আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে একদিন দুইদিন করে আজ শততম দিনে পা রেখেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২০ জানুয়ারি শপথ নিয়ে চার বছরের জন্য ক্ষমতায় আসা ট্রাম্প মাত্র ১শ’ দিনেই যে পরিমাণ ‘সাংবিধানিক দুর্যোগ’ ঘটিয়েছেন, তাতে বাকি দিনগুলো নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা।

ট্রাম্পের ‘মধুচন্দ্রিমা’র অবস্থা খুবই খারাপ মন্তব্য করে সিএনএনের বিশ্লেষক জেনিফার গ্র্যানহোম বলেছেন, ‘হানিমুনে’র যার এই অবস্থা, তার ‘বিয়ে বিচ্ছেদ’ হতে বেশি দেরি নেই!

‘সংবিধান লঙ্ঘন না করার প্রতি তার (ট্রাম্পের) কোনো আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না,’ বলেন নীতিগত পর্যবেক্ষক প্রতিষ্ঠান সিটিজেনস ফর রেসপনসিবিলিটি অ্যান্ড এথিক্স (ক্রু)-এর ওয়াশিংটন ডিসি’র যোগাযোগ বিষয়ক পরিচালক জর্ডান লিবোউইজ।

এ ধরণের নীতিবহির্ভূত সিদ্ধান্ত ও কর্মকাণ্ডের কারণে ট্রাম্পের প্রথম ১শ’ দিনের মধ্যেই তার বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানটি প্রায় শ’খানেক অভিযোগ দায়ের করেছে বলে জানায় নিউ ইয়র্ক ডেইলি নিউজ। তার মধ্যে সরাসরি মামলাও রয়েছে কিছু।

এমনকি ট্রাম্পের অভিসংশনও যে কোনোদিন হতে পারে বলেও ধারণা এই বিশ্লেষকদের।

হানিমুন থেকে বিয়ে বিচ্ছেদ
নির্বাচনী প্রচারণার সময় প্রথম ১শ’ দিনে ১০৩টি এজেন্ডা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ক্ষমতা গ্রহণের পর সেগুলোর মধ্য থেকে মাত্র ৬টি বাস্তবায়ন করতে পেরেছেন তিনি। তাও আবার সবগুলোই সম্ভব হয়েছে তার নির্বাহী ক্ষমতাবলে জারি আলোচিত আদেশের মাধ্যমে। এবার তেল উত্তোলন বিষয়ে আরও একটি নির্বাহী আদেশ জারি করেছেন তিনি।

যে কোনো নতুন রাষ্ট্রনায়কের ক্ষেত্রে শপথ গ্রহণের পর প্রথম ১শ’ দিনকে বলা হয় তার শাসনব্যবস্থার ‘হানিমুন’ বা মধুচন্দ্রিমা পর্যায়। এ সময়টিতে ওই রাষ্ট্রনায়ক তার প্রতিশ্রুত গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো কতটা এগিয়ে নিতে পারল এবং নিজের ভাবমূর্তি কেমন তৈরি করতে পারল।

বারবার আগে-পিছে না ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়ে সবার অসন্তোষের পাশাপাশি নিজ দলের সদস্য রিপাবলিকানদের চোখেও বিরক্তি হয়ে ধরা দিচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এমনকি রিপাবলিকান-নিয়ন্ত্রিত নিজের কংগ্রেসের কাছ থেকে তিনি প্রথম ১শ’ দিনে একটা আইনও পাস করিয়ে আনতে পারেননি – একটাও না। অথচ এই আইনগুলোকে ‘আমেরিকান ভোটারদের সঙ্গে চুক্তি’ উল্লেখ করে সেগুলো বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছিলেন তিনি।

ট্রাম্পের বড় বড় নির্বাহী আদেশগুলো আদালতের নির্দেশে আটকে আছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার স্বাস্থ্যসেবা নীতি ওবামাকেয়ার-এর বিকল্প যে পরিকল্পনা রিপাবলিকানরা তৈরি করেছেন তা দেশটির ২ কোটি ৬০ লাখ মানুষের কাছ থেকে স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা কেড়ে নেবে।

