অধ্যাপক রায়হান উদ্দিন
প্রকৃত জ্ঞানচর্চায় বই পড়া একটি প্রয়োজনীয় বিষয়। কারন আমাদের ইসলাম ধর্মে রাসুল সা: বলেছেন “তালাবুল ইলমে ফারিদাতুন আলা কুল্লি মুসলিমিন ওয়া মুসলিমাতিন” অর্থাৎ ‘জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিম নরনারীর জন্য ফরজ’। বিশ্ব মুসলিম তথা মানবজাতির জন্য আমাদের রাসুলে করিম (সা:) কাছে প্রথম যে নির্দ্দেশ ছিল “ইকরা” অর্থাৎ পাঠ কর, তোমার প্রভুর নামে যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দেন। জ্ঞান বিকাশের জন্য অনেক হাদিস রয়েছে। তিনি জ্ঞান অর্জনের জন্য সুদুর চিন দেশে যেতে বলেছিলেন। কেউ কেউ বলে থাকেন চিন দেশে রাসুল (সা:) যেতে বলেননি , চিন দেশের মতো দুরবর্তী দেশে যেতে বলেছিলেন। কথাটি ঠিক নয়। কারন চিন দেশে রাসুলে (সা:) নির্দ্দেশে মুসলমানরা গিয়েছিলেন। ছয়জন সাহাবার কবর সেখানে রয়েছে।চিন দেশ তখন শিক্ষা দীক্ষায় খুব অগ্রসর ছিল।

জ্ঞান অর্জন প্রত্যেক মুসলিম নরনারীর জন্য ফরজ। বিদ্যা শুধু পুরুষদের জন্য নয়, নারীদের জন্যও ফরজ ছিল। অবশ্য এখন অনেক জায়গায় দেখা যায় ধর্মের ভুল ব্যাখ্যার জন্য আমরা নারীদের শিক্ষা দিতে চাইনা। মেট্্িরক পাশ করিয়ে কিংবা তারো অনেক আগে মেয়েদেরকে পরের ঘরে পাঠিয়ে দিই। এখন কাজের কথায় আসি , যারা নিয়মিত পড়াশোনা শেষ করে পরীক্ষা পাশ করে জীবিকা নির্বাহের জন্য চাকরী কিংবা অন্য পেশা অবলম্বন করেছেন। শিক্ষা জীবন শেষ হওয়ার পর তারা অনেকে মনে করেন যে, এখন তো ছাত্র নই, সংসারী মানুষ, বই পত্র পড়ার কি দরকার কি। এরকম চিন্তাধারা ব্যক্তির জীবনে এবং জাতীর জীবনে সর্বনাশ ডেকে এনেছে।শিক্ষা জীবন শেষ করে বই পত্র না পড়ার অর্থ দাড়ায় আপনি শিক্ষার পথ ছেড়ে অশিক্ষার পথ অবলম্বন করেছেন।আর কিছু না শেখার পশ্চাদযাত্রা শুরু করেছেন। কাজেই আপনাকে শিক্ষিত লোকের তালিকায় রাখা যায়না। অন্যান্য প্রাণী এবং মানুষের মধ্যে পার্থক্য হলো। মানুষের মন বলে একটা জিনিষ আছে।তার মনন শক্তি আছে।এই মনের নিরন্তর উৎকর্ষ সাধনের জন্য সংগ্রাম করলেই মানব জীবনের সফলতা আসবে।মানুষ পেট পুরে খেতে পায়না এ জন্য সমাজ ব্যাবস্থাই দায়ী , কিন্তু আপনি যে শিক্ষিত লোক বই পত্র না পড়াতে আপনার ক্ষতি হচ্ছেনা বলে মনে করে থাকেন। এতে আপনি আপনার মনকে উপবাসী রাখেন।মনের খোরাক সরবরাহ করেন না।এজন্য সমাজ ব্যবস্থা দায়ী নয় আপনি দায়ী। “দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞানার্জন কর”। এই হাদিসের উক্তি শিক্ষিত লোকেরা উপলব্দি করেন না। যে সব শিক্ষিত লোক বই পত্র পড়েন না তাদের কি শিক্ষিত বলা যায়? অবশ্য কোন কোন বড় আমলাদের অফিসে নান্দনিক দিক বিবেচণা করে সুদৃশ্য তাকে বিভিন্ন প্রতিষ্টানের দানকৃত অনেক বইয়ের সমাহার লক্ষ্য করার মতো। অথচ এ বই পড়ার সময়টুকু তাঁদের নেই বলে মনে হয়।

