ডেস্ক নিউ্জ:
মাঝে-মাঝেই আলোর ঝলকানি দিয়ে দলে ফেরার আশ্বাস মিললেও বাস্তবে তার মিল খুঁজে পান না বিএনপির কথিত সংস্কারপন্থী নেতৃবৃন্দ। দীর্ঘ দশ বছর ধরেই দলে ফেরার অপেক্ষা করছেন তারা। একসময়ের ডাকসাইটে এসকল নেতারা দলের হাইকমান্ডের আশ্বাস আর দলকে ঐকবদ্ধ করার প্রতিশ্রুতির ওপর পার করেছেন দিন, মাস আর বছরের পর বছর। এখন অনেকেই আর আশ্বস্ত হতে পারছেন না। তাই আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন পুরো রাজনীতির উপরই। তবে জাতীয়তাবাদী আদর্শে বিশ্বাস করেন বলে অন্য কোথাও নিজেদের স্থান করেননি। এমনটাই জানিয়েছেন দলের বাইরে থাকা একসময়ে মন্ত্রী-এমপি কিংবা প্রভাবসালী নেতাদের অনেকে। তারা জানান, একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে আবারও আশ্বাস মিলছে। কিন্তু এবারও তা বাস্তবায়ন হবে কি না তা বলতে পারছি না। তাদের অভিযোগ, দলের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা একটি অদৃশ্য দেয়াল এখনো সক্রিয় রয়েছে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে থেকেই সংস্কারপন্থি নেতা হিসেবে পরিচিত, অভিমানে দল থেকে সরে যাওয়া নেতাদের ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু করেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দশম জাতীয় নির্বাচনে সরকারের নানা প্রলোভনেও এসকল নেতৃবৃন্দ জাতীয়তাবাদ আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। বরং খালেদা জিয়ার আশ্বাসে তারা নির্বাচন ঠেকাও আন্দোলনে নিজেদেরকে নানা উপায়ে সস্পৃক্ত রেখেছেন। কেউ মিডিয়ার টক শো আলোচনায় সরব থেকেছেন, কেউ নিজ এলাকায় অনুসারীদের দিয়ে ভোট বয়কটের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছেন। কিন্তু নির্বাচন শেষ দলে ফিরিয়ে নেয়ার কার্যক্রমও শেষ। এরপর দলের ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলে এসকল নেতাদের স্থান করে দেয়া হবে এমন আশ্বাসও আর বাস্তবায়ন হয়নি। এর প্রেক্ষিতেই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন দলের বাইরে থাকা নেতৃবৃন্দ।
তারা বিভিন্ন উপায়ে দলের হাইকমান্ডের সাথে যোগাযোগ করেন। যার কারণে হঠাৎ আলোর ঝলকানি দিয়ে গত ২৩ ফেব্রুয়ারী রাতে দলের সাবেক দুই এমপি সরদার সাখাওয়াত হোসেন বকুল ও জহির উদ্দিন স্বপনকে গুলশান কার্যালয়ে ডেকে কথা বলেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। অতীতের সকল ভেদাভেদ ভুলে তাদের ঐক্যবদ্ধভাবে দলের জন্য কাজ করতে বলেছেন তিনি। পর্যায়ক্রমে সংস্কারপন্থি অন্য নেতাদেরকেও ডাকা হবে এমন ইঙ্গিতও দেয়া হয়েছিলো ওই সময়ে। এর ধারাবাহিকতায় সাবেক সাংসদ ও দলের সুনামগঞ্জ জেলা সভাপতি নজির হোসেনকেও তিনি তার কার্যালয়ে ডাকেন, কথা বলেন। দলের নীতিনির্ধারকদের এমন মনোভাবে একদিকে যেমন নেতাকর্মীদের মাঝে উচ্ছাসের সৃষ্টি হয়, তেমনি দলের বাইরে থাকা একসময়ের হেভিওয়েট নেতৃবৃন্দও আশার আলো দেখতে পেয়েছিলেন। কিন্তু দলের অন্যান্য যে কোন কার্যক্রমের মতো এ সিদ্ধান্তটিও এখন থমকে গেছে। কবে-কখন অন্যান্য নেতাদের দলে ফিরিয়ে আনা হবে তা এখন কেউ বলতে পারছেন না।
এরপরও তারা যোগাযোগ রাখছেন বিএনপির হাইকমান্ডের সাথে। এমন নাজুক পরিস্থিতিতে তাদের রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে আলোচনা করছেন। এরপরও ফলপ্রসু কোন সম্ভাবনা দেখা না গেলে যে কোন ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহনের পরিকল্পনা নিয়েও এগুচ্ছে সংস্কারপন্থি নেতৃবৃন্দ। এমনটাই জানা গেছে ওই সকল নেতাদের সাথে আলাপকালে।
দলীয় সূত্র জানায়, দলের মধ্যে কট্টরপন্থি হিসেবে পরিচিত এবং নীতিনির্ধারকদের চিরায়ত ধীরে চলো নীতির কারনেই এসকল প্রভাবসালী নেতাদের ফিরিয়ে আনার কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। যার কারনে একদিকে কথিত সংস্কারপন্থি হিসেবে পরিচিত নেতারা হতাশ হয়ে পড়ছেন তেমনি তৃণমুল নেতাকর্মীরাও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছেন।
ওয়ান ইলেভেনের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ২০০৭ সালের ২৫ জুন বিএনপির মহাসচিব আবদুল মান্নান ভুঁইয়া দলের অভ্যন্তরে ১৫ দফা সংস্কার প্রস্তাব দিলে এর প্রতি দলের ১২৭ জন সাবেক মন্ত্রী-সাংসদ তাকে সমর্থন দেয়। সেই থেকে ওই অংশটিকে সংস্কারপন্থি বলে বিএনপিতে চিহ্নিত। সংস্কার প্রস্তাবের পর খালেদা জিয়া গ্রেপ্তারের পূর্ব মুহূর্তে দলের মহাসচিব আবদুল মান্নান ভুঁইয়া, যুগ্ম মহাসচিব আশরাফ হোসেন, দপ্তর সম্পাদক মফিকুল হাসান তৃপ্তিকে বহিষ্কার করেন। সে সময় দলের মহাসচিব হিসেবে নিয়োগ পান প্রয়াত খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন।
ওয়ান ইলেভেন পরবর্তি রাজনৈতিক পটপরিবর্তন আর নানা চাড়াই-উৎরাইয়ের মধ্যেও বিএনপিকে ছেড়ে যাননি একসময়ে দলের গুরুত্বপূর্ন এসকল নেতৃবৃন্দ। এরপর সবাইকে নিয়ে কমিটি হবে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার এমন আশ্বাস বাস্তবায়নের অপেক্ষায় ছিলেন সংস্কারপন্থী নেতারা। কিন্তু গত বছরের দলের ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল শেষে ৬ আগস্ট কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণাতে তাদের কাউকে অন্তর্ভূক্ত না করায় আশাহত হন তারা। এরপরও তারা চেষ্টা করে গেছেন দলে কাজ করার জন্য। এর অংশ হিসেবে দলের চেয়ারপার্সন সংস্কারপন্থি হিসেবে পরিচিত দুই নেতাকে গুলশান কার্যালয়ে ডেকে একটি সিগন্যাল দেন- অন্যান্যদেরকেও তিনি দলে অন্তর্ভূক্ত করবেন। কিন্তু এবারও কট্টরপন্থি হিসেবে পরিচিত দলের একটি ক্ষুদ্র অংশের প্রবল আপত্তির মুখে সেই সিদ্ধান্ত থেকেও অনেকটা পিছু হটতে হয়েছে খালেদা জিয়াকে। এমনটাই জানিয়েছেন দলের একটি সূত্র।
সংস্কারপন্থি ইস্যুতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, সংস্কারপন্থীরা অন্য দলে যাননি। এমনকি ২০০৮ ও ২০১৫ সালের নির্বাচনেও তারা দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে চলেছেন। ২০০৯ সালের কাউন্সিলের পর সংস্কারপন্থী কিছু নেতা দলে নেয়া হলেও এবার বাকিদের নেয়া হয়নি। ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলে তেমনটা না হলেও পরবর্তিতে দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া তাদের সাথে কথা বলেছেন। অন্যান্য যারা রয়েছেন তাদের সঙ্গেও দলের হাইকমান্ডের কথা বলা উচিত।
সংস্কারপন্থী অংশের এক নেতা অনেকটা ক্ষোভ এবং হতাশার সুরে বলেন, আমরা ২০০৯ সালের কাউন্সিলের পর থেকে অপেক্ষা করছি। এর মধ্যে সুযোগ পেলেও ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে হাত মিলাইনি। হঠাৎ করে দলের চেয়ারপার্সন আমাদের মতো দুইজন নেতাকে ডাকলেন, কথা বললেন, আশ্বস্থ করলেন। কিন্তু ওই প্রক্রিয়াটা এখন আবার বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, আমাদের অপরাধটা কি? আর কত অপেক্ষা করতে হবে। আমরা কি মরে গিয়ে প্রমাণ করব যে, আমরা খালেদা জিয়া নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ আছি।
সাবেক সাংসদ ও চাঁদপুর জেলা সাবেক সভাপতি এসএ সুলতান টিটু বলেন, আমি ছাত্র রাজনীতি থেকে উঠে এসেছি। জাতীয়তাবাদ আদর্শকে লালন করেই আমার সারাজীবন ব্যয় করেছি। তাই এখনো ব্যকুল হয়ে আছি দলের জন্য কাজ করার জন্য। ম্যাডাম যখনই ডাকবেন তখনই আমি আবারো সর্বোচ্চটুকু দিয়ে দলের জন্য কাজ করবো।
সংস্কারপন্থিদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব পোষণকারী শীর্ষ নেতাদের মধ্যে রয়েছেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, নজরুল ইসলাম খান, দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, সাদেক হোসেন খোকাসহ দলের অনেক কেন্দ্রীয় নেতা।
উদারপন্থি হিসেবে পরিচিত এমন এক নেতা নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, বলা যাচ্ছে না, অন্য দলের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতেই এখন একটি অংশ তৎপর কি না। আর এটি হয়ে থাকলে ঐ সংস্কারপন্থিদের তুলনায় অনেক ক্ষতি হবে দলের। কারন এসব নেতাদের মধ্যে এমন কিছু নেতা রয়েছে যাদের নিয়ে আওয়ামী লীগের মাথা ব্যাথার অবশ্যই কারন আছে।
সংস্কারপন্থির অভিযোগে দলের পদবঞ্চিত গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের মধ্যে রয়েছেন, বিএনপি চেয়ারপার্সনের সাবেক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) জেডএ খান ও মোফাজ্জল করিম, সাবেক প্রতিমন্ত্রী শাহ মোঃ আবুল হোসাইন, সাবেক হুইপ ও পিরোজপুর জেলার সাবেক সভাপতি সৈয়দ শহীদুল হক জামাল, সাবেক হুইপ রেজাউল বারী ডিনা, দলের সাবেক দফতর সম্পাদক মফিকুল হাসান তৃপ্তি, সাবেক সাংসদ ও চাঁদপুর জেলা সাবেক সভাপতি এসএ সুলতান টিটু ও সাধারণ সম্পাদক আলমগীর হায়দার খান, সাবেক সাংসদ ইঞ্জিনিয়ার শহিদুজ্জামান, সাবেক সাংসদ ও দলের বরগুনা জেলার সভাপতি নূরুল ইসলাম মনি, সাবেক সাংসদ শামীম কায়সার লিঙ্কন, বগুড়ার সাবেক দুই সাংসদ ডা. জিয়াউল হক মোল্লা ও জিএম সিরাজ, সাবেক সাংসদ মোশাররফ হোসেন মঙ্গু, বরগুনা জেলা সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সাংসদ ইলেন ভুট্টো প্রমুখ।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।