রেবেকা সুলতানা আইরিন 

সে আমার ছোট বোন বড় আদরের ছোট বোন। ভাল করে যখন সে কথা শেখেনি তখন থেকেই সে গেয়ে যেত গান। “তুমি নেই বলে, দুপুরগুলো বিষণ্ণ চার দেয়ালের মাঝে, আটকে থাকা আমার জন্য তুমি নেই রাতে, তারাদের ঘুমগুলিতে ল্যাম্পের নিভু আলো, হলদে রাঙ্গা পথে … “অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করছে তোমার সাথে। মনের মাঝে জমানো অনেক কথা, অনেক ঘটনা, অনেক গল্প বাকি রয়ে গেছে এখনও। অনেক কিছুই বলা হয়নি তোমাকে। আমার জীবনটা আসলেই বইয়ে পড়া উপন্যাসের মত। জীবন আসলে উপন্যাসের জমজমাট কাহিনীকেও হার মানায় অনেক সময়। গল্প উপন্যাসে যেটা হয়, লেখক জীবনের এক বা একাধিক কাহিনী তুলে এনে নিজের মত করে সাজিয়ে লেখেন। পাঠকের চাহিদা বা বইয়ের কাটতির একটা চিন্তা তার মাথায় থাকে। অনেক লেখকের ওপর আবার চাপ থাকে প্রকাশকের। এত সব চিন্তা মাথায় নিয়ে লেখক গল্পের সমাপ্তি টানেন। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই লেখাটা হয় মিলনাত্মক। না হলে পাঠক কষ্ট পাবে মনে মনে। গল্প পড়ার পরেও একটা দুঃখবোধ থেকে যাবে পাঠকের মনে। পাঠকের অবচেতন মন তাকে নির্দেশ দেবে এই লেখকের লেখা এড়িয়ে যেতে। যেচে পড়ে কষ্ট পেতে কে চায়, বলো? অথবা লেখকের জনপ্রিয়তা বাঁচিয়ে রাখতেই করতে হয় এই কাজ। কিন্তু বাস্তবতা অসম্ভব কঠিন। যে লেখক অদৃশ্য কালিতে প্রতিটি মানুষের জীবন কাহিনী লেখেন, তার তো কোন দায়বদ্ধতা নেই। মনে করছো এত শত কথা কিভাবে জানি আমি? আমার জীবনটা তো এমনই, তুমি সেটা ভালই জানো। সেই সকাল থেকে বেজে যাওয়া গানটার মতই আমার জীবনটা “চার দেয়ালের মাঝে, আটকে থাকা আমার জন্য”। আমি অনেক ভাবি মানুষকে নিয়ে, মানুষের মন নিয়ে। নিজেকে নিয়েও ভাবি, নিজের জীবনে করা ভুলগুলোর কথা ভাবি। অনেক সময় কি মনে হয় জানো? মনে হয় – আসলে আমরা শুধু মাত্র সেই লেখকের তৈরি করা চরিত্র, আমাদের চারপাশে যা কিছু ঘটে, সব স্ক্রিপ্ট। আমরাই কেবল ভাবি যে আমরা দৃশ্যপট বদলে দিচ্ছি। আসলে কাহিনীটা সেভাবেই লেখা। আমাদের কিছুই করবার নেই। কিন্তু কি জানো, এই যে তৈরি করা স্ক্রিপ্টে আমরা অভিনয় করছি, সেখানে নাটক সিনেমার অভিনেতাদের সাথে দারুণ একটা অমিল আছে আমাদের। ওরা কষ্টের অভিনয় করলেও কষ্ট পায়না, তেমনি করে আনন্দের অভিনয় করলে আনন্দটাও পায় না। আমাদের কিন্তু দুঃখ কষ্ট আনন্দ সব বাস্তব। এই যেমন তোমাকে সেই ২০১২ সাল থেকে মিস করছি, চোখের পানিতে বিধাতার কাছে দোয়া করি ওপাড়ে যেন তুমি ভালো থাকো। সব কিছুই আছে আমার চারপাশে, নেই শুধু তুমি। আর তাতেই রঙ হারালো আমার পৃথিবী। এ কেমন শূন্যতা বলো তো? আচ্ছা, তোমারও কি এমন লাগে? আজকে তোমাকে আমার ছোটবেলার কথা বলতে ইচ্ছে করছে। আর নয়টা সাধারণ মেয়ের মতই ছিল আমার শিশুকালটা। মধ্যবিত্ত পরিবারের একটা মেয়ের চারপাশে যা যা থাকে, তার সবই ছিল আমাদের মাঝে। খেলাধুলা ও ব্যবসার কাজে সদা ব্যস্ত থাকতেন বাবা। স্কুল, বাসা আর আমার ছোট তিন ভাই ও ছোট বোনটাকে নিয়েই ছিল আমার জগৎ। চাঁপা একটা কষ্ট সে সময় ছিল কি না, আজ আর মনে নেই। কিন্তু এখন আমি জানি, সে সময় থেকেই নিজেকে খুব অল্পতে সুখী করবার অভ্যাসটা গড়ে ওঠে আমার মাঝে। নিজের যা আছে তা নিয়ে খুশী থাকা, কারও ওপর নির্ভর করার চাইতে নিজের ওপর নির্ভর করা, মন খারাপ হলে নিজের বানানো ধুসর পৃথিবীটাতে ঢুকে পড়াই আমার অভ্যাস ছিল। ভালই ছিলাম আমি আমার নিজস্ব জগতে। কেউ জানতো না ব্যাপারটা, শুধু আমি জানতাম। মাঝে মাঝে যখন দিনে দুপুরে আমার সেই জগতে ঘুরে বেড়াতাম, তখন অনেকে বলতো – ভাবুক মেয়ে অমনোযোগী। আমি তখন থেকেই জানি যে আমি কতটুকু করতে পারি, আমার দ্বারা কতটা সম্ভব। কিন্তু বিধাতার নির্মম পরিহাঁস! ২০১২ সালের পহেলা জুন মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় আমাদের পরিবারের আটজন সদস্য ওপাড়ে চলে যান। যার মাঝে ছিল আমার অত্যন্ত আদরের, স্নেহের, ভালবাসার মনিটুকরা সাবরিনা সুলতানা আলাভী। আমি ও আমার মা মোকাররবা বেগম একই দুর্ঘটনায় আহত হয়ে মহান রাব্বুল আলামিনের দয়ায় আবারও নতুন সূর্য উদিত হয়েছে আমাদের জীবনে। আমার বাবা কক্সবাজার জেলা কর্তৃক স্বীকৃত জেলার প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব, সাবেক জাতীয় ফুটবলার সুরত আলম সাহেব অতীতের সেই স্মৃতিগুলো ও আদরের ছোট মেয়ে আলাভীকে হারানোর যন্ত্রণা ভুলতে পারেননি মৃত্যুর আগেও। পারার কথাও নয়।

আজ আমার সেই ছোট্ট আদুরী আলাভীর মৃত্যুবার্ষীকী। হে দু’জাহানের মালিক, তুমি আমার হৃদয়ের মনিকে ওপাড়ে ভালো রেখো। আমীন।
আজ আমার আদরের আলাভীর আত্মার মাগফেরাত কামনার্থে,পবিত্র খতমে কোরআন,দোয়া মাহফিল,আলেম ওলেমা ও এতিম অসহায়দের মাঝে খাদ্য বিতরন সহ নানা কর্মসুচী গ্রহন করা হযেছে।

 

 

লেখক পরিচিতি : সাবরিন‍া সুলতানা আল‍াভীর বড় বোন রেবেকা সুলতানা আইরিন এল, এল,বি সম্পাদক-একেনিউজবিডি২৪.কম ও সিনিয়র যুগ্ন আহবায়ক, মহিলা আওয়ামীলীগ ককসবাজার পৌর এবং আহবায়ক, আইন ও মানবাধিকার সুরক্ষা ফাউন্ডেশন, ককসবাজার জেলা।