বাংলাট্রিবিউন:
গেল শুক্রবারের (৭ জুলাই) ঘটনা। দাউদকান্দির গৌরীপুর বাসস্ট্যান্ডের পাশের একটি ডোবায় হঠাৎই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়ে যায় একটি বাস। মুহূর্তে আশেপাশে শোরগোল ওঠে। চিৎকার চেঁচামেচি করে উপস্থিত হলেও সবাই যখন বাসের ডুবন্ত যাত্রীদের সাহায্যের বদলে ছবি বা সেলফি ওঠাতেই ব্যস্ত তখন অসম সাহসিকতা দেখান দাউদকান্দি হাইওয়ে থানার একজন কনস্টেবল। তার নাম পারভেজ মিয়া। হাজামজা দুর্গন্ধযুক্ত পানিভরা ডোবাতে লাফিয়ে নেমে উল্টে যাওয়া বাসের জানালার কাচ ভেঙে উদ্ধার করেছেন ২৫-২৬ জন যাত্রীকে। কনস্টেবল পারভেজ মিয়ার এই অসম সাহসিকতার গল্প প্রকাশিত হয়েছে সব গণমাধ্যমে, সামাজিক গণমাধ্যমের মাধ্যমে ছড়িয়ে গেছে সারাবিশ্বে। কী ভাবছিলেন তখন পারভেজ মিয়া? বাংলা ট্রিবিউনের কাছে তিনি নিজেই বলেছেন তার সেই মুহূর্তের অনুভূতি ও দায়িত্বশীলতার কথা।
বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে ফোনালাপে কনস্টেবল পারভেজ বলেন, ‘দাউদকান্দিতে যাত্রীবাহী বাসটি যখন ৫০ জন যাত্রী নিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ডোবায় পড়ে যায় তখন নিজের মনে একটি অনুভূতি সৃষ্টি হয়। হায়রে! যাত্রীগুলো বাঁচার জন্য কতো না আঁকুতি করছে। আমার মাথায় তখন শুধু একটা জিনিসই কাজ করেছে, কীভাবে মানুষগুলোকে জীবিত উদ্ধার করা যাবে। ডোবায় বিষাক্ত ময়লা আবর্জনা ও পানিতে নামলে আমি বাঁচবো কিনা, সেটাও চিন্তা করতে পারিনি।’.


পারভেজের বাড়ি মুন্সীগঞ্জ জেলার গজারিয়া উপজেলার হোসেনদি গ্রামে। তার বাবা আবুল কাশেম একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তারা চার ভাই-বোন। ভাইদের মধ্যে পারভেজ বড়। ২০০৮ সালে স্থানীয় হোসেনদি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং সোনারগাঁও ডিগ্রি কলেজ থেকে ২০১০ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পরই সংসারের হাল ধরেন তিনি। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থায় চাকরির পর গত বছর আগস্টে চট্টগ্রাম দোহাজারী থানায় যোগ দেন হাইওয়ে পুলিশ হিসেবে। এরপর চলতি বছরের এপ্রিল মাসে কুমিল্লা দাউদকান্দি থানায় হাইওয়ে পুলিশের কনস্টেবল হিসেবে নিয়োজিত রয়েছেন পারভেজ।ঘটনার কথা স্মরণ করে পারভেজ বলতে থাকেন, ‘আমার চোখের সামনে যখন যাত্রীবাহী একটি বাস খাদে পড়ে যায়, তখন অনেকেই ছবি তোলায় ব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু নর্দমা ও বিষাক্ত পানিতে গাড়ির ভেতর আটকে থাকা নারী ও শিশুসহ যাত্রীদের চিৎকার শুনে কেউ যাননি। আমি তখন মানবিক কারণে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনি।’.

 পারভেজ বলেন, ‘গাড়ির কাছে গিয়ে দেখি অনেকে ইশারায় সাহায্য চাচ্ছে, তখন গাড়ির গ্লাস ভাঙা শুরু করি। কিন্তু গাড়িটি উল্টে থাকায় ও জানালার গ্লাস বন্ধ থাকায় অনেক যাত্রীই ভেতর থেকে বের হতে পারছিল না। আমার আশঙ্কা ছিল নর্দমাটিতে বিষাক্ত গ্যাস জমা থাকতে পারে, তাই আমার কোমরে একটি গামছা বেঁধে স্থানীয় এক লোককে গাড়ির কাছে রেখে বলি ভেতর থেকে আমার কোনও সাড়া শব্দ না পেলে আমাকে টেনে তুলবেন। এভাবেই অন্তত ২৫ থেকে ২৬ জন যাত্রীকে উদ্ধার করি।

 পারভেজ মিয়া বলেন, ‘কোনও প্রশংসা কিংবা পুরস্কার পাওয়ার আশায় তখন যাত্রীদের বাঁচাতে এগিয়ে আসিনি। কীভাবে যে গাড়ির গ্লাসগুলো ভেঙে ফেলেছি, একটু ব্যথাও পাইনি। এখন অবশ্য বুঝতে পারছি পুরো শরীরেই আমার ব্যথা। এখনও প্রচুর ব্যথা অনুভব করছি।’
এ বিষয়ে কুমিল্লা হাইওয়ে পুলিশ সুপার পরিতোষ বলেন, ‘যাত্রীদের জীবন বাঁচাতে আমাদের পারভেজ ঝুঁকি নিয়ে যা করেছে তা হাইওয়ে পুলিশ বিভাগের জন্য সত্যিই প্রশংসনীয়। পুরস্কার দিয়ে কাজের মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। তবুও এ কাজের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি যাতে তিনি রাষ্ট্রীয়ভাবে পান এ ব্যাপারে সুপারিশ করা হবে।’তিনি আরও বলেন, পারভেজের সাহসিকতায় হাইওয়ে পুলিশের ডিআইজি আতিকুর রহমানের পক্ষ থেকেও ৫০ হাজার টাকা, কুমিল্লা আঞ্চলিক হাইওয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে ১০ হাজার টাকা দিয়ে সম্মানিত করেছে। এছাড়াও দাউদকান্দির কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা ও পেন্নাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সেলিনা আক্তার তাকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে পুরস্কৃত করেছেন। এসব ভালো কাজকে পুরস্কৃত ও প্রশংসা করলে যেকোনও মানুষের মধ্যে উৎসাহ জাগে এবং ভালো কাজে এগিয়ে আসে।’