রহিম আব্দুর রহিম

২৪ -২৬জানুয়ারি-২০২৩জেলা প্রশাসক সম্মেলন ঢাকায় অনুষ্ঠিত হলো। মাঠ পর্যারের প্রশাসকদের সাথে অনুষ্ঠিত গুরুত্বপুর্ণ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর সাথে খোলামেলা কথা বলার সুযোগ পেয়েছেন জেলা প্রশাসকরা।এধরনের সমাবেশ, সরকার প্রধানের রুটিন ওয়ার্ক।তবে প্রধানমন্ত্রীর সাথে জেলা প্রশাসকদের খোলামেলা কথা বলার বিষয়টি শেখ হাসিনা সরকারের আমলেই সম্ভব,কারণ বঙ্গবন্ধু নিজেও প্রশাসন-জনগণকে এককাতারে মেপেছেন।যা তাঁর সন্তান ধারন করবেন এটাই সত্য। এই সম্মিলনে জেলা প্রশাসকরা প্রায় ২৪৫টি প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন,যুক্তিযুক্ত প্রস্তাবনাগুলো সরকার হয়তবা পূরণ করার চেষ্ঠা করবেন।কিন্তু অযৌক্তিক প্রস্তাব সরকার মানতে পারেন না,আবার অযৌক্তিক প্রস্তাব তৃণমূলের শক্তিশালী সরকার যন্ত্র ‘প্রশাসনে’র উত্থাপনও করাটাও ঠিক নয়,হাস্যকর।২৪৫টি প্রস্তাবের মধ্যে ২৫জানুয়ারিতে শিক্ষামন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে একটি প্রস্তাব করা হয়েছে।যার সারসংক্ষেপ, “এমপিও ভুক্ত শিক্ষকরা সাংবাদিকতা,রাজনীতি, ঠিকাদারী করতে পারবেন না,এতে করে শিক্ষা পরিবেশ নষ্ট হয়।’যা প্রতিরোধে ওই জেলা প্রশাসক একটি নীতিমালার প্রস্তাব করেছেন। বিষয়টি বাস্তবায়নের সায় দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী,এমনটি জানলাম পত্র-পত্রিকার একটি রিপোর্ট-এ।বিষয়টি যদি,’ঘটনা’ হয়,তবে নিশ্চিত বুঝতে হবে, প্রস্তাবকারী ব্যক্তি ‘অঘটনে’র বীজবপন করার জন্যই সরকারের ভেতরে থেকেই সরকারকে ব্যবহার করতে চাচ্ছেন।

অঘটনের বীজবপন বলার কারণ স্পষ্ট,তিনি প্রস্তাব রাখতেন পারতেন, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের সরকার ১০০ভাগ সম্মানী দিচ্ছেন,জাতীয়করণ হলেই শিক্ষকরা রাজনীতি, সাংবাদিকতা করতে পারবেন না।সরকারি চাকুরিবিধি অনুযায়ী একব্যক্তি দুটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকতে পারেন না। কোন শিক্ষকই ঠিকাদারি করে না,কোন কোন শিক্ষক রাজনীতির সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত রয়েছেন।এতে করে শিক্ষা শৃঙ্খলা ব্যবহত হচ্ছে এটা সত্য।সাংবাদিকতার সাথে যারা সম্পৃক্ত তাঁদের কারণে শিক্ষা শৃঙ্খলা ব্যবহত নয়,বরং শিক্ষায় অতিরিক্ত ইনভেস্ট হচ্ছে। প্রস্তাবকারীর অবশ্যই জানা আছে শতবর্ষের সাংবাদিক,সাহিত্যিক এবং আর্দশ শিক্ষক সমাজের ইতিহাস। ৮০শতাংশ শিক্ষকরাই ছিলেন সাংবাদিক। অনেক সাংবাদিকই শিক্ষক ছিলেন না।যিনি প্রস্তাবটি করেছেন, তাঁর উদ্দেশ্য কি জানি না,তবে বলতে পারি,সাংবাদিকতা কোন লাভজনক পেশা নয়,এটা নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর শামিল। আমি একজন এমপিভুক্ত শিক্ষক,লেখালেখি করি দীর্ঘ ২৯বছর ধরে, এখন কি লেখালেখি ছেড়ে দেবো,নাকি চাকুরি ছেড়ে দেবো?

