চট্টগ্রামের ফুসফুস খ্যাত সিআরবি’র পূর্ব পার্শ্বে (বর্তমান রেলওয়ে বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, তাসফিয়া রেস্টুরেন্ট, গোয়াল পাড়া) সরকারী-বেসরকারী সংস্থার চুক্তিতে একটি বৃহৎ হাসপাতাল নির্মাণ করতে চাওয়ার প্রতিবাদে সমস্ত চট্টগ্রাম সহ সারা বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যেম ও মিডিয়ায় শক্তিশালী আন্দোলন, প্রতিবাদ কর্মসূচী চলছে। কারণ সিআরবি একটি নির্মল, সবুজাভ, স্বচ্ছ বিশুদ্ধ বাতাসের কারখানা। এখানে নগরবাসী নির্মল চিত্তবিনোদনের জন্য গমন করে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, হাসপাতাল নির্মান করলে শতবর্ষী বহু শিরিষ গাছ কাঁটা পড়বে। এই যৌক্তিক আন্দোলনের প্রতিপক্ষ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। আশা করা যায়, বুদ্ধিজীবি, বিভিন্ন সংগঠন, সাংবাদিক, সুশীল সমাজ এবং সাধারণ মানুষের এই প্রতিবাদের ফলে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ হাসপাতাল নির্মাণের সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে আসবে।

অতীতে আমরা দেখেছি, দিনাজপুরের ফুলবাড়িতে উন্মুক্ত স্থানে কয়লা উত্তোলনের বিপক্ষে দূর্বার জনবিদ্রোহ হয়েছিল। সে আন্দোলনে অনেক সাধারণ মানুষ প্রাণ দিয়েছিল। সম্প্রতি প্রাণ দিয়েছে বাঁশখালীতে এস.আলম পাওয়ার প্লান্ট করতে না দিতে চাওয়া আন্দোলনে। যদিও সেই পাওয়ার প্লান্ট এক ডজনের বেশি প্রাণের বিনিময়ে নির্মাণ কাজ শেষের পথে। এছাড়া আরো দেখেছি সুন্দরবনের কাছাকাছি রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের বিপক্ষে সারা দেশের মানুষের জনবিস্ফোরণ। মানুষ এখনো ঘৃণায় থু থু ফেলে। তবুও রামপাল পাওয়ার প্লান্টের কাজ সমাপ্তির দিকে।

অন্যদিকে চট্টগ্রামের বায়োজিদ লিংক রোড নির্মাণ করতে গিয়ে, জনমানুষের চোখের আড়ালে বা কেউ কেউ জানলেও না জানা ভান করার ফাঁকে মোটামুটি এক শত এর কাছাকাছি পাহাড় কেটে সমান করা সিডিএ নিজেও সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণের বিরোধিতা করছে এই যুক্তিতে শতবর্ষী গাছ কাটা গেলে পরিবেশের ক্ষতি হবে, যদিও খোদ বায়োজিদ লিংক রোড প্রকল্পে পাহাড় কাটার অপরাধে পরিবেশ অধিদপ্তর সিডিএকে ১০ কোটি টাকা জরিমানা করেছিল। এ যেন ধান ভানতে শীবের গীত।

এর সরল মর্মার্থ হচ্ছে, অনেক প্রকল্পে পরিবেশের ক্ষতি হলেও সরকারকে করতে হয় উন্নয়নের চাহিদা পূরণে। যদিওবা সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণ না করে অন্য স্থানে করলে তেমন কিছু আসে যাবে না। কিন্তু চট্টগ্রাম-দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণের কোন বিকল্প ছিল কি?

এক কথায়- ছিল না। ককসবাজারে রেল সংযোগ ছিল কক্সবাজারবাসীর দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন। এতে বাংলাদেশের সর্ব শেষ এই পর্যটন স্বর্গের সাথে যোগাযোগের আমূল পরিবর্তন হবে। পর্যটকদের সাথে সাথে স্থানীয় জনগোষ্ঠী এর সুফল ভোগ করবে বলে আশা প্রকাশ করা যায় নির্দ্ধিধায়। এখানে লক্ষনীয় “পর্যটন স্বর্গ” শব্দটি। কক্সবাজারে এমনিতে পর্যটন স্বর্গ হয়নি। খোদাতায়ালা প্রদত্ত পাহাড়, বনাঞ্চল, নদী, সমুদ্র, ঝর্ণা, দ্বীপ, গাছগাছালি সহ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যটাই পর্যটন স্বর্গ।

প্রশ্নটা এখানে, একটা রেলপথ কি রাতারাতি নির্মাণ করা যায়? এর ফলে পরিবেশের উপর কতটুকু প্রভাব পড়ল? পর্যটন স্বর্গ যে কারণে হলো, সে উপাত্ত বা রিসোর্সের কি কি ক্ষতি সাধিত হচ্ছে বা অদূর ভবিষ্যতে হবে?

