রাজা সূর্য খাঁ


নকিব সাহেব খুব প্রফুল্ল মুডে আছে আজকে সারাদিন। কিছুক্ষণ পর পর এফবি’ নোটিফিকেশন চেক করছে। কয়েকবার লাইভও হয়ে গিয়েছে। কিছুক্ষণ পর পর বারান্দায় গিয়ে পায়চারি করছে আর মোবাইলে কথা বলছে। এফবি আর মোবাইলে কথা বলার ব্যস্ততায় জোহরের নামাজটাও সময়মতো পড়া হলোনা নকিব সাহেবের। সেদিকে খেয়ালই নেই তাঁঁর। অবশ্য ব্যস্ত থাকার কয়েকটা কারণও আছে। প্রথমত এফবি’র নোটিফিকেশনে উনার ব্যস্ততা বেশি বাড়ছে। তাঁর নয়-দশ বছরের ছেলে আজকে প্রথম রোজা রেখেছে। আর উনি তাঁর প্রথম অনুভূতি সমেত ছেলের সেল্ফি আপলোড দিয়েছেন এফবিতে। আর তাতেই নোটিফিকেশনের পর নোটিফিকেশন! কত কমেন্ট, শুভ কামনা আর কত উৎসাহ! এককথায় লাইক, কমেন্ট্স আর শেয়ারের বন্যা! হবেইতো, নকিব সাহেব এলাকার নাম করা জনপ্রতিনিধি। আর সিহাব তার একমাত্র ছেলে। লোকে তো একটু উৎসুক হবেই। আর দ্বিতীয় কারণটি ঘটনার শেষে বুঝতে পারবেন।
নকিব সাহেবের স্ত্রী খুব চটেছেন তাঁর উপর। সম্ভবত বেশি ব্যস্ততা দেখে উনার রাগের মাত্রাটাও বেড়েছে। হবেইতো! আজকে পুরো দেশ লক ডাউনে প্রায়ই একমাসের অধিক! কতদিন সহ্য করা যায়! স্বামী বাইরে থাকলেও ব্যস্ত, বাড়িতে থাকলেও ব্যস্ত! এই লকডাউনে, বাড়ির ভেতর ব্যস্ত থাকাটা তিনি পছন্দ করেন না। আর তাই তিনি ঘ্যানর ঘ্যানর করার ভলিউম বাড়িয়েছেন স্বামীর প্রতি। পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠলো —
— দুপুরের নামাজ পড়বানা?
— (ফোন কেটে) আযান দিয়েছে?
— যা ব্যস্ত তুমি, আযান কানে যাবে!
— না, আসলে খেয়াল করিনি!
— খেয়াল যখন করেছ, এখন যাও!
— সিহাব পড়েছে?
— না, ওজু করে তোমার জন্য বসে আছে।
— ওহ! তাহলেতো তাড়াতাড়ি যেতেই হয়!
বাপ ছেলে নামাজ পড়ে বারান্দায় ড্রইংরুমে বসে আছে। ছোট ছেলে সিহাবও তার প্রথম রোজা নিয়ে খুবই কৌতুহল। সারাক্ষণ এ’কে ওকে প্রশ্ন করেই যাচ্ছ।
— আচ্ছা বাবা, রোজা রাখলে পেটে ঝিনঝিন করে কেন? রোজা নষ্ট হয়ে যাচ্ছেনা তো!
— না বাবু! সকাল থেকে কিছু খাওনিতো, তাই পেট একটু কষ্ট পাচ্ছে। রোজা রাখলে এমনই হয়। কষ্ট লাগলে কিছু খেয়ে নিতে পারো, বাবু!
— আমাদের হুজুর বলেছিলো, রোজা রাখলে কিছু খেলে আল্লাহ পাপ দিবে।
— আল্লাহ তোমাকে পাপ দিবেনা, বাবু।
— কেন, আল্লাহ আমাকে ভালোবাসেনা?
— আল্লাহ তো ছোট ছেলেদের খুবই ভালোবাসে! পাপতো খারাপ জিনিস। যাকে ভালোবাসে তাকে কি পাপ দেয় যায়! আর তাই তোমাকে আল্লাহ পাপ দিবেনা।
— আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসেনা?
— কেন, আমাকেও আল্লাহ ভালোবাসে।
— তাহলে বল্লে যে, আল্লাহ ছোটদের ভালোবাসে। বড়দের ভালোবাসেনা? আর তুমিতো বড় হয়ে গেছ!
— না, বাবা। ভালো কাজ করলে ছোট বড় সবাইকে আল্লাহ ভালোবাসে।
হঠাৎ নকিব সাহেবের মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠলো। কল রিসিভ করে বেডরুমে চলে যায়। আর সিহাব মোবাইলে ভিডিও গেইম খেলতে ব্যস্ত।
— ইফতারের সময়!
সিহাবের মা ও কাজের মেয়ে টেবিলে ইফতারি সাজাচ্ছেন।
সিহাব হরেক রকম খাবারের আইটেম দেখে মহাখুশি। মন চাচ্ছে সে সব একাই খেয়ে নিবে।
