॥ জহিরুল ইসলাম ॥

দুর্নীতি দমন কমিশন কক্সবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলাকে দুর্নীতি মুক্ত করা বা দুর্নীতি কমিয়ে আনার জন্য কাজ শুরু করেছেন। দুদক এ উপজেলাকে একটি মডেল উপজেলা হিসাবে বেছে নিয়েছেন। এ লক্ষ্যে দুদক প্রথমে চকরিয়া উপজেলা ভূমি অফিস, সব-রেজিষ্ট্রি অফিস, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও পল্লী বিদ্যুত বিভাগকে বেছে নিয়ে কাজ শুরু করেন। দুদকের এ উদ্যোগে সহযোগিতা দিচ্ছেন টিআইবি, স্থানীয় দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি ও উপজেলা প্রশাসন। উল্লেখিত চারটি সরকারী অধিদপ্তরকে দুর্নীতি মুক্ত করে বা দুর্নীতি কমিয়ে এনে সেবার মান বাড়ানোর উদ্দেশ্যে ইতোমধ্যে দু’টি গণশুনানি (চঁনষরপ যবধৎরহম) অনুষ্টিত হয়েছে। বিগত ২০১৫ সালের ১৪ অক্টোবর চকরিয়ার পুরাতন বিমান বন্দরস্থ বিজয় মেেঞ্চ প্রথম গণশুনানিটি অনুষ্ঠিত হয়। ওই গণশুনানিতে উল্লেখিত সরকারী দপ্তরগুলো’র ব্যাপক দুর্নীতির চিত্র উঠে আসে। গত ১০ এপ্রিল চকরিয়া উপজেলা পরিষদ চত্বরে আরও একটি ফলোআপ গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম অনুষ্ঠিত গণশুনানিতে যারা প্রশ্ন করেছিলেন বা সংশ্লিষ্ট সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীদের বিরুদ্ধে যারা অভিযোগ তুলেছিলেন তাদেরকে এই ফলোআপ গণশুনানিতে আমন্ত্রন জানানো হয়। এই ফলোআপ গণশুনানিতে নতুন করে প্রশ্ন ও অভিযোগ আনারও সুযোগ ছিল। উপস্থিত সকলেই সরকারের এ উদ্যোগের প্রশংসা করে সফলতা কামনা করেছেন। কতটুকু সফল হবে সে ব্যাপারে অনেকে আশংকাও প্রকাশ করেছেন। আশংকা প্রকাশকারীরা বলেছেন; এখানে সংশ্লিষ্ট কিছু সরকারী কর্মকর্তা মূলত দুর্নীতির আসল রূপ বা প্রকৃত অবস্থাকে ঢেকে রাখার চেষ্টা করছেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়েছে আবর্জনা রেখে দিয়ে তার উপর একটি মসৃণ প্রলেপ তৈরীর চেষ্টা করা হয়েছে। ওই মসৃণ প্রলেপ চলমান ঘুষ দুর্নীতি অনিয়ম সম্পর্কে সাধারণের দৃষ্টি এড়ানোর চেষ্টা মাত্র। দুইএকজন (প্রাবন্ধিক সহ) বলেছেন; আমরা ওই মসৃণ প্রলেপকে ফুটো করে দুর্নীতির প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে চাই। দুর্নীতিকে সমূলে উৎপাটন করতে চাই। এখানে কিছু সরকারী কর্মকর্তা বলতে চেয়েছেন, তারা দুর্নীতিকে সহনীয়! পর্যায়ে নিয়ে আসতে চায়। সরকারী কর্মকর্তাদের কেউ ঘোষণা দিতে পারেননি তারা দুর্নীতি করবেন না। চকরিয়ার সহকারী কমিশনার(ভূমি) বলেই ফেলেছেন; তাদেরকে অনেক সময় অবৈধ বালি উত্তোলন বন্ধে অভিযানে যেতে হয়, সেখানে অনেক টাকা খরচ হয়, তার প্রশ্ন খরচের এ টাকা গুলো কে দিবে? তবে কি তিনি বলতে চেয়েছেন এ টাকা আমজনতাকে দিতে হবে? তিনি আরও বলেছেন; দুর্নীতি ৭শত বছর ধরে চলে আসছে। এ কথার মাধ্যমে কি তিনি বলতে চেয়েছেন, দুর্নীতি তাদের নেশা হয়ে গেছে সহজে ছাড়া যাবে না? বক্তারা (প্রাবন্ধিক সহ) বলেছেন; এই দুর্নীতির কোন পর্যায় আমরা সহ্য করবো না। দুর্নীতি কোন পর্যায়ে বা মাত্রায় সহনশীল হতে পারে না। বলা যায় বিদ্যুতের লোড় শেডিং সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসবেন। তা মেনে নেয়া যায়। যেহেতু আমাদের দেশে এখনও বিদ্যুতের কিছু ঘাটতি আছে। অবশ্যই এই ঘটতি আগের চেয়ে বহুলাংশে কমে এসেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে বর্তমান সরকারের অনেক অর্জন আছে। কিন্তু দুর্নীতি সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসার কথা আমাদের দুর্বভাবনায় ফেলে দেয়। এ ধরণের কথাগুলো শুনলে মনে হয় দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষ যাতে জাগতে না পারে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে যাতে মানুষ রুখে দাঁড়াতে না পারে সেজন্য দুর্নীতিকে সহনশীল করে তোলার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির ব্যাপারে জিরো টলারেন্সের কথা বলেছেন। দেশের মানুষ এ পর্যায়ে যেতে চাই। তাহলে দেশের অগ্রগতি আরও দ্রুত হবে।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের এ উদ্যোগ মহৎ। সাধারণ জনগন, সচেতন মহল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী যে কেউ সরকারের এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাবে। জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও মৌলবাদকে আমরা উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিতে প্রতিবন্ধকতা মনে করি। ঠিক একইভাবে ঘুষ, দুর্নীতি, অনিয়মও উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়। এসব কিছু সমূলে উৎপাটন করতে পারলে আমাদের দেশ আরও দ্রুত এগিয়ে যাবে। এতে কারও সন্দেহ থাকতে পারে না। যারা জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ, মৌলবাদ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার মূলত তারা এদেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্যই কাজ করছেন। যারা দুর্নীতি ও অনিয়মকে আড়াল করতে চায়, আসল রূপকে ঢেকে রাখতে চায়। তারা দেশের সার্বিক অগ্রগতিকে সহ্য করতে পারছে বলে মনে হয়না। দুর্নীতির সমালোচনা ও প্রতিবাদ করতে হবে। দুর্নীতিকে না বলতে হবে। এসব সমালোচনা গুলো কোন ব্যক্তি বিশেষকে উদ্দেশ্য মূলকভাবে ঘায়েল করা নয়। মানুষ যতো বেশী দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হবেন, সমালোচনা করবেন ততোই দুর্নীতিবাজরা সর্তক হবেন, দুর্নীতি করতে ভয় পাবেন। এতেই সংশ্লিষ্টরা দুর্নীতি মুক্ত হবেন বা দুর্নীতি অনেকাংশে কমে আসবে। দুর্নীতি লুকিয়ে রেখে দুর্নীতিবাজদের পরিষ্করণ (ঈষবধৎধহপব) করার অর্থই হচ্ছে দুর্নীতিকে সমর্থন করা। দুর্নীতি আগে যে পর্যায়ে ছিল সেই একই অবস্থায় বা পর্যায়ে রেখে দেয়া। চকরিয়ায় দুদকের গণশুনানি চলাকালে কিছু ব্যক্তির বক্তব্য ও ভূমিকা দুর্নীতির পক্ষে গিয়েছে। যা এদিন উপস্থিত সবাই লক্ষ্য করেছেন। চকরিয়া উপজেলার এক শীর্ষ জনপ্রতিনিধির ভূমিকাও এক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। পরবর্তীতে তিনি দুর্নীতিবাজদের পরিষ্করণের! চেষ্টা করছেন। যারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে নির্ভীকতা দেখিয়েছেন তিনি তাদের নিয়ে বিষোদগার করেছেন।

