আমান উল্লাহ কবির :

অসুস্থ পৃথিবী। ‘কোভিড- ১৯’ নামক মরন ব্যাধিতে প্রাণপণ লড়ে যাচ্ছে দুনিয়ার মানুষ।
একদিকে ক্ষুদা নিবারনের জন্য খেটে খাওয়া মানুষের লড়াই, অন্যদিকে কোভিড- ১৯ এ আক্রান্ত রোগীদের মৃত্যুকে জয় করার যুদ্ধ।
কিন্তু ‘করোনা’ নামক এই ব্যাধি যাকে ধরেছে নিশ্চিত মৃত্যুর দুয়ার হতে জীবনকে ফিরে পেয়ে পুনঃজম্ম পেয়েছে। আমিও সেই সম্মুখ দুয়ার হতে নিজেকে ফিরে পেয়েছি মহান রবের অশেষ কৃপায়।
আমরা সচেতন ব্যক্তি। তবে কতটুকু সচেতন? গ্রামের ১০ জনের মতো আমিও করোনাকে পাত্তাই দেয়নি। এমনকি করোনা নিয়ে ব্যঙ্গ করেছি। সচেতন হয়েও মুর্খতার পরিচয় আমার মাঝে ছিল। যদি না আমাকে করোনা আক্রান্ত না করতো তবে ওই মুর্খতার পরিচয় বহন করে বেড়াতাম। যে করোনা নামে কোন রোগই নেই!!
একটু বর্ণনা না করলে হয়তো আমার অনুভূতি বুঝানো অসম্পুর্নতা রয়ে যাবে। তাই আংশিক আপনাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
১০ জুন ২০২১ খ্রীস্টাব্দ। সকাল ১১ টার দিকে শরীরের তাপমাত্রা সামান্য বৃদ্ধি পেয়ে অস্বস্তিকর লাগছে। তবে তেমন গুরুত্বারূপ করছিনা। বলতে গেলে পাত্তাই দিচ্ছিলাম না। নিয়মিত নিজ কর্মস্থলে যাচ্ছি। এভাবে ২-৪ দিন কেটে গেলো।
এদিকে ১৮ জুন ২০২১ খ্রীস্টাব্দ একমাত্র ছোট ভাইয়ের বিয়ের দিন ধার্য্য রয়েছে।
তাই শরীরের দিকে নজর না দিয়ে বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজনের বিভিন্ন কাজ কর্ম একাই সারতে হচ্ছে।
এরই মধ্যে রাত-দিন কয়েক দফা গায়ে জ্বর অনুভব করছি। এমনকি রাতে কাঁথা চাপা দিয়ে জ্বর নিবারন করার চেষ্টা চলে।
সাথে প্যারাসিটামলসহ এন্টিবায়োটিক ঔষধ সেবন করে যাচ্ছি। আর রং চা তো নিয়মিত চলছে।
তখনও মনে কিঞ্চিৎ পরিমানও করোনা রোগের ভাবনা আসেনি। শুধুই জ্বর হিসেবে ধরে নিয়েছি।
যথা সময়ে ১৮ জুন ছোট ভাইয়ের বিয়ের দিন বৌ-ভাতসহ বিভিন্ন আয়োজন চলছে। ওই দিন সকাল ১০ টারদিকে গাড়ি বহর নিয়ে বধু বরন করতে টেকনাফ যাত্রা করেছি। তখনও আমার শরীরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক বৃদ্ধি রয়েছে। নিজেকে খুবই খারাপ লাগছে। কোন দিকেই মন বসছেনা। দুপুরের আগেই বধু নিয়ে বাড়িতে ফিরেছি।
শুরু হলো বাড়িতে আগত মেহমানদের আপ্যায়ন ও অথিতিয়েতা। অবশেষে শরীর আর সহ্য করতে পারেনি। একদিকে গিয়ে বসে রইলাম। স্থানীয় ও বয় ছেলেরা অথিতিদের মেহমানদারি করে যাচ্ছে।
তখনও ভাবিনি করোনা নামক মরণঘাতি রোগ আমাকে আক্রমন করবে!