অবশেষে বহুল প্রতীক্ষিত ইফতারের সময়টা আসলো। সিহাব, তার বাবা ও মায়ের সাথে ইফতার করতে বসে পড়লো। কিন্তু সিহাবের যতটুকু খাওয়ার ইচ্ছে ছিলো, ততটুকু খেতে পারলোনা! অল্প কতটুকুখেয়েই কেমন যেন অনীহা চলে আসছে।
ইফতার ও মাগরিবের নামাজ শেষে বাবা-ছেলে একসাথে বসে আছে। সিহাব মায়ের সাথে একটু কম মিশে। মা কর্মজীবী মহিলা। সপ্তাহে যে একদিন সময় পায় তা রেস্ট নিতেই চলে যায়। যা সময় পায় বাবা আর কাজের মেয়ে থেকে। কিন্তু গত একমাসের চেয়ে বেশি সময় ধরে সিহাব বাবা আর মাকে কাছে পাচ্ছে। বিশেষ করে সারাদেশে কোভিড-১৯ এর জন্য লকডাউন ঘোষণার পর থেকেই। সিহাব আর তার বাবা কথা বলছে–
–সিহাব দেখ, তোর সেল্ফিতে দুই হাজার লাইক আর শত শত কমেন্ট।
— ওয়ও বাবা! এত্ত মানুষ আমাকে চিনে!
— চিনবেনা!! নকিব সাহেবের ছেলে বলে কথা। সবাইতো চিনবেই।
বাবার কথা শেষ হতে না হতেই সিহাব তার বাবাকে প্রশ্ন করলো–
— আচ্ছা বাবা, আমার কতগুলো কথা রাখবে?
— কি কথা বল! তোর সব কথাতো রাখি। বল কি চাস,,
— আমার স্কুলের রোডে ঐ যে ফুলের দোকানের একটু দূরে, কয়েকটা ভাঙা ঝুপড়ি আছে। সেখানে চারটি পরিবার থাকে বাবা। প্রায়ই দেখি ওখানের ছোট ছেলেমেয়েরা মানুষ থেকে টাকা খোঁজে , খাবার খোঁজে। ওদেরকে তুমি মাসে মাসে টাকা দিতে পারবে?
( ছেলের মুখে এইরকম কথা নকিব সাহেব কখনও শুনেননি। তাই খুব হতভম্ব হয়ে গেছেন। তাপর জিজ্ঞেস করলো–)
— আজকে হঠাৎ এ কথা বলছিস কেন!
—আজকে রোজা থেকে বুঝেছি বাবা, একজন মানুষের ক্ষিধে লাগলে কতটুকু জ্বালা করে। আগে ঐ ভিখিরি ছোট ছেলেমেয়েদের দেখলে মেজাজ খারাপ হযে যেতো, রাগ হতো। সামান্য টাকা আর খাবারের জন্য মানুষের পাও ধরে!! কত ছোট মনে হতো কাজগুলো। কিন্তু আজকে বুঝলাম, তারা খিধের জ্বালায় এইসব করে। তুমিতো এই অঞ্চলের নেতা বাবা, ওদেরকে তুমি দেখবে বলে কথা দাও। এই সময়েতো কেউ ঘর থেকে বের হচ্ছেনা, ওদের কে টাকা দিবে? কে খেতে দিবে? তাদের কিছু দিয়ে এসো বাবা। ( তার বাবা খুব মন দিয়ে শুনছে তার কথা)
— ও আচ্ছা, এই কথা। ছেলেতো আমার অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। ওক্কে আমি কালকে ওদের দেখতে যাবো। আসার সময় এত্তগুলা জিনিস দিয়ে আসবো।
(কথা শেষ না হতেই নকিব সাহবের মোবাইল বেজে উঠলো। রিসিভ করতেই খুব টেনশনের খবর শুনেছেন মনে হচ্ছে। হঠাৎ হাত থেকে মোবাইল পড়ে যাওয়ার অবস্থা। তড়িঘড়ি করে রুমে গেলেন। রুমে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই প্রচন্ড ঝগড়ার আওয়াজ শোনে সিহাব ভয় পেয়ে গেল। রুমের দরজার পাশে গিয়ে সিহাব বুঝতে চেষ্টা করলো, আসল ঘটনা কি! কিন্তু খুব ভয় পাচ্ছে। বাবা মায়ের মধ্যে প্রচন্ড কথা কাটাকাটি হচ্ছে।)
মা — কতবার বুঝানোর চেষ্টা করেছি তোমাকে। অনেক হয়েছে, আর না! ছেলে বড় হচ্ছে, বুঝতে শিখছে আর তুমি এইসব কি নিয়ে আছ! সম্পদতো অনেক কামালে, কাল মরলে কে খাবে? অনেকবার ওয়ার্নিং করেছিলাম, এটা শেষবার বলতে বলতে প্রতিটি শেষের পর থেকেই আরো একটা নতুন করে শুরু কর।
বাবা– কথা কম বল! মেজাজ গরম আছে! সব কি আমি একা নিয়েছি সম্পদ? তোমার নামেইতো অর্ধেক সম্পদ নিয়েছি। আর এখন আসছ জ্ঞান দিতে!
(মোবাইলটি আছাড় দিয়ে ভেঙে ঘরে থেকে বের হয়ে গেল নকিব সাহেব।)

