রায়হান আজাদ

আজ সেই ভয়াল ২৯ এপ্রিলের ২৯ বছর। ১৯৯১ সালে আজকের এই দিনে বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী অঞ্চল বিশেষ করে চট্টগ্রাম ও তার আশেপাশের দ্বীপগুলোতে শতাব্দীর ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় প্রবাহিত হয়। মহা প্রলয়ংকরী এ ঘূির্ণঝড় ও জলোচ্ছ¡াসে লাখ লাখ আবালবৃদ্ধবনিতা প্রাণ হারায়। অর্থনৈতিকভাবে সীমাহীন বিপর্যস্ত হয় এতদাঞ্চলের আড়াই কোটি জনগণ। নিরীহ পশুপাখী, ক্ষেত- খামার, হাট বাজার ও দালান-কৌটার ব্যাপক ক্ষতি সাধন হয়। ২০/২৫ফুট লোনা পানিতে তলিয়ে যায় দীন হীন মজুরের বসত ভিটা। সৃষ্টির সেরা মানুষ ও হিংস্র কীট-পতঙ্গ একাকার হয়ে লড়াই করে জীবনের শেষ অস্তিত্বটুকুর জন্য। চারিদিকে ত্রাহি ত্রাহি মানবতা । গলিত লাশের মিছিলে উৎকট গন্ধ। খালের পাড়ে, রাস্তার ধারে বেওয়ারিশ লাশের মাংস নিয়ে কুকুর ও শকুনের কামড়াকামড়ি। কোন উসিলায় বেঁচে যাওয়া আত্মীয়-স্বজনের বুকফাটা আহাজারি ও দু‘ মুঠো ভাত পেটে দেয়ার অশ্রæসজল আর্তনাদ আকাশ বাতাস ভারী করে তুলছিল।

৪৭,২০১ বর্গ কি.মি এলাকা জুড়ে বিস্তৃত বাংলাদেশের উপকুলীয় অঞ্চল। ১৮০ কি. মি প্রচন্ড গতিবেগে আবহাওয়া মুহুর্তেই সব নিঃশেষ করে দেয়। সরকারি হিসেব মতে, ১০২ টি উপজেলায় দেড় লক্ষ মানুষ মারা যায়। আর বেসরকারি মতে, প্রায় আড়াই লাখ লোক মারা যায়। খোদ কুতুবদিয়াতে ১০ হাজারেরও বেশী লোক নিহত হয়। এভাবে গত ২০০ (১৭৯৪- ১৯৯৮) বছরে প্রায় ৭০টি জলোচ্ছ¡াস হয়। তন্মেধ্যে গত ৩৮ বছরে (১৯৬০-১৯৯৮) ১৫টি ভয়াল ঘূুর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ¡াস হয়েছে। ১৯৯১ এর ঘূুর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ¡াসে কক্সবাজার,মহেশখালী, চকরিয়া,পেকুয়া, কুতুবদিয়া, বাঁশখালী, আনোয়ারা, স›দ্বীপ, হাতিয়া, চাঁদপুর ও নোয়াখালীর ১ কোটি জনগণ আত্মীয়-স্বজন ও ধন-দৌলত সবকিছু হারিয়ে নাস্তানাবুদ হয়ে পড়ে। ৫লাখ গবাদি পশু মারা যায়। ১১লাখ ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়। ২৭৮৬০০ একর জমির ফসল নষ্ট হয়, ৬৫০০ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়েছিল,৪৭০কি.মি বাঁধ ধ্বংস হয়। ৭২০০০ হেক্টর আমন ধানের জমিতে নোনা পানি ঢুকে পড়েছিল । এসব এলাকার মৃত্যু বিভীষিকার করুণ চিত্র বর্ণনার ভাষা খুঁজে পাওয়া যায় না।

আমার তখন কৈশোরের কাঁচা বয়স। ফজরের আজান হলে গাছে গাছে আবছা আঁধারে আম কুড়াতাম। চৈত-বোশেখের ঝড়ে আম আর লিচু খোঁজার জন্য লুকিয়ে থাকতাম মটরশুটির বনে। মনে পড়ে বিদ্যুৎ-বিজলির সাথে লুকোচুরি করে আজলাভরে আম কুড়ানোর স্মৃতি। গুম ধরা আকাশ সন্ধের পর পিন পিন বৃষ্টি। পাড়াময় হিড়িক পড়েছে তুফান হবে আজ। ১০নং মহা বিপদ সংকেত। কুতুবদিয়া, মগনামা, বদরখালী, ছনুয়া ও রাজাখালীর হতদরিদ্র মানুষগুলো তল্পিতল্পাসহ আত্মীয়ের স›দ্ধানে পাহাড়িয়া এলাকার দিকে ছুটছে। টইটং খালের পাশেই আমাদের মাস্টার বাড়ি। বাড়ির পাশ ঘেঁষে যেই সড়কটি পাহাড়িয়া এলাকায় চলে গেছে সেই সড়কে আতংকিত মানুষের মিছিল। কাঁধে লেপ কাঁথা কম্বল। দু‘হাতে ব্যাগ-বাস্কেট আর কোলে পিঠে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করছে বাচ্চা-কাচ্চা । খালে ফিশিং বোটের সারি। ডিঙ্গি, লঞ্চ, সাম্পান সবই আছে। মাঝি মাল্লার চোখে-মুখে বাঁচার আকুতি।

আমাদের পাড়ার নিন্ম মধ্যবিত্ত সবাই যত পারে চাল ডাল আলু ক্রয় করে বেতার-টিভির নির্দেশনা মত পলিথিন ও প্লাষ্টিক মুড়িয়ে ঘরে গর্ত করে জমা রেখেছে। এশার পর আমরা ঘুমিয়ে পড়ছিলাম। রাত ১০টার পর চারিদিকে প্রবল বাতাস ছুটলে আব্বা আমাদেরকে পাশ্ববর্তী চাচাদের দ্বিতল বিল্ডিংয়ে রেখে আসে। সেখানে যাওয়ার পথটি আম আর নারিকেলে বিছানো ছিল। মনে পড়ে আমি এ দুর্দিনেও দু‘চারটি পাকা আম নিয়েছিলাম। মধ্যরাতে বাবুদের ঐ বিল্ডিংয়ে লোকে লোকারণ্য। কোথাও ঠাঁই নেই। দ্বিতলায় উঠে দেখি, সমাজের গরীব লোকগুলো ওখানে ইলিশ ফাইল। পাড়ার মফিজ খুব বউ পাগলা। সে সদ্য বিয়ে করেছে। এমন ভয় ও ভীড়ে সে তার বউকে বলছে ‘অ বউ তুই ধরিস’-কথাটি এখনো কানে বাজে যদিও এরা এখন বুড়ো হয়ে গেছে। এলাকার মুরব্বীরা নিচ তলায় রেডিওর খবর শুনছে। র্ঘ্যা র্ঘ্যা করছে রেডিও। কিছু বুঝা যায় আর কিছু যায় না। বলাবলি হচ্ছে, রাত ১২টর দিকে পানি আসছে। কিন্তু সাড়ে বারোটার মধ্যেও না আসলে ঘুটঘুটে অন্ধকারে আমি একাই বেরিয়ে পড়ি বাড়ির সম্মুখস্থ ওয়াফদা রোডে। কেন পানি আসতে দেরী হচ্ছে দেখার জন্য! কী পিচ্ছিল রাস্তা! পায়ের নকে শক্ত খুঁট দিয়ে চলি। যেতে যেতে আমাদের মসজিদ ভিটা পর্যন্ত গেলে দেখি তীব্র বাতাসে টিকে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। তখন আমি যা দেখলাম তার চিত্র জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘খেয়াপারের তরণী’ কবিতায় কিছুটা ফুটে উঠেছে-

“তমসাবৃতা ঘোরা ‘কিয়ামত’ রাত্রি,

খেয়া-পারে আশা নাই ডুবিল রে যাত্রী!

দমকি দমকি দেয়া হাঁকে কাঁপে দামিনী,

শিঙ্গার হুঙ্কারে থরথর যামিনী!

লঙ্ঘি এ সিন্ধুরে প্রলয়ের নৃত্যে

ওগো কার তরী ধায় নির্ভীক চিত্তে–

অবহেলি জলধির ভৈরব গর্জন

প্রলয়ের ডঙ্কার ওঙ্কার তর্জন!”

গভীর রাতে সেদিন আমি ঈষাণ কোণে আগুন দেখেছি। প্রকান্ড সাগর যেন ধেয়ে আসছে আমাকে ভাসিয়ে নেয়ার জন্য।বিশাল মেঘমালা সাগরকে তাড়িয়ে আনছে বলে মনে হয়েছে। আমি ভয় পেয়ে চাচুদের ঘরে চলে এলাম। শেষতক সাহরীর সময়ে পানি এসেই পড়ল। সে অন্য কাহিনী অন্যদিন বলব, ইনশাল্লাহ।

আজ ২৯ বছর পর সেই পরিবেশের অনেক কিছু বদলে গেছে। গ্রাম নতুন রূপ ধারণ করেছে। শত শত দালান-কৌটা গড়ে উঠেছে। তবে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, এখনও ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়ের প্রাকৃতিক ক্ষয়ক্ষতি পুরোপুরি পুষিয়ে নেয়া সম্ভব হয়নি। #