শেষ হলো বিয়ের আয়োজন। তার পরের দিন ১৯ জুন ছুটে গেলাম টেকনাফ হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা: টিটু চন্দ্র শীল এর কাছে। সব কিছু চেকআপ করে এন্টিবায়োটিকসহ কয়েক ধরনের ঔষধ দিলো। যথা সময়ে সেবন করতে লাগলাম। জ্বর চলে গেলো। কিন্তু শরীরের দুর্বলতাসহ আরো কিছু সমস্যা বাড়তেই আছে।
এরই মাঝে বন্ধুরা বার বার করোনা টেস্ট করার জন্য তাগাদা দিয়ে যাচ্ছে।
তাদের কথায় ২৩ জুন করোনা টেস্ট দিলাম। এবার রেজাল্টের অপেক্ষা। এর মাঝে শরীরের দুর্বলতা প্রখট দেখা দিয়েছে। কোন গন্ধই পাচ্ছিনা। বলতে গেলে মুখের রুচি মোটেই নেই। তবে তখনও মনের ভিতর এক ভাগও করোনার পজেটিভ আশা করিনি। কারন করোনার উপসর্গ ছিলনা। তাছাড়া করোনা নিয়ে গ্রাম্য মানুষের মতো আমার ভাবনাও নেগেটিভ।
২৬ জুন টেকনাফ আইআরসিডিডিআর’বি (IRCDDR’B) থেকে মুঠোফোনে আমার স্বাস্থ্য বিষয়ে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করছে। তখন আমার বুঝতে বাকি রইলোনা কিছু একটা হয়েছে।
সবশেষে আমাকে অভয় দিয়ে জানালো ‘করোনা পজিটিভ’। মুঠোফোনেও ক্ষুদেবার্তা আসলো।
তারা আমাকে আইসোলেশনে ডাকলেন। তবে আমার কোন বড় ধরনের সমস্যা না থাকায় ‘হোম কোয়ারেন্টাইনে’ থাকলাম। একটি রুমে নিজেকে আবদ্ধ করলাম। সহধর্মিণী ব্যতিত এই রুমে কারও প্রবেশ নিষিদ্ধ হলো।
মনোবল কে শক্ত রাখলাম। এরই মাঝে বন্ধুদের জানিয়ে দিলাম ‘করোনা পজেটিভ’। তারা প্রথমত বিশ্বাসই করেনি আমার করোনা হয়েছে। পরে কয়েকজন বন্ধু দেখতে আসলো এবং মনোবল শক্ত রাখার সাহস দিচ্ছেন।
২৯ জুন রাতে শ্বাস কষ্ট অনুভব করছি। সাথে সাথে বন্ধুদের সাথে পরামর্শ করলাম। অক্সিজেন নিতে পারছিনা। শ্বাস বাড়ছে। শরীর অস্বস্তিকর হয়ে উঠছে। নিজেকে সামলে নিতে পারছিনা। ধীরে ধীরে জীবন অসহ্য হয়ে উঠছে। ভাই-বোন আত্মীয় স্বজনদের মাঝে খবর ছড়িয়ে পড়লো। সবাই চিন্তিত। মুঠোফোনে অবিরত কল।
কোন ভাবেই রাত পার করিয়ে দিলাম।
৩০ জুন সকাল ১০ টায় হ্নীলা হতে বন্ধু আবদুল আজিজ সিএনজি নিয়ে বাসায় চলে এলো। এসময়ে দেশব্যাপী শাটডাউন চলছে।
দ্রুত চলে গেলাম টেকনাফ আইআরসিডিডিআর’বি করোনা আইসোলেশন সেন্টারে।
ভর্তি হলাম ৩ নং ওয়ার্ডে। চিকিৎসকরা আমার শ্বাস কষ্ট দেখে দ্রুত অক্সিজেন ব্যবস্থা করলেন এবং প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু করলেন। অক্সিজেন গ্রহন করে কিছুটা আরামদায়ক অনুভব করছি। আমার পাশেই আরো অনেক করোনা রোগী ভর্তি রয়েছেন। ওইসব রোগীদের অবস্থা দেখে নিজেও কিছুটা ঘাবড়ে গেলুম। কিন্তু সেই ঘাবড়ানোর সুযোগটা দিচ্ছেনা বন্ধুরা। তারা পাশেই রয়েছে। সাথে নার্সরাও। শ্বাস কষ্টের একটু স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসায় বন্ধুরা চলে গেলো। আইসোলেশন সেন্টারে অন্যান্য রোগীর মতো অক্সিজেন দিয়ে বেডে শুয়ে রইলাম। এরই মাঝে রোগীর সংখ্যা যোগ হচ্ছে।
পাশের সীটে সবচেয়ে বেশী শ্বাস কষ্টে ভুগছেন সাবরাংয়ের এক যুবক। অক্সিজেন দিয়ে শুয়ে রয়েছেন। তার অক্সিজেন ৭৫-৮৮ এর মধ্যে আপ-ডাউন করছে। চিকিৎসক ও নার্সরা আন্তরিকতার সাথে সার্বক্ষণিক সেবা দিয়ে রোগীদের সুস্থ করার অবিরত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এভাবে ৪-৫ দিন কাটলো আইসোলেশন সেন্টারে। শ্বাস কষ্ট একটু একটু উন্নতি হচ্ছে। মাঝে মাঝে অক্সিজেন খুলে রাখছি। নিয়মিত ঔষধ সেবন ও নার্সদের সেবায় দ্রুত সেরে উঠছি।