গত ১০ এপ্রিল চকরিয়া উপজেলা চত্বরে অনুষ্ঠিত দুদকের ফলোআপ গণশুনানিতে অনেকে বলেছেন, ২০১৫ সালের ১৪ অক্টোবর চকরিয়া বিজয় মঞ্চে অনুষ্ঠিত গনশুনানিতে যারা যেসব অভিযোগ উত্থাপন করেছিলেন তাদের অভিযোগ গুলোর কোন তদন্ত করেননি সংশ্লিষ্টরা। বরং ওই গণশুনানিতে অংশগ্রহনকারী বা অভিযোগকারীদের অনেককে উল্টো হয়রানির শিকার হতে হয়েছেন। এমন কি সংশ্লিষ্টরা কোন অভিযোগের তদন্ত না করে সত্যতা পাওয়া যায়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন। একেবারেই মনগড়া। এতেই প্রমানিত হয়, তারা আসলে দুর্নীতি মুক্ত হওয়ার জন্য বা দুর্নীতি কমিয়ে আনার জন্য কাজ করছেন না। তারা দুর্নীতি লুকোতে চেয়েছেন। তাদের এ ধরণের ভূমিকায় দুর্নীতি কোন অংশে কমে আসবে বলে মনে হয়না। এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে দুদক কশিনার ড. নাসিরউদ্দিন আহমদ উপস্থিত ছিলেন। তার সামনেই এখানকার সরকারী কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে অনান্তরিকতার কথা উঠে আসে। অনুষ্ঠানের শুরুতে সহকারী কমিশনার (ভূমি) চকরিয়া একটি প্রেজেন্টেশন তলে করেন। অনেকগুলো অপ্রয়োজনীয় কথা বলতে গিয়ে সময় নষ্ট করা হয়েছে। ওই প্রেজেন্টেশনটি তুলে ধরার সময় সহকারী কমিশনার (ভূমি) চকরিয়াকে তার ফেসবুকে কে কি মন্তব্য করেছেন তা তুলে ধরতে গিয়েও সময়ক্ষেপণ করা হয়েছে। আরও কিছু অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে তিনি বেহুদা সময় নিয়েছেন। এরও উদ্দেশ্য আছে। যা উপস্থিত সচেতন মহল বুঝতে পেরেছেন। এদিন বক্তারা বলেছেন; আমরা কথায় নয়, কাজ দেখতে চায়। কথা অনেকে ভাল বলতে পারেন। কিন্তু অনেকের কথা আর কাজে মিল থাকে না। এমনও শোনা যাচ্ছে যারা দুদকের এসব গণশুনানিতে কিছু সরকারী কর্মকর্তা সম্পর্কে অভিযোগ উত্থাপন করেছেন, সংশ্লিষ্টরা তাদেরও খোঁজ খবর নিচ্ছেন। খোঁজ নিচ্ছেন তাদের সহযোগিতা করার জন্য নয়, তাদের খুঁত বের করে হয়রানি করার জন্য। ওই ফলোআপ গণশুনানিতে এসব কথাও অনেকেই বলেছেন।

