ড. আব্দুস সাত্তার

ওয়াশিংটন ডি,সি

২৫ মে মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের বৃহত্তম শহর মিনিয়াপোলিসে পুলিশ জর্জ ফ্লয়েড নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিকে হত্যা করলে এই বিক্ষোভের সূত্রপাত হয়। মিনিয়াপোলিস অঙ্গরাজ্যের একটি রেস্তোরাঁয় নিরাপত্তা কর্মী হিসাবে কাজ করতেন ৪৬ বছর বয়স্ক জর্জ ফ্লয়েড। ২৫শে মে তারিখ সন্ধ্যায় জর্জ ফ্লয়েড গাড়িতে জাল নোট থাকার খবর পেয়ে তাকে আটক করে হাত পিছন দিয়ে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে দেয়। সেই সময় জর্জ ফ্লয়েডের কাছে কোন অস্ত্র ছিল না। তারপরও পুলিশ অফিসার হাঁটু দিয়ে গলা চেপে ধরে তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। একজন প্রত্যক্ষদর্শীর তোলা ১০ মিনিটের ভিডিও ফুটেজে দেখা যায় জর্জ ফ্লয়েড নি:শ্বাস না নিতে পেরে কাতরাচ্ছেন এবং বারবার একজন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসারকে বলছেন, “আমি নি:শ্বাস নিতে পারছি না”। “I Can’t Breathe”। এই একটি বাক্য বর্তমান বিশ্বে সকল মজলুমের ভাষা হয়ে উঠেছে। রোষে ফেটে পড়েছে পুরো আমেরিকা। মহামারীর মধ্যে মানুষ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে কারফিউ ভেঙে যেভাবে রাস্তায় নেমে এসেছে তা এক অভূতপূর্ব ঘটনা।

আমেরিকার দীর্ঘ ইতিহাসে বর্ণবাদ কেন্দ্রিক সহিংসতার বহু নজির রয়েছে। তবে অনেক বছর ধরে আমেরিকায় বিভিন্ন ধর্মের অনুসারী ও বর্ণের মানুষের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রয়েছে এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। কিন্তু গত কয়েক বছরে বিশেষ করে বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর ঘুমিয়ে পড়া বর্ণবাদের দৈত্য আবারো জেগে উঠেছে। তাই ন্যায় বিচারের দাবীতে দেশটিতে জ্বালাও, পোড়াও এবং ভাংচুর শুরু হয়েছে। গত শুক্রবার রাত থেকে আন্দোলনকারীরা হোয়াইট হাউজের আশপাশে জড়ো হতে থাকেন। ভবনের সীমানা প্রাচীরের পাশে পুলিশের সঙ্গে শুরু হয় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। এ সময় একসঙ্গে শত-শত মানুষ জড়ো হওয়ায় আমেরিকার সিক্রেট সার্ভিস এজেন্টরা হঠাৎ হোয়াইট হাউজে যান। তারপর তারা ট্রাম্পকে আন্ডারগ্রাউন্ড বাঙ্কারে নেন। তারপর গভীর রাতে তিনি টুইটে লেখেন, ‘যদি তারা সীমানা পার হতো, তাহলে দুষ্টু কুকুরের অভ্যর্থনা পেত। যত্ন করা হতো ভয়ংকর অস্ত্র দিয়ে।’

প্রেসিডেন্টের উসকানিমূলক টুইটের পর সাধারণ জনগণও পরের দিন থেকে বিক্ষোভে অংশ নেয় এবং আজ পর্যন্ত অব্যাহত আছে। এদিকে বিক্ষোভকারীদের ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ ঠেকাতে ইতিমধ্যেই অন্তত চল্লিশটি শহরে কারফিউ জারি করা হয়েছে। কারফিউ ভেঙে রাস্তায় নেমেছেন বিক্ষোভকারীরা। আর এমন অবস্থায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিক্ষোভকারীদের দমন করতে বল প্রয়োগ করার নির্দেশ দিলেন।
গত সোমবার কয়েকশ বছরের পুরনো যে আইনের ভিত্তিতে প্রেসিডেন্ট সেনা মোতায়েনের কথা বলছেন, তার জন্য গভর্নরদের কাছ থেকে অনুরোধ আসতে হবে, এবং পার্লামেন্টের অনুমোদন নিতে হবে। শেষবার এই আইন কার্যকর করে সেনা মোতায়েন করা হয়েছিল ১৯৯২ সালে লস এঞ্জেলসে পুলিশের বর্ণবাদী আচরণের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া বিক্ষোভ থামাতে। বিক্ষোভ শুরুর সাতদিন পর জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প “এই অসন্তোষের মূল কারণ বা পুলিশের সংস্কার নিয়ে টু শব্দও করেননি। বদলে তিনি নিজেকে এমন একজন প্রেসিডেন্ট হিসাবে তুলে ধরেছেন যিনি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার কাণ্ডারি। অনেক রাজ্যেই ইতোমধ্যে ন্যাশানাল গার্ডের হাজার হাজার সৈন্য মোতায়েন করা হয়েছে। বিশটিরও বেশি রাজ্যে বিক্ষোভ দমনে কাজ করছে ন্যাশানাল গার্ডের সৈন্যরা । ‘ইনসারেকশন অ্যাক্ট’ নামে এই আইনে বলা আছে কোন রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে এবং নাগরিকদের অধিকার সঙ্কটাপন্ন হচ্ছে বলে যদি প্রেসিডেন্ট মনে করেন, তাহলে তিনি রাজ্য প্রশাসনে হস্তক্ষেপ করতে পারবেন এবং পরিস্থিতি মোকাবেলায় নিজের সিদ্ধান্ত প্রয়োগ করতে পারবেন।

আমেরিকায় একদিকে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে মৃত্যু মিছিল চলছে। অন্যদিকে সরকারের বিরুদ্ধে এই তীব্র আন্দোলন ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসনকে। কি হবে এখনো বলা যায় না। তবে আজ মিনিয়াপোলিসের এটর্নি জানান জর্জ ফ্লয়েডকে হত্যার দায়ে সেই সময় উপস্থিত থাকে ৪ জনকেই এই হত্যার জন্য দায়ী করে জেলে পাঠিয়েছেন। বিক্ষোভকারীরা কিছুটা স্বস্তি পেলেও আন্দোলন অব্যাহত আছে।

সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মানুষের নিকৃষ্টতম পশুত্বটা অবলোকন করা যায় দাঙ্গাতে। দাঙ্গাতে অগ্নিসংযোগ, খুনাখুনি,লুট ও ধর্ষণ এমন কিছু নাই যে হয় না ইতিহাস তাই বলে। আমেরিকায় ১৯৬৮ সালে মাটিন লুথার জুনিয়ারের গুপ্তহত্যার পর সবচেয়ে বড় দাঙ্গা হয়েছিল। এর পরে আরও বিক্ষোভ ও দাঙ্গা হয়েছে কিন্ত বর্তমান ৮ দিন যাবত বিক্ষোভের চেয়ে বেশী নয়। বিশ্বের প্রতিটি মানুষ যদি ধর্ম ও বর্ণের বৈষম্য দূর করতে পারে সেদিন থেকে দুনিয়াতে আর কোন ভেদাভেদ থাকবে না।

ড.আব্দুস সাত্তার , লেখক ও সাংবাদিক ওয়াশিংটন ডি,সি
০৩/০৬/২০২০