ওদিকে ৬ জুলাই রাতভর সাবরাংয়ের করোনা রোগী ওই যুবকের অবস্থা খুবই অবনতি হতে চলেছে। অক্সিজেনের পরিমান কমছে। সারা রাত ব্যাপী ১০-১২ জন চিকিৎসক ও নার্স তাকে ঘিরে বাঁচিয়ে রাখার প্রানপন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
সামান্য অক্সিজেনহীন জীবন কি করুণ ও হৃদয়বিদারক হয়ে উঠে তা নিজের চোখে না দেখলে এবং নিজেই ভুক্তভোগী না হলে বুঝাই মুশকিল। যথারীতি ওই যুবকের ছটফট এর মধ্যেই সকাল হলো। চিকিৎসকরা ওই রোগীকে সকাল ১০ টারদিকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আইসিও তে পাঠিয়ে দিলেন। ১২ টায় খবর এলো সেই যুবক আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলো। (ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্নাহ ইলাইহি রাজিউন)।
অথচ ঘন্টা তিনেক আগেও ওই যুবকের সাথে কুশল বিনিময় এবং শারিরীক অবস্থার খোঁজ খবর নিয়েছি। সে সাবরাং মন্ডল পাড়ার সাবেক মেম্বার মৃত মাৌলভী কবির আহমদের ছেলে।
এখানে আরো হৃদয়বিদারক ঘটনা হচ্ছে ওই যুবকের মা’ও কোভিড- ১৯ এ আক্রান্ত হয়ে পাশের সীটে অক্সিজেন দিয়ে শুয়ে আছেন। ছেলের করুণ পরিস্থিতি দেখে নিজেও আরো ভেঙ্গে পড়লেন।
তাঁর মা এখনো (এই লিখা লেখা পর্যন্ত) জানেনা ছেলের মৃত্যু হয়েছে। সে জানে ছেলে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে।
মৃত্যু যে কত ভয়ংকর, কত হৃদয়হীন তা খুব কাছ থেকে অবলোকন করেছি। একটু অক্সিজেন এর জন্য মানুষের ছটফটানি দেখেছি।
বাঁচার জন্য মানুষের কতই দৌড়ঝাঁপ তা খুব সন্নিকটস্থ ভাবে অনুধাবন করেছি।
মানুষে আতংকভাব চোখে মুখে স্পষ্টতা দেখেছি। নিজেকেও মৃত্যুর সন্নিকট হতে আল্লাহ ফিরিয়ে দিয়ে পুনঃজম্ম দিয়েছে। তা শতভাগ নিজেকে মেনে নিয়েছি।
এমন পরিস্থিতিতে চিকিৎসক ও সেবিকারা আন্তরিকতা ও ধৈর্য্যের সাথে সেবা দিয়ে যাচ্ছে। একটুও বিরক্তি হতে দেখিনি। তাদের ব্যবহারে করোনা রোগীরা সাহস পেয়ে ৫০% এমনিতেই উন্নতির দিকে বলে মনে হয়েছে।
অবশেষে ৯০ ভাগ সুস্থ হয়ে ৮ জুলাই ২০২১ খ্রীস্টাব্দ দুপুর ১২ টায় ডাঃ শোয়েব বিন ইসলাম আমাকে সর্বশেষ চেকআপ করে রিলিজ করলেন এবং অনেক উপদেশ দিলেন।
সর্বশেষ জানাতে চাই, করোনা নামক মরণঘাতি এই ব্যাধীতে অসুস্থ পৃথিবী। সুস্থতা ফিরিয়ে আনতে গবেষকগণ ও বিশেষজ্ঞরা দিন-রাত কাটনি করছেন।
এরই মাঝে নিজেকে সুস্থ রাখতে হলে সচেতনতার পাশাপাশি অনেক কিছু এড়িয়ে চলতে হবে।
কোনভাবেই মাস্ক ছাড়া চলাফেরা করা যাবেনা। নিয়মিত দৈনিক অন্তত পাঁচবার সাবান দিয়ে হাত ধৌত করতে হবে। ভীড় এড়িয়ে চলতে হবে। অন্তত তিন ফুট দুরত্ব বজায় রেখে প্রয়োজনীয় কাজ কর্ম চালিয়ে যেতে হবে।
সাবধান ও সতর্ক থাকুন। নিজে মাস্ক পড়ুন, অন্যকেও মাস্ক পড়তে উৎসাহিত করুন।
করোনায় অসুস্থ পৃথিবীকে সুস্থ করে তুলুন।
অপ্রয়োজনে ঘরের বাইরে যাওয়া যাবে না। পরিবার-পরিজন নিয়ে সময় পার করুন।
পরিশেষে মহান রবের শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি। যিনি আমাকে সুস্থতা নিয়ামত দান করেছেন। আলহামদুলিল্লাহ।
কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি, যারা আমার পাশে থেকে মনোবল বাড়িয়েছেন, সার্বক্ষণিক খোঁজ খবর রেখেছেন এবং আল্লাহর কাছে সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করেছেন। আমিন…..

 

আমান উল্লাহ কবির
দৈনিক মানবজমিন,দৈনিক সাঙ্গু,দৈনিক সাগরদেশ।
টেকনাফ প্রতিনিধি।
৯ জুলাই ২০২১ ইং।