কিন্তু সেদিকে গুরুত্ব না দিয়ে ট্রাম্প ঝুঁকছেন যুদ্ধের দিকে। তার প্রস্তাবিত নতুন বাজেট শিল্পসাহিত্য থেকে শুরু করে গবেষণার মতো বিষয়গুলো থেকে বরাদ্দ ছেঁটে ফেলছে। এমনকি শিশুদের স্কুল পরবর্তী বিভিন্ন কর্মসূচি, দরিদ্রদের কাজের বিনিময়ে খাদ্য জাতীয় প্রকল্প এবং দরিদ্র নারী-শিশু-কিশোরদের জন্য খাদ্য সরবরাহের জন্য রাখা বরাদ্দও কমিয়ে ফেলা হয়েছে। অন্যদিকে তার কর পরিকল্পনায় কোটিপতিরা লাভবান হচ্ছেন, তাতে চীনের প্রতি আবার ঋণ বাড়ছে।

অথচ তার আগের প্রেসিডেন্ট ওবামা ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজ করেছেন। এর ফলে প্রথম ১শ’ দিনেই দেড় কোটি নতুন চাকরির সুযোগ তৈরি হয় যুক্তরাষ্ট্রে। অটোমোবাইল শিল্প পতনের হাত থেকে রক্ষা পায়, সমান কাজে সমান মজুরির নিশ্চয়তা দিতে লিলি লেডবেটার ফেয়ার পে অ্যাক্ট-এর অধীনে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়, ৪০ লাখ শিশুকে স্বাস্থ্যবীমার অধীনে নেয়া হয় এবং এর সঙ্গে আবার এমন একটি বাজেট পাস করেন ওবামা, যাতে আমেরিকান জনগণের প্রত্যাশা প্রতিফলিত হয়েছিল।

এর আগে রনাল্ড রিগান তার প্রথম ১শ’ দিনে পুরো প্রশাসনের পক্ষ থেকে অ্যাপ্রুভাল (অনুমোদন) রেটিং পেয়েছিলেন ৬৮ শতাংশ, জর্জ ডব্লিউ বুশের অ্যাপ্রুভাল ছিল ৬২ শতাংশ, এরপর বারাক ওবামার ৬৫ শতাংশ। আর সেখানে ডোনাল্ড ট্রাম্প মাত্র ৪০ শতাংশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ১শ’ দিনে সবচেয়ে কম জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট হিসেবে নাম লিখিয়েছেন।

টুইটারখ্যাত প্রেসিডেন্ট
যুক্তরাষ্ট্রের বেশিরভাগ প্রেসিডেন্টকে তাদের বক্তৃতা দিয়ে বিচার করা হয়। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প তার প্রথম ১শ’ দিনে বক্তৃতার চেয়ে বেশি পরিচিত হয়েছেন টুইটবার্তার মাধ্যমে।

সামাজিক মাইক্রোব্লগিং সাইট টুইটারে ব্যাপক সক্রিয় এই প্রেসিডেন্ট মূলত দু’টো টুইটার অ্যাকাউন্ট চালান। একটি হচ্ছে মার্কিন প্রেসিডেন্টের জন্য আনুষ্ঠানিক টুইটার পেজ @POTUS, আর আরেকটা তার নিজস্ব @realDonaldTrump। তবে ট্রাম্প প্রথমটির চেয়ে পরেরটিতেই বেশি সক্রিয় থাকেন। অফিশিয়াল পেজটিতে মূলত কূটনৈতিক কথাবার্তাই থাকে বেশি।

অন্য প্রেসিডেন্টরা যেখানে জ্বালাময়ী বা আবেগঘন বক্তৃতা দিয়ে মানুষের সামনে নিজের ভাবমূর্তি তৈরি করেছেন, সেখানে ট্রাম্প বেশি ব্যবহার করেছেন টুইটার। তার টুইট কখনো শেয়ারবাজারে ঝড় তুলেছে, কখনো ট্রাম্প নানা ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলেছেন সরাসরি। কখনো আবার তিনি নিজের দলকেই টুইটবার্তায় হামলা করে নিজের শাসনব্যবস্থার দুর্বলতাকে দেখিয়ে দিয়েছেন।