এইদিকে সিহাব কিছুই বুঝে উঠতে পারলোনা। হঠাৎ হাসিখুশির মাঝে এমন পরিস্থিতি ঠিক বুঝে উঠতে পারছেনা ছোট্য সিহাব। তার মাকে, রুমে কান্না করতে দেখছে।

কিছুক্ষণ পর,,,,,,

কাজের মেয়েটি দৌড়ে এসে সিহাবের মাকে বল্ল- “খালাম্মা, খালুরে টিভিতে দেখাইতাছে। কিসব খারাপ কথা বলতাছে”!

সিহাবের মা তার কথা শুনে তেমন সাঁড়া দিলোনা। ততক্ষণে কাজের মেয়েটি দৌড়ে আবার টিভি’র পাশে চলে গেছে। হয়তো সিহাবের মা আগে থেকেই জানে সব। তাই তেমন সাঁড়া দেয়নি। কিন্তু সিহাব কিছুই বুঝতে পারলোনা। সেও কি একটা মনে করে কৌতূহল বসত, দৌড় দিল টিভি রুমের দিকে। টিভি দেখে সে অবাক হয়ে গেল! এ’কি দেখছে সে!! তার প্রিয় বাবার ছবির নিচে লিখা আছে চাল চোর! RAB ১,৫০০ বস্তা সরকারি চালের খালি বস্তা উদ্ধার করেছে তার বাগান বাড়ি থেকে। ছোট্ট শিশুর আর বুঝতে বাকি রইলোনা।

বুঝতে পারার বয়স হতে, যে বাবাকে সে অতি ভালো মানুষের চোখে দেখে আসছে, সে আজ চাল চুরি করছে! ব্যপারটি সিহাবের কাছে খুবই খারাপ লেগেছে। হয়তো তার জীবনের প্রথম রোজা তাকে বুঝতে সাহায্য করেছে যে, মানুষের ক্ষুধার জ্বালা মেটানো চাল চুরি করা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম চুরির মধ্যে অন্যতম! যে বাবা সিহাবের ক্ষুধার জ্বালা নিভায় সে আজ শত শত মানুষের ক্ষুধার কারণ! খুব কান্না পাচ্ছে তার। রুমে গিয়ে তার পড়ার টেবিলে মন খারাপ করে বসে পড়লো।

সিহাবের আরেকটা অভ্যাস হচ্ছে, তার কোন কিছু খারাপ বা ভালো লাগলে একখণ্ড কাগজে নোট করে নিয়ে পড়ার টেবিলের উপর দেয়ালের সাথে লাগিয়ে রাখে। আজও তার ব্যতিক্রম হলোনা।

সে কাগজ খানা নিয়ে লিখলো——– ” যে অামার ক্ষুধার জ্বালা নিভানোর ব্যবস্থা করে, সে অন্যের ক্ষুধার জ্বালা বাড়ানোর কারণ”!

ছোট ছেলেটি হয়তো মুখ ফুটে কাউকে কিছু বলতে পারবেনা। কিন্তু একজন বাবা, তার ছোট ছেলের কাছে অাজীবন দোষী হয়ে থাকবে। সিহাবের কাছে আজ বাবা মানে অন্যকিছু। যতবারই তার “বাবা” নামটি মনে পড়বে, ততবারই “চোর” নামক ঘৃণিত শব্দটিও ভেসে উঠবে! এর চেয়ে ভয়ানক আর কিছু হতে পারেনা। সিহাব যতদিন বেঁচে থাকবে, হয়তো তার জীবনে এই “বাবা” শব্দটা এক অস্বস্তির কারণ হবে। সিহাবও একদিন বাবা হবে। তবে নিশ্চিত করে বলতে পারি, তার ছেলের জন্য একটা উপযুক্ত “বাবা” শব্দটি রেখে যাবে। কারণ সে জানে, অনুপযুক্ত “বাবা” শব্দটি সারাজীবন কত অস্বস্তির হয়!!

——-“ধ্বংস হোক, যারা ক্ষুধার জ্বালা নিভানোর সুযোগ পেয়েও কাজে লাগাতে পারলোনা”।
——-” ধ্বংস হোক, যারা মহান “বাবা” শব্দের সঠিক চর্চা করতে পারেনি”।

প্রচ্ছদ : রাজা সূর্য খাঁ