রহিম আব্দুর রহিম :

ঈদ মানেই আনন্দ। ঈদ মানেই ধনী দরিদ্রের মহামিলন। চাকুরিজীবী, কর্মজীবী, শ্রমজীবী মানুষরা বছরের দু’টি ঈদে আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধবদের সাথে একত্রিত হওয়ার সুযোগ পান। এ ধরণের সুযোগ পাওয়ার একটিই কারণ, ধর্মীয় এই উৎসব দু’টোতে একত্রিতে ছুটি পাওয়ার সুযোগ থাকায় এমনটা ঘটে। শৈশব, কৈশরের বন্ধু-বান্ধব ঈদ ঘিরে সমবেত হয়। ভারী হয় স্মৃতিরপাতা, এটাই সামাজিক বন্ধন। যে বন্ধন ‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য’ এই মহান উক্তিটির বাস্তবায়ন ঘটায়। আত্মার টানেই বলি, আর নাড়ীর টানেই বলি না কেন? মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব এখানেই স্বার্থক। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’ এই মানুষের সুখ-দু:খ, হাসি-কান্না, চলাফেরা নিয়ে ইলেকট্রনিক্স, প্রিন্ট মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগের শতশত কর্মী দিবা-রাত্রী সংবাদ পরিবেশন করে সমাজ, রাষ্ট্র প্রতিচ্ছবি, প্রতিধ্বনি আয়নারমত সমাজের রন্ধে রন্ধে প্রেরণ করছে। আমি প্রতিটি ঈদে সংবাদকর্মীদের প্রতিদিনের সংবাদ পাঠ করে, চ্যানেল দেখে ঈদ উপভোগ করার চেষ্টা করি। আমিও আমার জন্মস্থান থেকে প্রায় ৪৫০কিলোমিটার দূরে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করি। আমারও নাড়ির টানে বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছে হয় এবং নিয়মিতই যাই। তবে ঈদের ১০দিন আগে অথবা ঈদের পরে। ঈদ উৎসবকে কেন্দ্র করে নাড়ির টানে বাড়ি যাওয়ার জন্য বাদঝোলা, বাড়তি ভাড়ায় বাড়ি যাওয়া পছন্দ করি না। বিষয়টি আমার একান্তই ব্যক্তিগত। এছাড়া আমি কোন বিখ্যাত মানুষও নই যে, আমি বাড়ি না গেলে সমাজের কোন ক্ষতি হবে। আমার মনে হয়-ঈদ উৎসবকে কেন্দ্র করে শিক্ষিত, কর্মজীবী মানুষদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নাড়ির টানে বাড়ি যাওয়ার এই অস্বাভাবিক যুদ্ধে নামাটা ঠিক নয়।

অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার ঈদে ঘরমূখো মানুষের দূর্ভোগ নেই, এমন সংবাদ অনলাইন পোর্টাল ও টিভি চ্যানেল বার বার প্রচার হচ্ছে। এধরণের ইতিবাচক সুশৃংখল যাত্রা পর্ব সত্যিই আনন্দ দায়ক বলেই মনে হচ্ছিল। রাস্তায় পুলিশ, র‌্যাব, মন্ত্রী মিনিস্টার, পুলিশের আইজিপি, র‌্যাবের ডিজি সত্যিই ভাল লাগছে। সিডিউল অনুযায়ী চলছে ট্রেন, রাস্তায় নেই জ্যাম, তবে গাড়ির ধীরগতি খারাপ নয় বরং নিরাপত্তারই বিষয়। বিগত ১০ বছরের ব্যবধানে এবারের ঘরমুখো মানুষের যাত্রা সুখময় বলেই মনে হচ্ছে। তবে একটি ট্রেন ৫ ঘন্টা পরে ছাড়া হয়েছে বলে সংবাদ প্রচার হয়েছে। যা একমণ দুখে ১ ফোটা বিষের ন্যায়। সমাজের প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় শ্রেণির নাগরিকরা হুড়োহুড়ি করে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছে, তারা সচেতন। সময়মত বাস-ট্রেনের টিকেট তারা আগে ভাগেই ক্রয় করেছে। অথচ যে সমস্ত শ্রমিকদের রক্ত ঘামে এদেশের মানুষের জীবন যাত্রার পুষ্টি সাধন হচ্ছে-সেই সমস্ত গার্মেন্ট শ্রমিকদের ঈদে বাড়ি ফেরা অনিবার্য। কিন্তু তারা কোথায় কখন টিকেট বিক্রি হয় বা পাওয়া যায় তা তারা জানেন না। এই সমস্ত শ্রমিকরা শ্রম দেন বেশী, ছুটি এবং বেতন পান কম, ফাঁকি দেওয়ার নেই কোন সুযোগ। এই মানুষরাইতো দুই ঈদে বাড়ি যাবে এটাই সত্য। তাদের নিবিঘেœ বাড়ী যাওয়া নিশ্চিত করার মধ্যেইতো মহা আনন্দ। এত সুন্দর ব্যবস্থাপনার মাঝেও এবারের ঈদে কিছু শ্রমিক গাড়ী না পেয়ে সিমেন্ট ভর্তি ট্রাকে করে বাড়ি ফিরতে গিয়ে ট্রাক উল্টে আত্মহুতি দিতে হলো। একজন বা দুইজন নয় ১৭টি তাজা প্রাণ। যাদের বয়স ৯ থেকে সর্বোচ্চ ৩৫। তারা কেন সিমেন্টভর্তি ট্রাকে উঠলেন, ট্রাক ড্রাইভার কেন তাদের সিমেন্ট ভর্তি ট্রাকে উঠালেন, পুলিশ কেন ট্রাক ড্রাইভার এবং ওই যাত্রীদের বাঁধা দিলেন না। ধরে নিলাম ট্রাকটি যখন ঢাকা ছেড়ে আসছিল পুলিশ তা দেখেনি। সুদূর ঢাকা থেকে রংপুরের পীরগঞ্জ পর্যন্ত একবারও কি পুলিশের চোখে সিমেন্ট ভর্তি ট্রাকে যাত্রী আছে, তা লক্ষ করেনি? মানবতা আর আইন এক জায়গায় গুলিয়ে ফেললে, সভ্যতা টিকে না।

এব্যাপারে আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক, পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মন্তব্য করেছেন- ‘যাত্রীদের অসাবধারণতায় এই দূর্ঘটনা। সামান্য কিছু অর্থ বাঁচাতে গিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা ওই ট্রাকে যাচ্ছিলেন, তিনি তাঁর বক্তব্যে আরও বলেছেন, এই ট্রাক ফিটনেস্ বিহীন। অন্য একটি পত্রিকায় বলেছেন ড্রাইভার ঘুমাচ্ছিলেন, তার সহকারি ট্রাক চালাচ্ছিলেন। সবার মন্তব্য, বক্তব্যই সত্য, গ্রহণযোগ্য। আইজিপি এ,কে,এম শহীদুল হক বলেছেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গাড়ির ছাদে এবং ট্রাকে উঠবেন না। জীবন সম্পর্কে যারা সচেতন নয়, তাদের কাছে এ নির্দেশ হাস্যকর। র‌্যাবের ডিজি বে-নজীর আহমেদ বলেছেন – কিছু কিছু লঞ্চ অতিরিক্ত যাত্রী বহন করছে। প্রশ্ন যা কিছুই হচ্ছে সবকিছুই নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে আইন কেন কঠোর হচ্ছে না। যাই কিছু হোক না কেন? অন্যান্য বছরের চেয়ে এ বছর ঈদে ঘরমূখো মানুষদের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্টরা যে রাস্তায়, রেলস্টেশনে, লঞ্চঘাটে শ্রমিকের মত মানবের সেবা তাঁরা সময় দিচ্ছেন তাদের এ ধরণের কর্মকে সাধুবাদ জানাই। রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার কলাবাড়ি এলাকায় ট্রাক উল্টে ১৭ জনের মৃত্যু, কালিয়াকৈরে ট্রাক-লেগুনার সংঘর্ষে আরও ৪ জনের মৃত্যু দু:খ জনক। দূর্ঘটনা স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, অস্বাভাবিক।

সামাজিক দায়-বদ্ধতা বলে একটি মানবিক বিষয় রয়েছে। ওই বিষয়ের মধ্যেই পড়ে সমাজের দু:স্থ, খেঁটে খাওয়া মানুষকে অর্থ, শ্রম, বিবেক, বুদ্ধি দিয়ে সেবা দেওয়ার। যেটি শুধুমাত্র এনজিও এবং ব্যাংক সেক্টরের মধ্যেই কিছুটা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সাবেক বাংলাদেশ ব্যাংক গর্ভনর ড. আতিউর রহমানের সময় যেটা পুরোদমে ছিল তা এখন খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছে। কথায় বলে- ‘কাজীর গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নাই’। আমাদের ভাল করেই মনে আছে, গত বিশ্ব ইস্তেমায় চলচিত্রের খলনায়ক ডিপজল বিশ্ব ইস্তেমায় মুসল্লিদের যাতায়াতের জন্য তার মালিকানাধীন ১শত বাস ফ্রি সার্ভিস দিয়েছে। হানিফ, নাবিল, শ্যামলি, কেয়া নামক শত শত গাড়ির মালিকরা খেঁটে খাওয়া গার্মেন্ট শ্রমিকদের দু’টি ঈদে সামাজিক দায়-বদ্ধতায় তাদের উল্লেখযোগ্য পরিমাণের পরিবহন, সরকারের বিআরটিসি, ট্রেনের কিছু কোচ সরকার এবং ধনাঢ্য এই পরিবহন ব্যবসায়ীরা সমন্বয় করে গার্মেন্ট শ্রমিকদের জন্য সার্ভিস দেয়, তবে এই শ্রমিকদের সিমেন্টভর্তি ট্রাকে উঠতেও হতো না, অকালে তাদের প্রাণও যেত না। পরিবহন মালিকদের সামাজিব দায়বদ্ধতা কোথায়! বরং ঢাকা থেকে নীলফামারী পর্যন্ত হানিফ এসি কোচের ভাড়া ১২শ’র জায়গায় ২৪শ টাকা নেয়া হয়েছে। একটি টিকেট ফেরৎ দেওয়ার জন্য ২দিন তাদের সাথে যোগাযোগ করে তা ফেরৎ দেওয়া সম্ভব হয়নি। এ সংবাদটি বাংলাদেশ হাইকোর্টের মেহেরাব হাসান মামুন নামের এক শিক্ষানবিশ তরুণ আইনজীবী ফোনে জানিয়েছে। আমরা দলমত নির্বিশেষে মানুষের জন্য কাজ করার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে চাই। সামাজিক দায়বদ্ধতায় কোন রাজনীতি নয়, মানুষের কল্যাণের জন্য। শৃংখলা, অস্বাভাবিক মৃত্যু ঠেকাতে আইনের যথাযথ প্রয়োগে মানবিক আবেদন উপেক্ষিত হোক এমনটাই কামনা করছি। এবারের ঈদে রেলপথ, সড়কপথ, নদীপথের সাথে সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি সবাইকে সাধুবাদ জানিয়ে পীরগঞ্জের নিহতদের ঈদের আনন্দের আত্মচিৎকার ডিপজলদের মত সমাজসেবীদের অনুপ্রেরণা আরও বেগবান হোক এমনটিই কামনা করছি।

লেখক, শিক্ষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

+৮৮০১৭১৪২৫৪০৬৬