এমনকি হোয়াইট হাউজে যাওয়ার পঞ্চম দিনেই ট্রাম্প নির্বাচনে বিশাল ভোট কারচুপি হওয়ার অভিযোগ করেন। প্রতিদ্বন্দ্বী হিলারি ক্লিনটন জনগণের ভোটে ট্রাম্পের চেয়ে ব্যাপক ব্যবধানে এগিয়ে ছিলেন। সেটা অস্বীকার করতেই ভোট কারচুপির অভিযোগ টুইটারেই করেন ট্রাম্প।

এসব ছাড়াও মেক্সিকোর সঙ্গে সীমান্তে মেক্সিকোর টাকায়ই দেয়াল নির্মাণ থেকে শুরু করে সাতটি

দিনের বিরাট একটা সময় স্মার্টফোনের সামনেই কাটান ট্রাম্প

মুসলিমপ্রধান দেশ থেকে মানুষের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা এবং প্রতিপক্ষদের গালিগালাজসহ শর্ত না মানলে বিভিন্ন দেশের ওপর হামলা চালানোর হুমকি দেয়ার কাজটাও ট্রাম্প নিজেই সেরেছেন টুইটারের মধ্য দিয়ে।

তবে শিখছেন ট্রাম্প
নানারকম উল্টোপাল্টা এবং অপ্রত্যাশিত সিদ্ধান্ত নিয়ে একের পর এক সমালোচনার মুখে পড়ছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অঙ্গনে ভিন্নতার আভাসও পাচ্ছেন অনেকে।

নির্বাচনের আগ থেকে এখন পর্যন্ত বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন, ট্রাম্প অতীতে রাজনীতিক ছিলেন না, ট্রাম্প ব্যবসায়ী। তাই তিনি রাজনীতিকের মানসিকতা দিয়ে ভাববেন না। তার চিন্তা, তার সিদ্ধান্ত হবে ভিন্নধর্মী, নতুন। হয়তো এর মধ্য দিয়েই একসময় যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর ভবিষ্যৎ আসবে।

আমেরিকান রাজনীতি বিষয়ক আলোচক ও লেখক কেইলেই ম্যাকইনানি সিএনএনকে বলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প এমন একজন প্রেসিডেন্ট, যিনি দলের আগে জনগণকে নিয়ে ভাবেন। তাই নিজ দলের বিরুদ্ধে যেতেও ভাবেন না তিনি। প্রথম প্রথম কিছু ধাক্কা খেলেও দ্রুতই রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়টি শিখছেন তিনি। আর এর মধ্য দিয়ে শিগগিরই নিজ দল এবং দেশকে ট্রাম্প পাল্টে দিতে পারবেন।

তবে এর মধ্যে ট্রাম্প নিজেই বলেছেন, প্রচারণায় অনেক কিছু বললেও পররাষ্ট্রনীতি আসলে সেভাবে চালানো সম্ভব নয়। রাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র বিষয়ক কাজকর্ম তার ব্যবসার মতো নয়। তাই অন্যদের কাছ থেকে তিনি সাহায্য নিচ্ছেন বারবার। নর্থ কোরিয়া, চীনসহ যেসব দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধ, প্রয়োজনে তাদেরও সাহায্য লাগতে পারে বলে নিজে স্বীকার করেছেন ট্রাম্প।

আর সবার ওপর ট্রাম্প বলেছেন, ‘সবকিছুর পরও আমি ডোনাল্ড ট্রাম্প। এবং আমি এমন সব ধরণের উল্টোপাল্টা কথা বলে এবং টুইট করে যেতে চাই, যা আমাদের মিত্রদের দ্বিধায় ফেলবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাসযোগ্যতাকে আঘাত করবে।’

তাই এই ১শ’ দিনের পরবর্তী দিনগুলো যে কীভাবে কাটবে তা একমাত্র সময়ই বলে দেবে।

তানজীমা এলহাম বৃষ্টি
অনলাইন জার্নালিস্ট, চ্যানেল আই।