হালাকু খান যখন বাগদাদ ধ্বংস করেছিল ,তখন সে প্রতিটি বাড়িতে দেখল অর্ধেক ঘর বইতে ভরা । সে জানতে পেরেছিল এই বই গুলি মুসলমানদের উন্নতির কারন। তখন সে নির্দ্দেশ দিয়েছিল সব বই জ্বালিয়ে দিতে। কিন্তু অত বই একসাথে জ্বালানো খুব একটা সোজা ব্যাপার ছিলনা। বাগদাদ শহর ধুয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলো। পরমুহুর্তে হালাকু নির্দ্দেশ পাল্টিয়ে বলল যে সমস্থ বই এখনো পুড়েনি তা নদীতে ফেলে দিতে। এত বই বাগদান নগরীতে ছিল যে , তা নদীতে ফেলতে গিয়ে পানির স্বাভাবিক জলধারা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আমাদের খলিফা যুগে কোন কোন খলিফার ব্যক্তি গত লাইব্রেরীতে চার লক্ষেরও অধিক বই ছিল।মুসলমান স্বর্নযুগের কথা উঠলেই আমাদের স্মৃতিতে জাগে দামেশক, কর্ডোবা,বাগদাদ,গ্রানাডার কথা।স¤্রাট হাকামের ব্যক্তিগত লাইব্রেরীতে বইয়ের সংখ্যাছিল চার লক্ষেরও অধিক।তখন স¤্রাটদের যত বই ছিল, বর্তমানে আমাদের ইসলামিক ফাউন্ডেশানেও এত বই হতে অনেক সময় লাগবে।এত বই রাখার জন্য বর্তমান গুলশান বনানীর অংশবিষেশ দরকার হতো।এখন এই পুর্ব পুরুষদের নিয়ে গর্ভ করা ছাড়া আর কিছু করার নেই।কারন বিগত কয়েকশত বছরে আমরা কি করেছি।এখন শুধু সেমিনার , কনফারেণ্স এবং বিভিন্ন লেখালেখিতে পুর্বপুরুষদের সেই গৌরবগাঁথাই আমাদের সম্বল। জ্ঞান বিজ্ঞানে আমরা এতো অনগ্রসর যে এই সমস্থ পুর্ব পুরুষদের নিয়ে আলোচনা করতেও আমাদের বাঁধে। বাগদাদ কর্ডোভায় অনেক ধনীদের কাছে লক্ষ লক্ষ বইয়ের লাইব্রেরী ছিল। আমাদের গুলশান বনানীতে অনেক কোঠিপতি রয়েছেন।অনেক আধুনিক ঘর বাড়ী রয়েছে। কার বাড়ীতে কয়টা বই আছে।তারা এতোই ব্যস্ত, বই পড়ার সময় নেই।আমাদের পল্লীগানের ধারক আব্বাসউদ্দিনের ছেলে মোস্তফাজামান আব্বাসের “চর্যাপদ থেকে ফিউশান মিউজিক” একটা বইয়ের মুখবন্ধে তিনি বলেছেন, আমাদের দেশে গুনীদের নিয়ে নুন্যতম জ্ঞানও শিক্ষিত লোকের মধ্যে বিরল। লেখাপড়া জানা ইঞ্জিনিয়ার আমাকে সেদিন বললেন, হা্যঁ ভাই , এটা কি সত্যি নজরুলইসলাম লেখাপড়া শেখেননি? ‘থ’ হয়ে গেলাম।ভদ্রলোকের দিকে অনেক্ষন তাকিয়ে থাকলাম। উনি ইঞ্জিনিয়ার,বেশ ভাল টাকা পয়সা করেছেন,বাড়ি ঘর ,গাড়ি বাড়ি, বাগান, দারোয়ান , ক্লাবের মেম্বার,অথচ নজরুল সম্বন্ধে তিনি কিছুই জানেননা। পরে আমি বহু লোককে নজরুণ সম্বন্ধে প্রশ্ন করলাম, দেখলাম সব একই গোয়ালের গরু।” তাই ভাবলাম এই গরুদেরকে শিক্ষা দান করার জন্য বই পড়া খুব প্রয়োজন এবং তার জন্য এই সব বই মেলার প্রয়োজন। যাতে একটু হলেও কিছু বোধের উদয় হয়।
ই-মেইল: raicox17@gmail.com