কাফি আনোয়ার:
মানব সভ্যতার বিকাশে নদীর গুরুত্ব অনস্বীকার্য। সমাজবিজ্ঞানী কার্ল ভিটফোগেল তাঁর ‘ওরিয়েন্টাল ডিসপুটিজম’ গ্রন্থে জলকেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থায় মানুষের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিবর্তনের ক্ষেত্রে নদ-নদী-খাল বা জলাধারের নিকটবর্তী বা নদীতীরবর্তী অবস্থানকে অবিচ্ছেদ্য ও অতিগুরুত্বপূর্ণ বলে বর্ণনা করেছেন। গ্লোবাল ওয়াটার পলিসি প্রজেক্টের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক এবং মিঠাপানি ও বাস্তুতন্ত্রবিষয়ক খ্যাতিমান আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ সান্ড্রা পোস্টেলের অভিমত, মানবসভ্যতার ইতিহাস নদী বা সাগর ছাড়া আলোচনা করা অসম্ভব।

পৃথিবীর প্রাচীন মানবসভ্যতাগুলি যেমন নদীতীরবর্তী বা নদী অববাহিকায় গড়ে উঠেছে তেমনি নগরসভ্যতার ক্রমবিকাশ ও গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতিনির্ভর সমাজব্যবস্থার বিবর্তনের ক্ষেত্রেও নদী-সাগর-খালের ভূমিকা অপরিসীম। খ্রীস্টপূর্ব ৩৫০০ অব্দে টাইগ্রীস বা দজলা নদীর পূর্বদিকে এবং ইউফ্রেটিস বা ফোরাত নদীর পশ্চিমদিকে ‘ দুই নদীর মধ্যবর্তী ভূমিতে’ প্রাচীণ মেসোপটোমিয়া বা সুমেরুয়ী সভ্যতার গোড়াপত্তন হয়। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীণ সভ্যতা সিন্ধুনদের অববাহিকায় হরপ্পা ও মাহেঞ্জাদারো নগরের উন্মেষ ঘটে। অনুরুভাবে নীলনদের তীরে মিশরীয় সভ্যতা, দানিয়ুব নদীর তীরে পারস্য সভ্যতা, রাইন নদীর তীরে সেলটিক সভ্যতা এবং হোয়াংহো-ইয়াংজেকিয়াং নদীর তীরে চৈনিক সভ্যতা বিকাশ লাভ করে।

গঙ্গার্-রক্ষ্মপুত্র ও মেঘনা নদীর মিলিত প্রবাহ থেকে সৃষ্ট গাঙ্গেয় বদ্বীপ বাংলাদেশ। শত শত নদ-নদী-খাল এদেশে জালের মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। জল ও জীবন এখানে সমার্থক। জলের আধার বা ধারক-বাহক সাগর নদ-নদী, খাল-বিল, নালা-ঝিল, হাওড়-বাঁওড় ও জলাভুমির ভূ-তাত্তিক বৈশিষ্ট্য এদেশের মানুষের নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের প্রায় কাছাকাছি। আদিকাল থেকেই নদীকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের সমাজ, রাষ্ট্র ও প্রগতির ক্রমবিকাশের ধারা সূচিত হয়েছে।

সমাজ বির্বতনের ধারাবাহিকতায় মানুষের জীবন ও জীবিকা, কৃষ্টিকালচার, সাহিত্য-সংস্কৃতি, কৃষি, যোগাযোগ ও অর্থনীতির সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত এদেশের নদীসমুহের অস্তিত্ব আজ বিলীন হওয়ার পথে।

ক্রমাগত দূষণ, অবৈধ দখলের ফলে নদীর চিরায়ত রূপ ও গতিপ্রকৃতি যেমন বিলুপ্ত হতে চলছে তেমনি মানুষের জীবিকা ও জীবনযাত্রা, পরিবেশ, প্রাণবৈচিত্র্যতা,বাস্তুতন্ত্রও মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে পড়েছে।

বাংলাদেশ নদী রক্ষা কমিশনের হিসাবমতে দেশের ৭০০ টি নদ-নদীর মধ্যে প্রতিটি নদ-নদী-খাল দখল দূষণে হারিয়ে ফেলেচে নিজের স্বকীয় সত্ত্বা ও রূপ।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন সারাদেশে ৪৭ হাজার নদী অবৈধ দখলদারকে চিহ্নিত করেছে। তৎমধ্যে কক্সবাজার জেলার প্রধান নদী বাঁকখালীর অবৈধ দখলদার হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছে ৯৯ জন, আরও ১জন বাঁকখালী নদীর উভয় তীর দখলের অভিযুক্ত, ঈদগাও’র ফুলেশ্বরী নদীর ১৭জন ,উখিয়া উপজেলার রেজুখালের অবৈধ দখলদার ৮জন , টেকনাফ উপজেলার কাইয়ুকখালী খালের অবৈধ দখলদার ২৫ জন, চকরিয়া উপজেলার মাতামুহুরী নদীর অবৈধ দখলদার ২১জন এবং একই উপজেলার বুড়া মাতামুহুরী খালের অবৈধ দখলদার হিসেবে ১৮জনকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তবে প্রকৃত দখলদারের সংখ্যা বাস্তবে আরও বেশি।

‘পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যতা সংরক্ষণ উন্নয়ন ’ শিরোনামে বাংলাদেশের সংবিধানের দ্বিতীয়ভাগে রাষ্ট্রের মূলনীতির ১৮(ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ , জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন, বণ্যপ্রাণির সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন। পাবলিক ট্রাস্ট ডক্ট্রিন ও বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, পরিবেশ প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, সকল উন্মুক্ত জলাভূমি, সমুদ্র, নদ-নদী, খাল-বিল, হাওড়-বাঁওড়, ঝিল, সমুদ্রসকত, নদীর পাড়, পাহাড়-পর্বত, টিলা, বন, বাতাস পাবলিক ট্রাস্ট সম্পত্তি এবং ওই সকল সম্পত্তি দেশের বর্তমান ও ভবিষৎ নাগরিকদের জন্য সংরক্ষিত। এই সকল সম্পত্তির উপর জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত।

কিন্তু কে মানে কার কথা। নদী-খালগুলি ক্রমাগত দূষণ ও প্রভাবশালীদের অবৈধ দখলে চলে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে নদীর প্রাণ ও প্রাণবৈচিত্র্যতা। নদীগুলি পড়েছে চরম অস্তিত্বসংকটে। নদীসংশ্লিষ্ট সরকারী দপ্তরগুলোর দৃশ্যমান কোন ভূমিকাও অদৃশ্য। ক্ষেত্রবিশেষে নদী দখলদারদের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের রহস্যময় যোগসাজশের অভিযোগও উঠছে।

বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের একটি ঐতিহাসিক রায় নদীদূষণ ও দখলদারদের বিরুদ্ধে কড়া সতর্কবার্তা জারির মাধ্যমে নদীপ্রেমী ও নদীনির্ভর জনগোষ্ঠীকে আশাবাদী করে তুলেছে। সেই সাথে নদী ও পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে যোগ করেছে নতুনমাত্রা।

২০১৯ সালের ৩ ফেব্রুয়ারী বিচাপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচাপতি মো. আশরাফুল কামাল সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের দ্বৈতবেঞ্চ তুরাগ নদী’সহ দেশের সকল নদ-নদী,খাল-বিল ও জলাশয়কে জীবন্ত সত্ত্বা (লিগ্যাল পারসন) হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার পাশাপাশি জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে আইনগত অভিভাবক (পারসন ইন লোকো প্যারেন্টিস) ঘোষণা করে। ওই রায়ে আরো বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সরকারী ইজারার মাধ্যমে নদী তীরের জমি দখল করে স্থাপনা তৈরী করে থাকলে সেই ইজারাও বাতিল বলে গণ্য হবে ।

নদীকে জীবন্ত সত্ত্বা (লিগ্যাল পারসন) ঘোষণায় বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ রাষ্ট্র। বর্তমান সরকার বা বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের নির্বাচনী ইশতেহার ২০১৮, বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০, বাংলাদেশ পানি আইন ২০১৩, বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫, বাংলাদেশ পানি ব্যবস্থাপনা নীতি , জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন ২০১৩, বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্যতা সংরক্ষণ আইন ২০১৭, জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট আইন ২০১০’সহ প্রতিটি আইনে রিবেশ প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, সকল উন্মুক্ত জলাভূমি, সমুদ্র,নদ-নদী, খাল, বিল , হাওড়-বাঁওড়, ঝিল, সমুদ্রসৈকত,নদীর পাড়, পাহাড়-পর্বত,টিলা,বন,পরিবেশ সংরক্ষণের উপর আইনগত সুরক্ষা দেয়ার অঙ্গীকার করার পাশাপাশি ওই সকল আইন দ্বারা পাবলিক ট্রাস্ট সম্পত্তিকে সুদৃঢ়ভাবে বর্তমান ও ভবিষৎ নাগরিকের জন্য প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে ।

সরকারের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবেলাসহ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের মাধ্যমে দেশের নদ-নদী-,খাল-বিল,জলাাশয়,হাওড়-বাঁওড়,ঝিল,সমুদ্রসৈকতকে রক্ষার করতে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টির বিকল্প নেই । নদী বাঁচলে দেশ বাঁচবে , দেশ বাঁচলে বাঁচবে মানুষ ও প্রকৃতি এই বিশ্ব নদী দিবসে এই হোক আগামী প্রত্যয়দীপ্ত পথ চলা।

বিশ্ব নদী দিবস ও মার্ক অ্যাঞ্জেলো:

আশির দশকের গোড়ার দিকে দিবসটির সূচনা হয়েছিল কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া রাজ্যে । আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে, ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রোববার, সাপ্তাহিক ছুটির দিন ব্রিটিশ কলম্বিয়াা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণ শিক্ষক এবং নদীপ্রেমিক মার্ক অ্যাঞ্জেলো তাঁর কিছু ছাত্রছাত্রী ও বন্ধুকে নিয়ে একটি নদীতে পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালান।

পরের বছরগুলিতে দিবসটি উদযাপন ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ব্রিটিশ কলম্বিয়া রাজ্য থেকে পুরো কানাডা, আমেরিকা, ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়ায় পালিত হতে থাকে দিন।

২০০৫ সালে জাতিসংঘ দিবসটি সমর্থন করে এবং প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রবিবার বিশ্বজুড়ে বিশ্ব নদী দিবস” পালিত হয়ে আসছে ।

২০১৫ সাল পর্যন্ত ‘ওয়াটার ফর লাইফ ডিকেড’ কর্মসূচী সূচনা করে। মার্ক অ্যাঞ্জেলো ততদিনে তাঁর নদীপ্রেমের জন্য বিশ্বব্যাপী পরিচিত। তিনি প্রতিষ্ঠিত হন দিবসটির জাতিসংঘ চেয়ার হিসেবে।