এই ধরনের প্রস্তাবকারী ব্যক্তিদের চিনতে হলে একটু পেছনের দিকে তাঁকাতে হবে।পাক শোষকদের কবল থেকে দেশ রক্ষার অর্ধশত বছর পার, আমরা স্বাধীন দেশের উন্নয়ন দেখছি। তেমনি এই উন্নয়নের ফলাফল ভোগ করছি। ৭০ এর রক্তক্ষয়ের বিনিময়ে আমাদের স্বাধীনতা। আবার ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্টের ন্যাক্কারজনক ঘটনায় আমাদের ‘বেঈমান বাঙালী’ হিসেবে বিশ্বে কলঙ্কিত করেছে। দীর্ঘ দিন ক্ষমতার বাইরে থাকা আওয়মীলীগ ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে সরকার গঠন করে। ওই সময় আওয়ামীলীগ সরকারের উন্নয়ন সাধারণ মানুষের চোখে পড়েনি। তবে বেশ কিছু কঠিন ও সাহসী ভূমিকা গ্রহণ করেছিল, যা পরবর্তীতে দেশের সার্বিক উন্নয়নে ব্যাপক সহায়ক হিসেবে কাজে লেগেছে এবং লাগছে। তৎকালে হাসিনা সরকার সময় পেয়েছে মাত্র পাঁচ বছর। এই স্বল্প সময়ে জনদৃষ্টি পরার মতো রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন কর্মকান্ড পৃথিবীর কোন সরকারের পক্ষেই সম্ভব নয়। ২০০৮ খিস্টাব্দে ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ দ্বিতীয় বারের মতো নির্বাচিত হয়। সরকার গঠন করে ২০০৯ এর ১ জানুয়ারী। চলছে এই সরকারের টানা তৃতীয় বারের মতো ক্ষমতায় থাকার পালা। এক সময়কার জঙ্গী, সন্ত্রাস ও ত্রাসের এই দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সরকারের পুলিশ, র‌্যাব উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। এরপরও একটি মোড়ল দেশের তথাকথিত মানবাধিকার একটি সংগঠন, পুলিশ ও র‌্যাব প্রধানদের তাদের দেশে প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে। যা দুঃখজনক এবং নিন্দনীয়। তার চেয়েও নিন্দনীয় এই পুলিশ র‌্যাবরা উদঘাটন করতে পারেনি এই দুটি বাহিনীকে বিশ্বে বিতর্কিত করার পিছনে কারা কলকাঠি নেড়েছিল। তাদের শক্তির উৎস কোথায়?আমরা তাদের চিনি এবং জানি।

