মোহিব্বুল মোক্তাদীর তানিম

জাতীয় নির্বাচনের হাওয়া শুরু হয়েছে বেশ কিছুদিন আগে থেকেই। বিগত কয়েক মাস ধরেই প্রধানমন্ত্রী সহ সরকারী অনেক সাংসদ, মন্ত্রীরা সভা, সমাবেশে ভোট চাওয়া শুরু করেছেন। এ যাত্রায় সংসদের বাইরের বিরোধী দল বিএনপি একটু পিছিয়েই ছিল। প্রথাগত সভা-সমাবেশের অনুমতি না পাওয়া, নেতা-কর্মীদের মামলা-মোকদ্দমার ভয় সহ দীর্ঘদিন ক্ষমতায় না থাকার হতাশা আচ্ছন্ন করে রেখেছে জনসমর্থন নির্ভর অন্যতম এই রাজনৈতিক দলকে। এর উপর নতুন ভোটারদের আকর্ষণ করার মত দিকনির্দেশনা ও দিতে পারছিলনা দলটি। দলের হাইকমান্ডে ক্যারিশমাটিক তরুণ নেতৃত্বের অভাব অনেকদিন ধরেই চিহ্নিত। জাতীয় নির্বাচনের বছরখানেক আগে ২০৩০ সালের রোডম্যাপ ঘোষণা নির্বাচনের হাওয়ার নতুন পাল বলে ধরেই নেওয়া যায়।

২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের অর্থনীতি, সমাজ এবং রাজনীতিকে বিএনপি কোথায় নিতে চায়, বুধবার তার একটি রূপকল্প দিয়েছেন দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। একানব্বইতে গনতন্ত্র আসার পর দুদফায় পূর্ণমেয়াদে ক্ষমতায় থাকার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন দেশের অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের ভিশন বা রুপকল্প ঘোষণা তে প্রতিক্রিয়া হবে , সরকারী দল সমালোচনা করবে – এটাই স্বাভাবিক। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ের পিছনে তৎকালীন মহাজোটের “ভিশন ২০২১” অন্যতম প্রভাবক ছিল ও তরুণদের আকর্ষণ করেছিল। বৈশ্বিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে দীর্ঘমেয়াদী বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা করাটা সুস্থ রাজনীতির অন্যতম হাতিয়ার।

বেগম জিয়ার ভিশন ২০৩০ শিরোনামের লিখিত বক্তব্য শেষ হতে না হতেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এর প্রশংসা, প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে জোরালোভাবে। তবে সমালোচনার সব তকমাকে ছাপিয়ে গেছে সরকারী কিছু দায়িত্বশীল ব্যক্তি বর্গের প্রতিক্রিয়া। বেগম জিয়ার বক্তব্য শেষ না হওয়ার আগেই অনেকটা কৈশোরশুলভ বাল্যিখেলাপনে ফেসবুকে ব্যঙ্গার্থক শ্লেষমূলক স্ট্যাটাস দেওয়া শুরু করলেন বর্তমান সময়ের তারুণ্যের আইডল খ্যাত একজন প্রতিমন্ত্রী। বেগম জিয়া তাঁর ভিশনে 3G (Good Governance, Good Government এবং Good Policy) বুঝালেও ঐ প্রতিমন্ত্রী টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তি (3G) হিসেবে ধরে শ্লেষাত্নক স্ট্যাটাস দেন। শুধু তাই নয়, খালেদা জিয়ার ২০৩০ সালের মধ্যে মাথাপিছু আয় ৫০০০ ডলার কে পড়তে গিয়ে ৫০০ ডলার বলায় সেই সু্যোগ টি নিতেও ছাড়েনি তরুণ এই মন্ত্রী। অথচ, পরের দিন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেছেন- খালেদা জিয়ার এই নতুন রূপরেখা দেশের জন্য ভাল। কয়েক ঘন্টার মধ্যে এ ধরণের প্রতিক্রিয়ায় মনে হতেই পারে- বেগম জিয়ার ভিশন ২০৩০ এর ঝাঁজ ভালই আছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তরুণদের প্রতিক্রিয়ায় মনে করা যেতে পারে – বাংলাদেশের অনেক তরুণ এই ভিশনে উৎসাহিত হবে। যে তরুণরা বিএনপিকে সমর্থন করেন, তারা রাজনীতিতে সক্রিয় হবে। প্রযুক্তি বিমুখ বলে বিএনপি’র যে তকমা ছিল তা কিছুটা কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করেছে দলটি – তাদের ভিশনের মাধ্যমে। বিশেষ করে ২০৩০ সালের মধ্যে তথ্য প্রযুক্তি খাতকে প্রধান রফতানি খাত হিসেবে পরিকল্পনায় রাখায় উৎসাহিত হবে প্রযুক্তি নির্ভর তরুণ প্রজন্ম।

ধর্মঘেষা ও কিছুটা সাম্প্রদায়িক চেতনার হিসেবে সমালোচনাটুকু ও কাটিয়ে উঠার প্রচেষ্টা আছে এই রুপকল্পে। বিশেষ করে রংধনু (Rainbow) জাতি হিসেবে প্রতিষ্টা করার পরিকল্পনা টুকু আকর্ষণীয় ও নতুন। এই পরিকল্পনানুযায়ী দেশের যে কোন গোত্র, ধর্ম, বর্ণ সমানভাবে অধিকার আদায় করতে পারবে।

বেগম জিয়ার ভিশন ২০৩০ এর ঝাঁজ সবচেয়ে বেশি এসেছে – প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা সংকুচিত করার পরিকল্পনা থেকে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম সাবেক কোন প্রধানমন্ত্রী স্বীকার করলেন, বাংলাদেশের সংবিধান মোতাবেক প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা বেশি। রুপকল্পে সংবিধানিক বিষয়ে যে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনার কথা বলা হয়েছে তা হলো প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাস করে প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতার ক্ষেত্রে ভারসাম্য আনা, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ করা , সংবিধানের বিতর্কিত ও অগণতান্ত্রিক বিধানাবলি পুনঃসংস্কার, সরকারি হিসাব কমিটিসহ সংসদের গুরুত্বপূর্ণ স্থায়ী কমিটির সভাপতির পদ বিরোধী দলকে দেওয়া। বাংলাদেশের বাস্তবতায় এ ধরণের আশ্বাস বা পরিকল্পনা ক্ষমতায় আসার আগে অনেকেই বলে, কিন্তু যেই ক্ষমতা কুক্ষিগত সেই বেমালুম ভুলে যাওয়া হয়।

২০০৮ সালে আওয়ামীলীগ ঘোষিত ভিশন ২০২১ এর অনেক অংশের সংগেই সম্পূরক ভাবে মিল রয়েছে বিএনপি ঘোষিত ভিশন ২০৩০ এর। বিশেষ করে, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ, সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ, উগ্রবাদ, অর্থনৈতিক পরিকল্পনা, শিক্ষা ও মানবসম্পদ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, স্থানীয় সরকার, কৃষি ও কৃষক, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ইত্যাদিতে যেসব অঙ্গীকার প্রতিধ্বনিত হয়েছে তা বর্তমান সরকারের রূপকল্পের সঙ্গে অনেকাংশেই মিলে যায়। ২০৩০ সালের মধ্যে জিডিপি দু অংকে পৌছানোর বাস্তবসম্মত অভিলাস রয়েছে এই রুপকল্পে। এই ভিশনের অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির ৫+৫ শতাংশ বরাদ্দের প্রতিশ্রুতি রয়েছে এতে।

ঘোষিত ভিশনে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে বাক্যটি উল্লেখ করা যেতে পারে “ বিএনপি বিশ্বাস করে, আমাদের সীমান্তের বাইরে বাংলাদেশের বন্ধু রয়েছে, কোন প্রভু নেই।“। মাথাপিছু আয় ৫০০০ ডলার করার আশ্বাস থাকলেও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা উল্লেখ নেয়। ভিশনে তথ্য প্রযুক্তি খাতে উল্লেখ করেছে “ বর্তমান সরকার ICT সেক্টরে উন্নয়নের বাগাড়ম্বর করলেও বাস্তব চিত্র সুখকর নয়।“ রুপকল্পে ২০৩০ সালের মধ্যে তথ্য ও প্রযুক্তি খাতকে সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাতে রূপান্তর করার কথা লিপিবদ্ধ আছে। ভিওআইপি (VOIP) কে উন্মুক্ত করার কথা উল্লেখ আছে এতে। তথ্য প্রযুক্তি খাতের কাল আইন ৫৭ ধারা বাতিলের কথা বলা হয়েছে এতে। তথ্য প্রযুক্তি খাতকে বিএনপি’র বিশেষ অগ্রাধিকার খাত হিসেবে উল্লেখ করা হলেও ই-গভর্ন্মেন্টের (E Government) এর কথা উল্লেখ নেয় এতে।

