বদরুল ইসলাম বাদল

সাত জুন। ঐতিহাসিক “ছয় দফা” দিবস। পূর্ব বাংলার পুর্ন স্বায়ত্তশাসনের দাবি সম্বলিত বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার ফসল ছয় দফা।সে সময়ের রাজনৈতিক কৌশলে দফা সংখ্যাক্রমে ছয় হলেও মুলত দফা ছিল স্বাধীনতার। বঙ্গবন্ধুর জীবনীকার বিশিষ্ট সাংবাদিক ওবায়দুল হকের ভাষায় ছয় দফা হলো স্বাধীন বাংলাদেশের “অগ্রীম জন্ম সনদ”।
1965 সালের পাক ভারত যুদ্ধ শেষে পাকিস্তানের লাহোরে বিরোধী রাজনৈতিক দল সমুহের এক সম্মেলন আহ্বান করা হয়।1966 সালে 5 ফেব্রুয়ারী শেখ মুজিবুর রহমান সে সম্মেলনের প্রথম দিনে বিষয় নির্ধারনী আলোচনা সভায় পুর্ব বাংলার পুর্ন স্বায়ত্তশাসনের দাবি নিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষে ছয় দফা উপস্থাপন করেন।যার মুল কথা হল,পররাষ্ট্র এবং প্রতিরক্ষা বিষয় ছাড়া সব ক্ষমতা প্রাদেশিক সরকারের হাতে থাকবে।ঐতিহাসিক “লাহোর প্রস্তাবের”ভিত্তির আলোকে পুর্ব পাকিস্তান হবে পূর্ণ স্বশাসিত সার্বভৌম। সংসদীয় গনতন্ত্রের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালিত হবে।সর্বোপরি ছয় দফা ছিল রাজনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার চরম পত্র। কিন্তু সেই দিনের সম্মেলনে শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের “বিচ্ছিন্নবাদীর তকমা” লাগিয়ে ছয় দফা প্রত্যাখ্যান করে সম্মেলন আয়োজক কমিটি। ফলে পরবর্তী ছয় তারিখের বৈঠক বর্জন করেন শেখ মুজিবুর রহমান এবং প্রতিবাদে পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থান কালে তিনি 23 মার্চ 1966 সাল লাহোরে এক সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক ভাবে ছয়দফা দাবি ঘোষণা করেন। ছয় দফার সুদুর প্রসারী তাত্ত্বিক গুরুত্ব বুঝতে পেরে স্বৈরশাসক জেনারেল আয়ুব খান ছয় দফা ঘোষণার সাথে সাথে অস্ত্র দিয়ে দমন করার জন্য নির্দেশনা জারি করে এবং শেখ মুজিবের ছয় দফাকে “পিনখোলা গ্রেনেট” হিসেবে মন্তব্য করে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।জুলফিকার আলী ভুট্টো ছয় দফাকে পাকিস্তানের অখন্ডতার হুমকি মনে করে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবকে তীব্র ভাযায় আক্রমণ করে।ছয় দফাকে নিয়ে অপপ্রচারের জন্য মাঠে নামেন তিনি । শুধু তাই নয় ভুট্টো ছয় দফাকে অন্তঃসার শুন্য প্রমান করার জন্য শেখ মুজিবকে উম্মুক্ত পল্টন ময়দানে বিতর্কের আহ্বান জানান।ভুট্টো বলেন, “শেখ মুজিবের ছয় দফা পুর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার একটি কর্মসূচি।কোন অবস্থাতে ছয় দফা মেনে নেয়া হবে না”।তিনি আরও বলেন “ছয় দফার উপর তিনি ঢাকার পল্টন ময়দানে শেখ মুজিবের সাথে বাহাস(বিতর্ক) করবেন। শেখ মুজিবের পক্ষে তাজউদ্দীন আহমদ ভুট্টোর প্রস্তাবে সায় দিয়ে ভুট্টোকে ঢাকার পল্টন ময়দানে বাহাসে যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে বলেন তিনি শেখ মুজিবের পক্ষে ভুট্টোর সাথে বিতর্কে অংশ নিবেন। তাজউদ্দীনের এই প্রস্তাবের পর ভুট্টো আর কোন উত্তর প্রদান করেন নাই। আর কোন বিতর্ক সভা ও অনুষ্ঠিত হয় নাই। (সূত্র, এডভোকেট জহিরুল ইসলাম রচিত বই-বাংলাদেশের রাজনীতি)। ছয় দফা ঘোষণা করার পর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আলোচনা সমালোচনার ঝড় উঠে। দলের ভিতরে বাইরে অনেকের নানাবিধ প্রশ্নের সম্মুখীন হন। ছয় দফা নিয়ে ন্যাপ পুর্ববাংলা সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের তেমনি এক প্রশ্নের জবাবে শেখ মুজিব বলেন “আরে মিয়া দফাতো একটা, বুঝলা না,ঘুরাইয়া কইলাম। “। 1966 সালে রাষ্ট্রীয় কাঠামো যেহেতু পাকিস্তান ছিল তাই বঙ্গবন্ধুর সামান্য ভুল পদক্ষেপ রাষ্ট্রবিরোধী কার্য হিসেবে চিহ্নিত করা হবে তাই রাজনৈতিক কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়েছে।