এ সরকার ২০০৯ সরকার গঠন করার পর আমলাদের একটি বৃহৎ অংশ সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে প্রাণপণ চেষ্টা চালায়, কিছু উন্নয়নমূলক কাজে নিরন্তর পরিশ্রম করেন, দেশপ্রেমেরও পরিচয় দেন । ২০১৪ সালের এই সরকারের আমলাদের একটি অংশ দুর্নীতির সাথে জড়িয়ে পড়ে। ২০১৮ সালে নির্বাচনের পর আমলাদের একটি অংশ সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ডের লুটপাটের সাথে যেমন জড়িয়ে পরেছিলেন, তেমনি অন্য একটি অংশ তাঁদের সততা,নিষ্ঠা অক্ষুন্ন রাখার পরিচয় দিয়েছেন।সাংবাদিকতার সুবাধে অনেক সৎ,দেশপ্রেমিক প্রশাসনকে আমরা কাছে থেকে দেখিছি,দেখছি।বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর মূখ্য সচিব মো.তোফাজ্জল হোসেন মিঞা,যিনি তাঁর কর্মকালের ডিসি আমলে তাঁর কার্যালয়ে কোন টাউট-বাটপারদের জায়গা দেননি।স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের বর্তমান সচিব ড.আমিনুল ইসলাম খান, যিনি কর্ম-নিষ্ঠা এবং দেশাত্মবোধের মধ্য দিয়ে তাঁর সততার বহি:প্রকাশ ঘটিয়েছেন।এই আমলা প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রনালয়ের সচিব থাকাকালে সকল প্রকার বাঁধা-বিপত্তি মাড়িয়ে প্রাইমারির সর্বশেষ ৩৭০০০হাজার শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়াটি সুচারুভাবে করে গিয়েছিলেন।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়ার ভাই হিসেবে তাঁর সাথে সর্বসময় যোগাযোগ রাখতাম,সম্প্রতি একান্ত পরিবেশে তাঁর সাথে কথা হয়েছে। তিনি বলেছেন,”প্রধানমন্ত্রী দেশের উন্নয়নের রোল মডেল,এই উন্নয়ন খুবই গতিশীল হবে সেইদিন,যেদিন সারাদেশের জেলা প্রশাসকরা সৎ হবেন,সৎ থাকবেন।”প্রধানমন্ত্রী’র সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ সালাহ উদ্দীনের ডিসি আমলের কর্মকালে যাঁর টেবিলে কখনও কোন ফাইল আটকা থাকেনি,সততার পরীক্ষায় তিনি একশোতে একশো।চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার ড.আমিনার রহমান একজন গীতিকার, দরিদ্র জনমানুষের যিনি আপনজন,নিষ্ঠা ও সততায় সমান্তরাল।বর্তমান সরকারের এলজিডি মন্ত্রনালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোস্তাকিম বিল্লাহ ফারুকী যিনি জেলা প্রশাসক থাকাকালে এবং বর্তমানেও জনমানুষের আমলা হিসেবে পরিচিত। বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আমলের এক মহান জেলা প্রশাসককে দেখেছি।তৎকালীন সরকারপন্থী এই আমলা ক্ষমতাসীন সরকারের সকল রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ওই সময় প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের কাজটি সম্পন্ন করেছিলেন। আমরা এর উল্টোপিঠের আমলে দেখেছি,দেখছি।
বর্তমান সরকারের উন্নয়ন ফিরিস্তি বিশাল, বয়স্ক ভাতা, মাতৃকালীন ভাতা, শিক্ষা ক্ষেত্রে উপবৃত্তি, জনস্বাস্থ, স্যানিটেশন, শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমিয়ে আনা, নারীর ক্ষমতায়ন, সামাজিক নিরাপত্তা, গৃহ এবং ভূমিহীনদের জন্য আবাসন ব্যবস্থা, রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মেট্রোরেল প্রকল্প পায়রা গভীর সমূদ্র বন্দর এই সরকারের আমলে নজীরবিহীন উন্নয়নের দৃষ্টান্ত। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচিত, আলোড়িত উন্নয়ন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু। শত উন্নয়নের আড়ালে আওয়ামীলীগের অনেক নেতা কর্মীরাই দুনীর্তির সাথে জড়িয়ে পরেছে।এমপি-মন্ত্রী,নেতাদের সাথে সিলফি তুলে সামাজিক যোগাযোগে পোস্ট করে রাতারাতি নেতাবনে চলে যাবার সুযোগ পাচ্ছে।ফলে, গাঁজাখোর,নেশখোররাদেরও চাঁদাবাজি করার ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে। সরকারের উচিৎ, সরকার রাষ্ট্রযন্ত্রে ঘাঁপটি মেরে থাকা অসৎ আমলাদের চিহ্নত করে তাদের আলাদা করা।

আওয়ামীলীগের উচিৎ দলে শুদ্ধি অভিযানের।শিক্ষামন্ত্রীর উচিৎ,শিক্ষাগ্রহণ পদ্ধতির সংস্কার নয়, শিক্ষার ভীত শক্তিশালি করণে শিক্ষার উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন এবং বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা ভাবনার প্রতিফলন ঘটানো।যাঁরা শিক্ষকতার পাশাপাশি সাংবাদিকতা করছেন এঁদের মর্যাদা নিশ্চিত করা সম্ভব নয় বরং এমপিভূক্ত সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করে শিক্ষাক্ষেত্রের দীর্ঘদিনের বৈষম্য দূর করা সময়ের দাবী।

(লেখক: শিক্ষক,নাট্যকার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব)