঢাকায় মোতায়েন করা হয়।