মো. নুরুল করিম আরমান, লামা প্রতিনিধি:

বান্দরবানের লামা ও চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার সীমান্তে সরই খালের ওপর হাসনা ভিটা নামক স্থানের সেতুটির পূণ:নির্মাণ কাজ শুরু করেছে চট্টগ্রামের স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর। কিন্তু সেতু নির্মাণ করার আগে যাতায়াতের জন্য সেতুর পাশে আরেকটি বিকল্প রাস্তার ব্যবস্থা করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। ফলে সরই-লোহাগাড়া সড়ক দিয়ে সরাসরি যান চলাচল বন্ধ হয়ে সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন যাতায়াতকারী শিক্ষার্থী, পর্যটকসহ স্থানীয়রা। বিশেষ করে চলতি মৌসুমে পার্বত্য লামা উপজেলার কয়েকশ বাগানে উৎপাদিত আম, জাম, কাঁঠাল, কলা, লিচুসহ বিভিন্ন কৃষি পন্য বাজারজাত করণে দারুণ ব্যঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। এতে কোটি কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন বাগান মালিকসহ স্থানীয় কৃষকেরা। কিন্তু বিকল্প যাতায়াতের ব্যবস্থা করছেনা ঠিকাদার। শুধু তাই নয়, ঠিকাদারের বিরুদ্ধে নির্মাণ কাজে ধীরগতিরও অভিযোগ স্থানীয়দের। দ্রুত যাতায়াতের জন্য বিকল্প ব্যবস্থাসহ সেতুটি নির্মাণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন দুই উপজেলার মানুষ। তা না হলে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মানববন্ধনসহ কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে জানান ভুক্তভোগীরা।

সূত্র জানায়, লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে সরই নামের একটি খাল। এ খালের এপার অবস্থিত পার্বত্য লামা উপজেলার সরই ইউনিয়ন, ওপারে চট্টগ্রাম জেলার লোহাগাড়া উপাজেলার পুটিবিলা ইউনিয়ন। দুই পারের মানুষের যোগাযোগের সুবিধার্তে গত ২০ বছর আগে খালের হাসনাভিটা নামক স্থানে ৩৫ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি সেতু নির্মাণ করে বান্দরবানের স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর। এ সেতুটিই ছিল দুই উপজেলার মানুষের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। প্রতিদিন এ সড়ক দিয়ে পার্বত্য লামা উপজেলায় অবস্থিত কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনে শত শত পর্যটক আসা যাওয়া করেন। কিন্তু বিভিন্ন সময় স্থানীয় ও বাহিরাগত কিছু প্রভাবশালী সিন্ডিকেট এ সেতুর দু’পাশ থেকে অবাধে বালু উত্তোলনসহ ধারণ ক্ষমতার অধিক যানবাহন চলাচলের কারণে গোড়া থেকে মাটি সরে গিয়ে নড়েবড়ে হয়ে যায়। এক পর্যায়ে অতিবর্ষণে সৃষ্ট পানির স্রোতের টানে ২০১৮ সালের ২০ জুন সেতুটির এক পাশ ধসে পড়ে। এতে ভারী যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেলেও সেতুটির ওপর দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে পায়ে হেঁটে চলাচল করতে পারত দু পারের মানুষ। দরপত্র আহবানের পর ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান পুণ নির্মাণের জন্য সেতুটির ছাদ ভেেেঙ্গ ফেলে। এতে যোগাযোগ সম্পুর্ণ বন্ধ হয়ে যায়।

জানা যায়, পত্রিকায় লেখালেখি ও এলাকাবাসীর দাবীর প্রেক্ষিতে গত তিন মাস আগে চট্টগ্রাম জেলার স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর কর্তৃক প্রায় ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে সেতুটি নির্মাণের দরপত্র আহবান করা হয়। এতে সেতুটির নির্মাণ কাজটি পায় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান শাহ্ জব্বারিয়া ট্রেডার্স। গত তিন মাস আগে সেতু নির্মাণের কার্যাদেশ দেয় এলজিইডি।

অভিযোগ ওঠেছে, ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান চলাচলের বিকল্প কোন ব্যবস্থা না করেই কাজের শুরুতেই শ্রমিক লাগিয়ে পুরাতন সেতুটির ছাদ ভেঙ্গে ফেলে। এতে যোগাযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জন দুর্ভোগ চরম আকারণ ধারণ করেছে। এছাড়া কার্যাদেশ মতে গত গত তিন মাস আগে সেতু পুণ:নির্মাণ কাজ শুরুর কথা থাকলেও নানা অযুহাত দেখিয়ে গত সপ্তাহ আগে থেকে কাজ শুরু করেন ঠিকাদার, তাও আবার কাজ চালাচ্ছেন ধীরগতিতে।