দুর্নীতি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী। দুর্নীতি দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে প্রধান প্রধান অন্তরায় গুলোর মধ্যে অন্যতম। এই অন্তরায়কে সমূলে উৎপাটন করতেই হবে। এখানে কে কি বললো, আমার কোন ক্ষতি হবে কি না, এসব চিন্তা করলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো যাবে না। প্রত্যেকে যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলতে পারবে তাও নয়। এখানে অনেকে অনেক কিছুই ভেবে দেখেন। হয়রানির শিকার, সম্মান হানি, সম্পদ হানি, নাজেহাল হওয়াসহ নানা ঝুকিও আছে। যারা এতো কিছু না ভেবে কথা বলতে চাইছেন অন্তত তাদের বলতে দেয়া দরকার। তাদের এ প্রতিবাদী কণ্ঠ যারা চেপে ধরার চেষ্টা করছেন তারা মূলত এই দুর্নীতিকে সহযোগিতা দিচ্ছেন। তারা দেশের অগ্রগতি চায় না। তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী। দুদকের মাধ্যমে এ ধরণের গণশুনানি করে সরকারী কর্মকর্তাদের মুখোমুখি করার ব্যবস্থা করে দিয়ে সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলতে সাধারণ জনগণকে একটি সুযোগ দিয়েছে। আমরা এই সুযোগকে কাজে লাগাতে চাই। দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষকে জাগাতে, সচেতন করতে চাই। দুর্নীতির মূল উৎপাটন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। দেশ জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও দুর্নীতিমুক্ত হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ ও ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে উন্নীত হতে অনেক সহজ হবে বৈকি। #

লেখক : দৈনিক যুগান্তর, চকরিয়া প্রতিনিধি।

zahir_chakaria@yahoo.com