জেসমিন সুলতানা

করোনাভাইরাসের প্রকোপ খানিকটা ধাক্কাই দিয়েছে দেশের আইন অঙ্গনে। একাধিক আইনজীবীর মৃত্যু হয়েছে। কয়েকজন আক্রান্তও হয়েছেন। এই অবস্থায় স্বভাতই শঙ্কা জাগে, ভয় জাগে, হন্তারক এ ভাইরাসকে প্রতিরোধ করার প্রস্তুতি বা সক্ষমতা কি আইনজীবীদের আছে?

গত ডিসেম্বরে চীনের উহান প্রদেশে তীব্র আক্রোশ নিয়ে করোনার আবির্ভাব। সবাইকে ঢুকিয়ে দিলো ঘরে। প্রকোপটা তখনো আমরা সেভাবে আঁচ করিনি। ভেবেছি, ধ্যাৎ, ওটা তো চীনের মানুষকে ধরেছে। অথচ কদিন পরেই একে একে এ ভাইরাসের আগ্রাসী আক্রমণে পর্যদুস্ত হতে থাকলো বাঘা বাঘা দেশগুলো। এখনতো গোটা বিশ্বই এক প্রকার মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে করোনার তাণ্ডবে।

আসলে আমরা মানুষ নামের দানবেরা সীমাহীন অত্যাচার করে চলেছি পৃথিবীকে। করোনাভাইরাসকে আমরা যদি প্রকৃতির প্রতিশোধ ধরে নিই, তাহলে বাড়াবাড়ি হওয়ার কথা নয়। হয়তো প্রকৃতি আমাদের ফিসফিস করে বলেছে বন্ধ করো অত্যাচার, সশব্দে বলেছে বন্ধ করো অত্যাচার, চিৎকার করে বলেছে বন্ধ করো অত্যাচার।

আমরা যে মুক, বধির, অন্ধ- আমরা মানবজাতি কিছু দেখেও দেখি না, শুনেও না শোনার ভান করি। আমরা দিনের পর দিন পৃথিবীকে করে চলেছি বিষাক্ত, বসবাস অযোগ্য। তারও তো সহ্যের সীমা আছে।

আসলে আমাদের শিক্ষার প্রয়োজন ছিল বলেই যেন জাগাতে এসেছে করোনা। আমরা বিভিন্ন কলকারখানায় জীবাশ্ম জ্বালানির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার করে বায়ুকে করেছি দূষিত। পানিকে দূষিত করেছি বিভিন্ন জাহাজ ও কলকারখানার বর্জ্য ফেলে। এই অত্যাচারের প্রতিশোধ তো নিতেই হবে।

আমরা পৃথিবীর ফুসফুস আমাজন রেইনফরেস্ট ধ্বংস করেছি। তাই করোনা আমাদের ফুসফুসে আঘাত হেনেছে। আমরা পৃথিবীকে জ্বালিয়ে রুক্ষ শুষ্ক করে দিয়েছি। তাই করোনা তীব্র জ্বর নিয়ে তার যন্ত্রণা আমাদের বোঝাতে এসেছে। আমরা বাতাসকে দূষিত করেছি। তাই করোনা আমাদের শিক্ষা দিচ্ছে শ্বাসকষ্টের।

আমরা পানিকে পানের অনুপযুক্ত করেছি। খাবারে ফরমালিন বিষ মিশিয়ে মানুষকে খাইয়েছি। তাই করোনা এসেছে সে ব্যথা বোঝাতে।

আমরা অস্ট্রেলিয়ার দাবানলে পোড়া অসহায় বন্যপ্রাণীদের কথা বেমালুম ভুলে গেলাম। ওদের পুড়ে যাওয়ার যন্ত্রণার বদলায় করোনা যেন এসেছে শরীরের তীব্র বেদনা নিয়ে। তারপরও আমরা শিক্ষা নেইনি, নিতেও যেন চাই না।

আমরা ভুলে যাই আমাদের বন-বনানীকে। বন তার বুক পেতে আমাদের রক্ষা করছে। আমরা বেঈমান, আস্ফালন করা, দাম্ভিক অকালকুষ্মান্ড এক জাতি, অকৃতজ্ঞতা আমাদের রক্তে। তা না হলে কি পারি আমাদের প্রাণ সুন্দরবনকে উজাড় করে দিতে?

যখন দুনিয়ার সর্বত্র অবিচার-অযাচার, দুর্নীতি-জালিয়াতি, কালো টাকার কারবার দেখছিলাম, তখনই মনে হয়েছে প্রকৃতি শোধ না নিয়ে কীভাবে পারবে?

বিশ্বকে স্তব্ধ করে দিয়ে করোনা আমাদের ঘরে থাকতে বাধ্য করেছে। ঘরে বসে দরোজায় মৃত্যুর কড়া নাড়া শুনলেও আমাদের চুরি-অপকর্ম বন্ধ নেই। এমন দুঃসময়েও আমরা চাল চুরি, প্রণোদনা চুরি, ঠকবাজি, জিনিসপত্রের দাম বাড়ানো, জালিয়াতি চালিয়েই যাচ্ছি।

মানবজাতি যখন ঘরবন্দি, তখন আকাশ স্বচ্ছ নীল মায়া ছড়াচ্ছে, পাখ-পাখালি গাইছে প্রাণভরে, হাসছে ফুল-ফসলের বাগান। ডলফিনেরা বেড়াতে পারছে সাগরতীরে। লাল কাকড়া খেলে বেড়াচ্ছে বালুচরে। বন্যপ্রাণীরা অরণ্য ছেড়ে আসছে লোকালয়ে। সবুজে শ্যামলে ছেয়ে গেছে প্রকৃতি। এমন স্নিগ্ধ সকাল দেখে মনে হয় তারুণ্যে ভরা এক সুন্দর পৃথিবী রচনা করেছে করোনা।

এমন দুর্দিনে আমরা আইনজীবী ভাইবোনেরা একটু ধৈর্য ধরি। আমাদের পাশে কেউ নেই। আমাদের স্বাবলম্বী হয়ে নিজেকেই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। সুপ্রিম কোর্ট বারসহ আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু, ভাই-বোন সবাই নিরাপদে থাকি।

লেখক
জেসমিন সুলতানা
আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট