~ নীলোৎপল বড়ুয়া

মানুষ সামাজিক জীব।
সমাজবদ্ধ হউক বা না হউক
সমাজেই তার আবাস,
সমাজের সাথেই তার বসবাস।
চাইলেও এখানে সে নিজের মতো থাকতে পারে না।
সমাজ বলে নিজের মতো হয়ো না,
সমাজের মতো হও।
সমাজ বলে পাঁচের মধ্যে পঞ্চম হয়ো না,
অন্যতম হও।
সমাজ বলে বিশেষ হয়ো না,
সাধারণ হও।
সমাজ বলে আলাদা চলিও না,
দশের সাথে তাল মিলিয়ে চলো।
তাল মেলাতে মেলাতে একসময়
শীতল রক্ত বিশিষ্ট প্রাণীর মতো হয়ে পড়ে মানুষ।
বেঁচে থাকে সরীসৃপের মতো।
শাখা-প্রশাখা সমৃদ্ধ কাষ্ঠল বৃক্ষের মতো
বিস্তৃত মূল গেড়ে বসে।
পরগাছাসহ আশেপাশের প্রাণীসকল
জড়ো হয় তার গায়ে ও গোড়ায়।
কিন্তু তালগাছের মতো
মাথা উঁচু করে একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকা
মানুষের কাছে ভিড়ে না সমাজ।
তবে তাল পাকলে
পাকা তালের মিষ্টি গন্ধযুক্ত রসের
পিঠা আস্বাদনের সুযোগ ছাড়ে না।
আজকে যাকে সমাজ সহ্য করে না, উপেক্ষা করে,
কালকে তাকেই মাথায় তোলে গৌরব করে।
মূল্যবোধের নীতি তার সহ্য হয় না,
অর্থনীতির নীতিতেই সে বাঁধা।
তাই তার কাছে সাদা-কালোয় কোন তফাৎ নাই,
উভয় নোটই সমান আতিথেয়তা পায়।
তবে বড় বড় নোট চাই।
সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা- সততাকে
বেনারসী শাড়ীর মতো সিন্দুকে সযত্নে তুলে রেখে
সমাজ বলে- যুগ পাল্টেছে।
মানুষের বিকাশ চায় না সমাজ
চায় মানুষের নতি।
মেনে নেওয়াটা তার রীতি।
বলে- মেনে নাও, মেনে নিতে হয়।

বলা হয় দ্বন্দ্বের মধ্যদিয়ে সমাজের বিকাশ।
বিকশিত হউক বা না হউক কাঠামো তৈরি হয়
আর পরিবর্তিত হয়।
একটি ব্যবস্থা মাত্র, যেখানে যেমন,
কিছুজন তা তৈরি করে বহুজন তা চর্চা করে।
পদার্থ না হলেও সমাজ কিন্তু পানির মতো;
বিভিন্ন পাত্রে বিভিন্ন আকার ধারণ করে,
ধারণ করে বিভিন্ন রং,
পরিবর্তন করে রূপ।
আবার পানির মতো ধুয়েও দিতে পারে সব।

আমরা মানুষরা একেক জন একেক রকম-
সাদা, কালো, বাদামী,
নাক উঁচু, নাক চ্যাপ্টা,
ধনী, দরিদ্র, শিক্ষিত, অশিক্ষিত,
আস্তিক, নাস্তিক ইত্যাদি।
আর আমাদের সমাজও একেকরকম।
আবার আছে – হাই সোসাইটি, এলিট সোসাইটি,
অ্যারিস্টোক্র্যাট সোসাইটি, সিভিল সোসাইটি,
ইন্টেলেকচুয়াল সোসাইটি।
সমাজের ভিতর সমাজ;
যেমন প্লে উইদইন এ্যা প্লে।
এরকম সমাজেই আমরা থাকি পাশাপাশি,
কিন্তু কতটুকু কাছাকাছি!

সমাজ সততা চায় না,
সামাজিকতা চায়।
সমাজ স্বাধীনতা চায় না,
নিয়ন্ত্রণ চায়।
সমাজ নেতৃত্ব চায় না,
আধিপত্য চায়।
সমাজ প্রতিবাদ চায় না
আপোস চায়।
সমাজ তাকেই ভয় পায়
যে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায়।
তাকেই চাপে যে মেনে চলে।
সমাজের অস্ত্র একটাই –
দেখাতে পারে লোকভয়।
পরচর্চা আর অপবাদে
রুখে লোকজয়।

কর্তব্য-কর্মে সমাজের স্বীকৃতি নাই,
নিন্দাও নাই কর্তব্যে ভ্রষ্টাচারণে।
কিন্তু বিশেষ বৈশিষ্ট্য হিসাবে মানুষ পায়
সততার জন্য পুরস্কার ও
মানবিকতার জন্য বাহবা।
আর গিরীন মাস্টাররা
বরাবরই বরখাস্ত হতে থাকে
রায়বাহাদুরদের হাতে।
দায়বদ্ধতা যেন ভিনগ্রহের সংস্কৃতি।
উপলক্ষ নিয়েই সব মাতামাতি
উদ্দেশ্য হয়ে পড়ে গৌণ।

মানুষের মানবিক স্তরের সংগ্রাম
সমাজেকে স্পর্শ করতে পারে না।
কাঠামোর পরতে পরতে চলে
প্রাগৈতিহাসিকতার প্রাবল্য;
লালিত হয় পাশবিকতা।
সামাজিক সম্মান রক্ষার্থে চলে
ভ্রুণ হত্যা।
মনন নয়,
সমাজ চাষ করে মধ্যবিত্ত মানসিকতা।
বড় হতে থাকে মাঝারির দল
যারা শুধু নিতেই শেখে, দিতে নয়।
বাইজেন্টিয়াম নয়,
সমাজ স্বপ্ন দেখায় ময়নাদ্বীপের,
জন্ম হতে থাকে আধিপত্যবাদি মানসিকতা,
জন্ম হতে থাকে নতুন নতুন হোসেন মিয়া।
কাম, ক্রোধ, জিঘাংসাবৃত্তির মাধ্যমে
জিহীর্ষা নিয়ে লালিত হয় জিগীষা।
প্রাণহীনতায়ও বেঁচে থাকে জিজীবিষা।

সমাজ মানুষকে সৃষ্টি করে
আর মানুষ শিক্ষার মধ্যদিয়ে নিজেকে গড়ে তোলে।
সমাজ বলে, বড়দের সম্মান করো।
কিন্তু কাঠামো তৈরি করে
হাত জোড় করে ছোটদের স্যার ডাকার।
“লেখা পড়া করে যে গাড়ি ঘোড়ায় চড়ে সে”
লোভ দেখিয়ে সমাজ বলে –
লেখাপড়া করো, ইস্ট্যাব্লিশ হও, নিজের পায়ে দাঁড়াও,
মানুষের মতো মানুষ হও।
আর আমরা মানুষ হতে থাকি-
একেকজন ভিখু, পাঁচী, বসির।

 

১২জুন,২০২০