আন্তর্জাতিক নদী আইন অনুযায়ী বাংলাদেশে বহমান আন্তর্জাতিক নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে বিএনপি আঞ্চলিক ও পারস্পরিক সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে আলাপ-আলোচনার উদ্যোগ গ্রহণ করার কথা উল্লেখ থাকলেও তিস্তা চুক্তির বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু উল্লেখ নেয় এতে। সমুদ্রের উদ্ভিদ ও প্রাণীসম্পদের মজুদ নির্ভর নীল অর্থনীতির আকাংখার (blue economy) উল্লেখ রয়েছে এই ভিশনে।

ধারণা করা হয়, বিএনপি শাসনামলের সবেচেয়ে অবহেলিত খাত ছিল বিদ্যুৎ খাত। ভিশনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০৩০ সাল নাগাদ ৩৫০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় কুইকরেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র কে স্বচ্ছতায় আনার পাশাপাশি বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী মুল্যে সরবরাহ করার স্বপ্ন দেখানো হয়েছে এই রুপকল্পে।

পর্যটন খাত নিয়ে গৎবাঁধা স্বপ্ন দেখানো হয়েছে। এই রুপকল্পে পর্যটন খাতকে বিশেষভাবে মূল্যায়িত করা হয়নি।যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে কোন পরিকল্পনা নেয় এই রূপকল্পে। তথ্য প্রযুক্তি খাতকে গুরুত্ব দেওয়া হলে ও সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে বিশেষ কোন পরিকল্পনার উল্লেখ করা হয়নি।

আগেই বলেছি, ২০০৮ সালের নির্বাচনের জয়ের পিছনে বিশেষ প্রভাবক ছিল আওয়ামীলীগ ঘোষিত তখনকার ভিশন ২০২১। গত ১০ বছরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ তাদের এ রূপকল্পের মাধ্যমে রাজনীতির মাঠে সুবিধা আদায় করে নিয়েছে। কিন্তু এর বিপরীতে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি’কাছ থেকে এ ধরণের কোন পরিকল্পনা শোনা যায়নি। দেরিতে হলেও দলটি হয়তো এখন অনুধাবন করেছে যে তাদের প্রতিপক্ষের সাথে তাল মিলিয়ে রাজনীতি এবং ভোটারদের উপর প্রভাব বিস্তার করতে হলে একটি রূপকল্প উপস্থাপন করা জরুরী।

তাই বিএনপি ঘোষিত এই ভিশনকে সরকারী দলের নেতারা ভ্রান্তিবিলাস, মেধাশূন্য প্রলাপ, ভাঁওতাবাজি সহ নানা উপমা দিলেও সরকার যে বিএনপি’র এই স্ট্রাটেজি নিয়ে বিশেষভাবে চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন – তা তরুণ প্রতিমন্ত্রীর বাল্যিখেলাপনা দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখলেই বুঝা যায়।

ভিশনের এই ঝাঁজ জনগণের কাছে তখনই পৌছুবে যদি বিএনপি আগামিতে এই ঘোষণা অনুযায়ী তাদের পরিকল্পনা পরিচালিত করে। আর সরকারী দল যদি তাদের আত্ন-অহংকারে ভোগা মন্ত্রীদের কথার লাগাম নিয়ন্ত্রণ করতে না পারেন – তাইলে ভোটের রাজনীতিতে পিছিয়ে পরবেন বৈকি।

দেশের মানুষের জন্য বিশেষ পাওয়া হবে যদি রাজনীতিবিদ রা তাদের স্বঘোষিত ভিশনের ব্যপারে আন্তরিক থাকে মনে-প্রাণে।

মোহিব্বুল মোক্তাদীর তানিম, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