আমি জানিনা মনে উদয় হওয়া এই প্রশ্ন প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যানে ধনাত্বক নাকি ঋণাত্বক। তবুও বারবার এই কথাগুলো মনে উঁকি দেয়, নিজেকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। সরকারসহ প্রকল্প বাস্তবায়নকারীদের প্রশ্নবিদ্ধ করায়।

আমরা জানি, বাংলাদেশে যে কয়টি অভয়ারণ্য আছে, ততমধ্যে চুনতী রেঞ্জ, ফাঁসিয়াখালী রেঞ্জ, মেধাকচ্ছপিয়া রেঞ্জ অন্যতম। আমরা এও জানি, চট্টগ্রামের শেষ উপজেলা লোহাগাড়া হতে শুরু হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশে যাওয়া পর্যন্ত সমগ্র কক্সবাজার জেলাটিই পাহাড় আর বনাঞ্চলে পূর্ণ।

রেলনির্মাণ করতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে এই বনাঞ্চলের। যদি আমরা তুলনা দেই সিআরবি’র অন্তত ২০ হাজার গুণ বেশি শতবর্ষী বৃক্ষ ও বনের ছোট বড় গাছ এই প্রকল্পে কাটা পড়েছে। চুনতি, হারবাং, খুটাখালী, মেধাকচ্ছপীয়ার ঢালা, ডুলাহাজারা অংশে যে হাজার হাজার বৃক্ষ নিধন করা হয়েছে, তা এক শ বছরের চেয়েও প্রবীণ বৃক্ষ। সাধারণ কাঠুরে দিয়ে সেই গাছ কাটা যায়নি, বৃক্ষ নিধণের জন্য মোটামুটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বড় কাটার, স্কেবেটার, ক্রেন ব্যবহার করতে হয়েছে। ১৬ হাজার কোটি টাকার এই রেললাইন প্রকল্প বাস্তবায়নে কাটা পড়েছে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের তিন সংরক্ষিত বনাঞ্চল- চুনতি অভয়ারণ্য, ফাইস্যাখালী অভয়ারণ্য এবং মেধাকচ্ছপিয়া জাতীয় উদ্যানের ২৭ কিলোমিটার পথের গাছ। এর মধ্যে চুনতি বনাঞ্চলে ১৫ দশমিক ৮ কিলোমিটার পথে কাটা পড়েছে ৪৫ প্রজাতির ২৫ হাজার ৩৪১টি গাছ। ফাইস্যাখালীর ৮ কিলোমিটার পথে কাটা পড়েছে ৩০ প্রজাতির ১১ হাজার ৭৮৭টি গাছ। এই বনাঞ্চলে যেসব গাছ কাটা পড়েছে, তার মধ্যে গর্জনের সংখ্যাই বেশি। এছাড়া মেধাকচ্ছপিয়া জাতীয় উদ্যানের প্রায় এক কিলোমিটার পথে ১৯ প্রজাতির গাছ রয়েছে। সব মিলিয়ে এই প্রকল্পের জন্যও প্রায় ৪০ হাজার গাছ কাটা পড়েছে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন এক সমীক্ষা থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

এগুলো কি প্রতিবাদের যোগ্য নয়? বাংলাদেশের কোন বুদ্ধিজীবি, সুশীল সমাজ কি একটা টুঁ শব্দ করেছেন এই শতবর্ষী লক্ষ লক্ষ বৃক্ষ কর্তনের কারণে? অথচ, উনারাই একদিন রেলে চড়ে কক্সবাজারে যেতে যেতে অন্য একটি সফট আন্দোলনের বিপক্ষে স্ট্যাটাস দেবেন।