এদিকে সেতুটির এক পাশ ধসে পড়ার পর গত বছর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. ইদ্রিস কোম্পানী নিজে উদ্যোগ নিয়ে এলাকাবাসীর সহায়তায় পাশেই একটি বিকল্প কাঠের সেতু নির্মাণ করেন। গত দু বছর ধরে এ কাঠের সেতুর ওপর দিয়েই স্থানীয়রা সিএনজি, মোটর সাইকেল, টমটম যোগে চলাচলসহ কৃষি পন্য পরিবহন করে আসছিলেন। কিন্তু টানা ভারী বর্ষণের ফলে বিকল্প এ কাঠের সেতুটিও গত মঙ্গলবার ¯্রােতের টানে ভেসে যায়। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, সেতুর দুই পাশে আটকে আছে অন্তত অর্ধশত যানবাহন। গাড়ি পরিবর্তন করে যাতায়াত করতে হচ্ছে স্থানীয় বাসিন্দাদের। এছাড়া সেতুটির লোহাগাড়া উপজেলার অংশে কিছু পাথরসহ নির্মাণ সামগ্রী জমা করে রেখেছে ঠিকাদার কর্তৃপক্ষ। কযেকজন শ্রমিককে সবে মাত্র একটি পিলারের ফাইলিং করতে দেখা যায়। এ সময় স্থানীয় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. ইদ্রিস কোম্পানী ও সরই ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য জানে আলম বলেন, সেতুটির নির্মাণ কাজ চলছে ধীরগতিতে। তিন মাসে শুধুমাত্র একটি পিলারের ফাইলিং করা হয়েছে মাত্র। তারা আরো বলেন, কাজে ধীরগতির কারণে যারা প্রতিদিন লোহাগাড়া, সাতকানিয়া, চট্টগ্রামে অফিস ও ব্যবসা বানিজ্য করেন বা জরুরি প্রয়োজনে এ সড়ক দিয়ে বাধ্য হয়ে যাতায়াত করেন তারা পড়েছেন বিপাকে। বিশেষ করে পার্বত্য লামা উপজেলায় উৎপাদিত কৃষি পন্য বাজারজাতে দারুন ব্যাঘাত হচ্ছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে যাতায়াতের বিকল্প রাস্তা তৈরি না করলে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মানব বন্ধনসহ কঠোর গ্রহণ করতে বাধ্য হবেন বলে জানান তারা। একই সময় এ সড়কে চলাচলকারী সিএনজি চালক শফিকুল ইসলাম, ভাড়ায় চালিত মোটর সাইকেল চালক এরশাদ আলীসহ আরো অনেকে এক সূরে বলেন, ক্যায়াজুপাড়া বাজার থেকে ব্রিজ পর্যন্ত যাওয়া যায়। এরপর যাত্রীদের নামিয়ে দিতে হয়। আবার বাধ্য হয়েই যাত্রীরা মালামাল কাঁধে নিয়ে পায়ে হেঁটে খাল পার হয়ে ওপারে গিয়ে আবার গাড়িতে ওঠেন। তাও আবার খালে পানি কম থাকলে, খালে বেশি পানি থাকলে তাও সম্ভব হয়না। অনেক সময় হেটে খাল পার হতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন যাত্রীরা।

এ বিষয়ে স্থানীয় মেরিডিয়ান গ্রুপের আম বাগান ব্যবস্থাপক মেহেদী হাসান বলেন, ইউনিয়নে বিভিন্ন কোম্পানী ও ব্যক্তিমালিকানাধী কয়েকশ আম বাগান রয়েছে। ইতিমধ্যে এসব বাগানে এ আম পাকা শুরু করেছে। কিন্তু সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় কারণে আম বাজারজাতে দারুন ব্যঘাত ঘটছে। ফলে বাগান মালিকরা আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। নির্মিতব্য সেতুর পাশে যাতায়াতের বিকল্প ব্যবস্থা করে দিলে দুর্ভোগ লাঘব হত। যাতায়াতের বিকল্প ব্যবস্থা না করে সেতু নির্মাণ কাজ শুরু করায় ক্ষোভ প্রকাশ করে সরই ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ফরিদ উল্ আলম ও লোহাগাড়া উপজেলার পুটিবিলা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. ইউনুছ এক সূরে বলেন, আমাদের দুর্ভোগ দেখার কেউ নেই। এ সেতু নির্মিত হলে দুই উপজেলার কৃষিজীবী ও শ্রমজীবী মানুষের দুর্ভোগ লাঘব হত। যাদের তিনবেলা ভাত খেতে কষ্ট হয়, তাদের সহায়তায় বিকল্প কাঠের সেতু নির্মাণ করা হয়েছিল। অবশেষে সেই সেতুটিও ¯্রােতের টানে ভেসে গেল। এতে দুই উপজেলার সাথে সড়ক যোগাযোগ সম্পুর্ণ বন্ধ থাকায় বিশেষ করে কৃষি খাত চরম ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। সেতু নির্মাণ কাজ দ্রুত সম্পন্ন করার জন্য ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে তাগাদা দেয়া হচ্ছে বলেও জানান তারা।

তবে সেতু নির্মাণ কাজের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের পক্ষে নুরুল আলম জিকু বলেন, প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস সংক্রমনের কারণে সেতুটির নির্মাণ কাজে কিছুটা বিঘœ ঘটেছে। তবে ইতিমধ্যে ২০% কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আশা করি আগামী ৫-৬ মাসের মধ্যে সেতুটির নির্মাণ কাজ শেষ করা যাবে। তিনি আরো বলেন, আগে বিকল্প যাতায়াতের জন্য সহযোগিতা করেছি। বর্তমানেও স্থানীয়রা যাতায়াতের বিকল্প ব্যবস্থার উদ্যোগ নিলে সহযোগিতা করা হবে।

এ বিষয়ে লোহাগাড়া উপজেলা প্রকৌশলী দিবাকর রায় মুঠোফোনে জানায়, খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে সেতুটির নির্মাণ কাজ শেষ করার চেষ্টা চলছে। ঠিকাদারের সাথে আলাপ করে যাতায়াতের বিকল্প ব্যবস্থা করা হবে।