দেশভাগের পর থেকে পাকিস্তান সরকারের শাসন শোসনে নিঃস্পেশিত, বৈষম্যের স্বীকার হয় বাঙালি জাতি।পাকিস্তানিদের উপনিবেশীক সুলভ আচরণে অতিষ্ঠ পূর্ববাংলার মানুষ।আবার 1965 সালে কাস্মির ইসু নিয়ে সতর দিনের পাক ভারত যুদ্ধের সময় পুর্ব বাংলার অরক্ষিতের বিষয়টি প্রবল ভাবে ভাবিয়ে তুলে। পরিত্রাণের পথ খুজে বাঙালি জাতি। যুদ্ধকালীন অসহায়, নিরাপত্তা হীনতার স্বীকার পুর্ব বাংলা, নিজেদের সুরক্ষার প্রশ্ন টি প্রবল ভাবে সামনে চলে আসে। তাই বিলম্ব না করে দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ছয় দফার সমর্থনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সাত জুন হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।হরতাল প্রতিহত করতে সাত জুন প্রশাসন 144 ধারা জারি করে।কারপিউ উপেক্ষা করে রাজপথে নেমে আসে ছাত্র কৃষক শ্রমিক জনতা।অপ্রতিরোধ্য জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে চালানো হয় গুলি।সেদিনের হরতালে সামরিক জান্তার ছুডা গুলিতে তের জন বাঙালির রক্তে রঞ্জিত হয় বাংলার রাজপথ। গ্রেফতার করা হয় শেখ মুজিবুর রহমান কে। সেই দিন থেকে রক্তভেজা সাত জুনকে অমর করে রাখতে” ছয় দফা দিবস” হিসেবে ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ।
ছয় দফার অদমনীয় আন্দোলন কে বানচাল করার উদ্দেশ্য নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান কে প্রধান আসামি করে আগর তলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে আধিপত্যবাদী পাকিস্তান সরকার। তাতে আন্দোলনের উত্তাপ আরও বেড়ে যায় । বিশেষ ট্রাইবুনালে বিচার চলাকালীন সময়ে প্রতিবাদী বাঙালি উন সত্তরে গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত করে।যার শেষ হয় একাত্তরে মুক্তি যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম দিয়ে।
স্বাধীকার আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতা হতে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক দল নিয়ে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ছয় দফার বিরোধিতা কারী দল গুলোর রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত চরম ভুল ছিল। আওয়ামী লীগ এবং তার অংগ সংগঠন ছয় দফাকে বাঙালির “মুক্তির সনদ” হিসেবে মনে করে। পিকিংপন্থী সমর্থিত বাম সংগঠন ছয় দফাকে সি আই এ এর দলিল হিসেবে প্রচারণা করে।মাওলানা ভাসানী সাহেব ও বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ছয় দফা সমর্থন করে নাই। বঙ্গবন্ধু 2 জুন 1966 সালে কারাগারে বসে লিখেন “,মাওলানা ভাসানী সাহেব ও ছয় দপার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন,কারণ দুই পাকিস্তান নাকি আলাদা হয়ে যাবে।” ( কারাগারের রোজনামচা,পৃ57)।পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মাওলানা ভাসানী আয়ুব বিরোধী অসহযোগ আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামীদের মুক্তির দাবীতে উল্লেখ যোগ্য ভূমিকা পালন করেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিব নগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হন। অন্য দিকে গোলাম আজমের জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামি তাদের সমমনা আট সংগঠন মিলে ছয় দফা মোকাবিলা করার জন্য আট দফা পেশ করে।শাসক গোষ্ঠীর সাথে একই সুরে ছয় দফা প্রত্যাখ্যান করে। পরবর্তী পর্যায়ে তাদের আসল কলুষিত রুপ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীতার মাধ্যমে জাতির কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। তারা আজও বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্বৃদ্ধি এবং দেশের স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে আছে। স্বাধীনতার পক্ষে বিপক্ষের কথা বলা হলে ছয় দফার বিরোধী সংগঠন সমূহের সৃষ্ট প্রজন্মরাই একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে। লুঠপাট অগ্নিসংযোগ ধর্যণ সহ মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠিত করে।অন্য দিকে পিকিংপন্থী অতি বিপ্লবী ধারার কিছু নেতা বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে জিয়াউর রহমানের ধানের শীষের আগাছা হয়ে নিজেদের অস্তিত্ব বিলীন করে ফেলে। কিছু নেতা জেনারেল জিয়ার বিশ্বস্থ সেনা অফিসার, তার স্বৈরতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারার যোগ্য উত্তরসূরী জেনারেল এরশাদের লাঙ্গলের ফাল ঠিক করার মহান কাজে নিজেদের যোগ্যতার পরিচয় রাখে। তবে কিছু ভগ্নাংশ স্বাধীনতার পক্ষ হয়ে কাজ করে এবং নিজেদের ভুল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে। আর শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা নিয়ে আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে বাঙালির জাতির সর্ব যুগের অবিসংবাদিত নেতা “বঙ্গবন্ধু”হিসেবে ইতিহাসের কিংবদন্তির স্থান করে নেয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ ভপণ হয় ছয় দফাতেই।বঙ্গবন্ধু নিজে ও ছয় দফাকে স্বাধীকার থেকে স্বাধীনতার সাঁকো হিসেবে উল্লেখ করেন।তাই রাজনৈতিক কৌশলে ছয় দফা হলেও, মুলত দফা ছিল স্বাধীনতার।
স্বাধীনতার সুবর্ণ রজতজয়ন্তী এবং মুজিব বর্যে ছয় দফা দিবসটি অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী নানা ভাবে অপপ্রচার করে স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস বিকৃতি করছে। নিজের অভিব্যক্তি উচ্চ বিলাসী মনোভাব চরিতার্থ করার জন্য মনগড়া ইতিহাস রচনা করে নতুন প্রজন্মকে সত্যিকারের ইতিহাস থেকে দুরে সরিয়ে দিচ্ছে। এই অপসংস্কৃতির ফল অত্যন্ত বিপদজনক।প্রতিটি জাতির তাদের দেশের স্বাধীনতার পিছনে একটি লম্বা পটভূমি রয়েছে। তেমনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পটভূমিতে 1947 সালের পর থেকে ঘটনা বহুল বাস্তবতায় ছয় দফা ঐতিহাসিক স্তম্ভ।সাত জুনের বীর শহীদের বিনম্র শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞতা।
জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু।
———————————

লেখক -বদরুল ইসলাম বাদল।
কলামিস্ট। কক্সবাজারের নব্বই দশকের সাবেক ছাত্র নেতা
ই-মেইল badrulislam2027@gmail.com