এরপরে ধ্বংস হয়েছে পাহাড়। শত শত পাহাড়, টিলা কেটে সমান করা হয়েছে। ধ্বংস করা হয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির প্রানীদের বাসস্থান। নষ্ট করা হয়েছে বুনো হাতিদের পথ চলাচল। নষ্ট হয়েছে সেই অঞ্চলের ইকো সিস্টেম। নষ্ট হয়েছে অভিযোজিত পরিবেশ।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আজ থেকে ৫ বছর আগে একটি সভায় বলেছিলেন, আবাদি জমি নষ্ট করে কোন উন্নয়ন নয়। প্রতিফলন কি পেলাম? লক্ষ লক্ষ হেক্টর আবাদী জমি ভরাট করা হয়েছে হাজার হাজার পাহাড়ের মাটি দিয়ে। রেলের স্লিপার বসানোর জন্য রাস্তা এত ঊঁচু আর প্রশস্ত করা হয়েছে, যা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। এই ঊঁচু বাঁধের কারণে ককসবাজার অঞ্চলে এখন কৃত্রিম বন্যা। পানি চলাচলের পর্যাপ্ত পথ না থাকার কারণে জীবনে যাদের উঠানে পানি উঠেনি, তাদের ঘরে গলা পানি। কৃত্রিম বন্যার ফলে নতুন লাগানো বীজধানের চারা ধ্বংস। আগামী সিজনের আশানুরূপ ফসল তুলতে পারবে কিনা সন্দেহ।

এতদ সমস্ত কৃতকলাপ হচ্ছে, সবই লোক চক্ষুর অন্তরালে। কারণ রেল লাইনটা বনাঞ্চলের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, যেখানে সাধারণ মানুষ যায় না। স্থানীয় মানুষজন এ সম্পর্কে সচেতন নয় আর সচেতন হলেও কিছু বলার ভাষার শক্তি নাই।

যারা এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, তারা কি সচেতন নয়? যে ইঞ্জিনিয়ার এই রেলপথের ডিজাইন করেছে তারা কি জানে না এখানে লক্ষ লক্ষ শতবর্ষী গাছ কাটা যাবে, পাহাড় কাটা যাবে? জানে। তবুও তারা নির্মম। এতে তাদের কিছু যায় আসে না। হয়তো দেখা যাবে, এই গাছ যারা কাটার অনুমতি দিল, সে সমস্ত ইঞ্জিনিয়ার, কর্মকর্তাদের বাসার ছাদে বাগান করা হয়, ফেসবুকে তারা পরিবেশ প্রেমী। এই যে হাজার হাজার প্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস করা ইঞ্জিনিয়ারগণের বাসায় খোঁজ নিলে দেখা যাবে তারা বিড়াল প্রেমী। পাখি প্রেমী। বাসার খাঁচায় পাখি লালন পালন করে। আবার কুরবানের আগে আগে পশুহত্যা মহাপাপ বলে স্ট্যাটাস দেয়।

এটাই নির্মম বাস্তবতা। কিছু প্রশ্ন কেউ করে না। আবার কিছু প্রশ্ন স্রোতে তাল মেলাতে করে। এই দ্বৈত চরিত্রের কারণেই দেশের বৃহত্তর ক্ষতির খোঁজ কেউ রাখছে না। কিভাবে পরিবেশকে বাঁচিয়ে, লক্ষ লক্ষ শতবর্ষী গাছ না কেটে, আবাদী জমি ভরাট না করে, শত শত পাহাড় না কেটে, বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি না করে কিভাবে রেলপথটা নির্মাণ করা যেত, সেই কথা বলতে কেউ এগিয়ে এলো না।

আরো একটি বৃহৎ ক্ষতির মূল কারণ রোহিঙ্গা জনবসতী। অন্যান্য আরো অনেক ক্ষতির মাঝে বনাঞ্চল নিধন একটি গুরুতর ক্ষতি। রোহিঙ্গাদের আবাসস্থল, রান্নাবান্না ও ঘর নির্মাণের কাজের জন্য নির্বিচারে বন ধ্বংস হচ্ছে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলায়। কক্সবাজার উত্তর ও দক্ষিণ বন বিভাগের দেওয়া হিসাব মতে, রোহিঙ্গাদের কারণে টেকনাফ ও উখিয়ায় প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার একর বনভূমি উজাড় হয়ে গেছে এবং আরও উজাড় হচ্ছে। কক্সবাজার বন বিভাগ জানিয়েছে, প্রতি একর বনে গড়ে এক হাজার করে গাছ রয়েছে। এই হিসাবে সাড়ে পাঁচ হাজার একর বনে ৫৫ লাখ গাছ ছিল। ছোট-বড় এসব গাছ এখন আর নেই। বন বিভাগের দেওয়া তথ্য বলছে, অর্থের হিসাবে উজাড় হওয়া বনাঞ্চলের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৪০০ কোটি টাকা।

আমরা সকলকে স্ব স্ব স্থানে থেকে পরিবেশ রক্ষার আহবান জানাই। বিশেষ করে যারা উচ্চ পদে থেকে দেশের সেবা করছেন, আপনাদের কাছে বিনীত অনুরোধ যেন কক্সবাজারের মাটি ও পরিবেশের যে প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, তা যেন আর ধ্বংস করা না হয়।

ইমরুল শাহেদ
প্রকৌশলী।