হোপ হাসপাতাল। আর্ত-মানবতার সেবার মহান ব্রত নিয়ে একটি ছোট্ট ঘরে যাত্রা করা এই হাসপাতালটি আজ এক মহীরূপে পরিণত হয়েছে। সেবা আর ভালোবাসায় দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে এর নামডাক। কক্সবাজার শহরের অদূরে রামুর চেইন্দায় অবস্থিত এই হাসপাতালটির সুনাম জেলা ছাড়িয়ে অনেক দূরান্তে পৌঁছে গেছে। এর বিস্তৃতি দিনকে দিন বেড়ে চলছে। চিকিৎসা সেবায় নিন্ম ও মধ্যবিত্তের শেষ ত্রাতাস্থল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মানবসেবার এই আতুড়ঘর।
জানা গেছে, নিন্ম-মধ্যবিত্ত মানুষকে দীর্ঘ দেড়যুগ ধরে স্বল্প ও বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছে এই হাসপাতালটি। এতে বিপুল জনগোষ্ঠী পেয়েছেন নিশ্চিত ও নিরাপদ জীবন। কক্সবাজারের মানুষের জন্য এমনটি বৃহৎ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন কক্সবাজারেরই এক কৃতিসন্তান। তিনি ডা. ইফতিখার মাহমুদ। হোপ হাসপাতাল এত নামডাক ছড়িয়ে গেলেও তার কারিগর ডা. ইফতিখার মাহমুদ আড়ালেই থেকে যান। অবশ্য তিনিও চান না তাঁর এত নামডাক! নিজেকে আড়াল রেখে সৃষ্টিটাকে ছড়িয়ে দিতে চান তিনি। এই সাক্ষাতকার দিতে গিয়েও এই কথাটি বলে দিলেন। কক্সবাজার শহরে জন্ম নেয়া এই মহান মানুষটি গড়ে তুলেছেন হোপ হাসপাতাল। মানবসেবা ব্রত নিয়েই গড়ে তুলেছিলেন এই প্রতিষ্ঠানটি। নিজের গড়া হোপ ফাইন্ডেশনের মাধ্যমে এই হাসপাতালটি পরিচালনা করছেন। পেশাগত কাজে সুদূর আমেরিকা থাকলেও তার মন পড়ে এই হাসপাতালের আঙিনায়। সার্বক্ষণিক তাঁর দিকনির্দেশনায় পরিচালিত হচ্ছে এই হাসপাতালের বিশাল কর্মযজ্ঞ। এক সাক্ষাৎকারে হোপ হাসপাতালের আদ্যপান্ত এবং নিজের বিষয়ে কথা বলেছেন ডা. ইফতিখার মাহমুদ। ইমেইলে তাঁর সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন সিবিএন’র চীফ রিপোর্টার শাহেদ মিজান।

সিবিএন: কেমন আছেন?
ডা. মাহমুদ: আলহামদুলিল্লাহ, সব মিলিয়ে ভালো আছি।
সিবিএন: প্রথমে আপনার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে জানতে চাই।
ডা. মাহমুদ: আমার জন্ম কক্সবাজার শহরের তারাবনিয়ারছাড় আমার বাবা জহির উদ্দীন আহমদ । পেশাগত কারণে পরিবার নিয়ে আমি আমেরিকার ফ্লোরিডা শহরে বসবাস করি।
পড়ালেখা ও চাকরি: কক্সবাজার পৌর প্রিপ্যারাটরি হাইস্কুল থেকে ৮ম শ্রেণি পাশ করি। পরে ১৯৭৮ সালে চট্টগ্রাম মুসলিম হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাশ করি। ১৯৮০ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এইএসসি পাশ করি। ১৯৮৭ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস সম্পন্ন করি।
চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে কিছুদিন কাজ করে উন্নত প্রশিক্ষণ ও শিশু স্বাস্থ্য বিষয়ে নিউইয়র্ক এর ব্রুকলীন হসপিটাল এবং কর্ণেল ইউনিভার্সিটি মেডিকেল হসপিটালে পড়াশুনা করি। বর্তমানে আমেরিকার ফ্লোরিডার মায়ামিতে একজন শিশু বিশেষজ্ঞ হিসেবে প্রাইভেট প্র্যাক্টিস করি।
সিবিএন: হোপ হাসপাতালের শুরু থেকে বর্তমান পর্যন্ত সামারিটা বলুন।
ডা. মাহমুদ: হোপ হাসপাতালের কার্যক্রমের যাত্রা হয় ১৯৯৯ সালে। আমার স্বপ্ন ছিলো একজন ডাক্তার হিসেবে দেশের মানুষের সেবা করা। সেই স্বপ্ন থেকে হোপ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করি। এটি একটি আমেরিকা ভিত্তিক হোপ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়। মূল কর্মকান্ড বাংলাদেশে পরিচালিত হয়।
ভিশন: হতদরিদ্র মানুষকে; বিশেষ মা ও শিশুদের সেবা প্রদান করা আমাদের ভিশন। প্রথমে আমরা কাজ করি ভাড়া বাসায়। কক্সবাজারের বাংলাবাজার এলাকায় একটি আউডডোর ক্লিনিক স্থাপন করে। এটি ১৯৯৯ সালের কথা। ২০০৫ সালে চেইন্দায় নিজস্ব জমিতে হোপ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করি। পরবর্তী পর্যায়ে হোপ ফাউন্ডেশন ট্রেনিং সেন্টারে মিডওয়াইফারি এডুকেশন প্রোগ্রাম চালু করি। সাথে দানবীর লোকজনের আর্থিক সহায়তায় কক্সবাজারের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের বেশ কিছু হোপ মেডিকেল সেন্টার স্থাপন করি। গতবছর ইসলামিক ডেভেলপম্যান্টে ব্যাংক এর সহায়তায় গ্রামাঞ্চলের চারটি ‘হোপ বার্থ সেন্টার’ স্থাপন করি। এইসব সেন্টারে গর্ভবতী মায়েদের স্বাস্থ্যসেবা ও নরমাল ডেলিভারি করানো হয়। জটিল হলে হোপ হাসপাতালে রেফার করা হয়।
সিবিএন: কোন স্বপ্ন নিয়ে হোপ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন?
ডা. মাহমুদ: কক্সবাজার এবং বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানে স্বাস্থ্যসেবা মূলক প্রতিষ্ঠান করা আমার আজীবন স্বপ্ন। আমার শ্রদ্ধেয় পিতা আমাকে ডাক্তার হওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করেছেন এবং সেবামূলক কাজ করার জন্য সব সময় উৎসাহিত করেছেন।
সিবিএন: কি প্রেক্ষাপটে থেকে হোপ ফাউন্ডেশন ও হোপ হসপিটাল করেছেন?
মাহমুদ: হোপ ফাউন্ডেশন এর মাধ্যমে সরকারের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার আমদের লক্ষ্য। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের অবহেলিত এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীরর সেবা করা এবং যারা আর্থিক অসুবিধার কারণে স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত তাদের উন্নত মানের সেবা প্রদান করার আমাদের অন্যতম লক্ষ্য।
সিবিএন: হোপ ফাউন্ডেশন ও হোপ হাসপাতালের অর্জন ও সাফল্য কি কি?
ডা. মাহমুদ: হোপ হাসপাতাল প্রতিবছর ২০-২৫ হাজার রোগীর স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করে থাকে। এর মধ্যে রয়েছে নিরাপদ মাতৃত্ব সেবা প্রদান, বাংলাদেশের অন্যতম ফিস্টুলা চিকিৎসা প্রদান, ঠোঁটকাটা রোগীর সার্জারির মাধ্যমে তাদেরকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা, নিরাপদ মাতৃসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে প্রথম মিডওয়াইফেরী ট্রেনিং সেন্টার চালু করা, দেশ-বিদেশের বিশেজ্ঞ চিকিৎসক এনে আগুনে পোড়া রোগীদের সার্জারির মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা। বাংলাদেশের প্রথম ফিস্টুলা হাসপাতাল নির্মাণ করছে হোপ ফাউন্ডেশন। এটি ২০১৯ সালে চালু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সেখানে নার্সিং ট্রেনিং কোর্চ চালু করা হবে।
সিবিএন: হোপ হাসপাতালকে ভবিষ্যতে কোন পর্যায়ে দেখতে চান?
ডা. মাহমুদ: ভবিষ্যতে এই হাসপাতালকে অনেক বড় বিশেষায়িত বিভাগ সংযোজনের মাধ্যমে মানুষের সেবা করতে চাই।
সিবিএন: মানবসেবা নিয়ে নিজের অভিব্যক্তি কি?
ডা. মাহমুদ: মানবসেবা হচ্ছে সবচেয়ে উত্তম কাজ। মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে মানবসেবা বড় ইবাদত। আমাদের সমাজে যারা অবহেলিত, নিগৃহিত আছেন তাদের সেবা করার সুযোগ পাওয়া আমাদের ভাগ্যের ব্যাপার। এই ধরণের সেবামূলক কাজে অংশ নিতে পেরে আমরা গর্বিত।
সিবিএন: আপনার স্বপ্নের কথা বলুন।
ডা. মাহমুদ: আমার স্বপ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের মায়েদের মাতৃত্ব নিরাপদ করা। মায়েদের স্বাস্থ্যসেবার মাধ্যমে পুরো পরিবারের কাঠামো দৃঢ় করা এবং শিশুদের ভবিষ্যৎ নিরাপদ করা। শিশুদের সুস্বাস্থ্যের অধিকারী করা, যাতে করে দেশের সম্পদ শিশুরা সুস্বাস্থ্য নিয়ে গড়ে উঠতে পারে।
সিবিএন: কতদিন ধরে আমেরিকা থাকেন, দেশে কেমন আসেন?
ডা. মাহমুদ: আমি ২৮ বছর ধরে আমেরিকায় বাস করি। বছরে দু’বার দেশে যাই।
সিবিএন: দেশ তথা জন্মভূমি কক্সবাজারকে কেমন অনুভব করেন?
ডা. মাহমুদ: কক্সবাজার আমার জন্মস্থান এবং সেখানেই আমার বেড় উঠা। বহু বছর প্রবাস জীবন যাপনের পরও কক্সবাজারের প্রতি আমার ভালোবাসা অটুট।
সিবিএন: কোনো দিন কি স্থায়ীভাবে দেশে ফিরে আসার ইচ্ছা আছে?
ডা. মাহমুদ: দেশে স্থায়ীভাবে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে আছে। আমেরিকার পেশাগত জীবন থেকে অবসর নেয়ার পর দেশে গিয়ে হোপ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে দেশের মানুষকে আরো সেবা প্রদানের ইচ্ছা রাখি।
সিবিএন: কঠিন ব্যস্ততার মধ্যেও দীর্ঘ এই সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্য অশেষ ধন্যবাদ
মাহমুদ: আমার এই দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্য সিবিএনকেও অশেষ ধন্যবাদ।