রায়হান আজাদ

আজ আমার আব্বা মাওলানা আবদুর রহমানের ১৯তম ওফাত দিবস। ২০০১ সালের এদিনে তিনি না ফেরা দেশে পাড়ি জমান। তিনি ছিলেন আজীবন শিক্ষক, ইমাম ও সমাজ সংস্কারক সর্বোপরি গরীব-দু:খী মানুষের নিবেদিতপ্রাণ বন্ধু। ১৯৩৮ সালে বাবা আবদুল আজিজ সিকদার ও মাতা হাফেজা খাতুনের ঔরসে ছোট সন্তান হিসেবে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। তদীয় পিতামহ কেরামত আলী সিকদার ছিলেন তৎকালিন সময়ে বাঁশখালীর দক্ষিণ পুঁইছড়ী ও পেকুয়ার টইটং মৌজার অবিসংবাদিত জমিদার ও প্রভাবশালী ব্যক্তি। তিনি বেশ শান-শওকতে ঘোড়ায় চলাফেরা করতেন; প্রায় দেড়শো বছর আগে টইটংয়ের খামারবাড়িতে আমাদের বংশধারার গোড়াপত্তন করেন। শতাধিক বছর আগে পানির জাহাজে করে হজ্জব্রত পালনের উদ্দেশে মক্কাশরীফ গেলে তিনি সেখানেই ইন্তেকাল করেন এবং সেখানেই চিরতরে শায়িত হন।

বাবা ছিলেন মাদরাসা শিক্ষিত। তিনি অল্পবয়সে দাদাকে হারান। দাদীর স্নেহানুকূল্যে বড় হন এবং পড়াশোনা করেন। দক্ষিণ চট্টগ্রামের সর্বাধিক প্রাচীন দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পুঁইছড়ী ইসলামিয়া মাদরাসা হতে তিনি সর্বোচ্চ ডিগ্রি গ্রহণ করেন। এরপর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পর পিটিআই ট্রেনিংসহ আরো বহু ট্রেনিং গ্রহণ করেন। তিনি পেকুয়া উপজেলার প্রায় ৭/৮টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। তখনকার সময়ে গ্রামের রাস্তা-ঘাট ছিল কাঁচা, ভাঙ্গা কিংবা কর্দমাক্ত। তিনি অত্যন্ত কষ্টসহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়ে শিক্ষকতা পেশায় নিয়েজিত ছিলেন। তার ছাত্ররা আজ সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বড় বড় পজিশনে রয়েছেন। বিএনপি নেতা ও সাবেকমন্ত্রী সালাহ উদ্দীনও এককালে বাবার ছাত্র ছিলেন।

বাবার ইন্তেকালের এই ১৯ বছর পরে আজ কতইনা স্মৃতি মনে পড়ে। তবে যে বিষয়টি হৃদয়ে সবচে বেশী রেখাপাত করে তাহল বাবা আমাদেরকে শিক্ষাদীক্ষায় মানুষ করার জন্য যার পর নেই চেষ্টা করে গেছেন কিন্তু তিনি আমাদের অর্জন/উপার্জন কোন কিছুই দেখে যেতে পারেননি!

আমার বাবার ভূমিকা দেখেছি ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলে। সেদিন প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে লন্ডভন্ড হয়ে যায় আমাদের পুরো গ্রাম। আমাদের মসজিদ, বাড়ি ও কাচারিঘরের বেহালদশা। ভিটার চারপাশের পাকা বাউন্ডারি ওয়ালও ভেসে যায়। তিনি কিন্তু সেদিনের ফজরের নামাযও পানির উপর গাড়া চৌকিতে জামাআতে আদায় করেন। কতুবদিয়া, ছনুয়া-রাজাখালী ও মগনামা হতে ভেসে আসা লাশগুলো একত্রিত করে জানাযা দিয়ে আমাদের গোরস্থানে দাফনের ব্যবস্থা করেন। যাদের খাবার-দাবার ও আসবাবপত্রের সংকট ছিল তিনি তাদের পাশে দাঁড়িয়ে যান।

আমরা ছোটবেলা থেকে দেখেছি সবসময় আমাদের পরিবারে স্বচ্ছলতা ছিল। চাচা-জেঠারা আমাদের থেকে টাকা-পয়সা ধার নিতেন। আমাদের গোলাভরা ধান,পুকুরভরা মাছ,গোয়ালভরা গরু আর অর্ধএকর নয়াভিটাজুড়ে মওসুমি শষ্যক্ষেত্র ছিল। ধান চূড়ানোর মেশিন ছিল। ছিল আম-জাম ও সারি সারি খেঁজুর গাছ। সবসময় সিজনওয়ারী কাজের লোক ছিল। সকালবেলা বাবার সাথে দুধ দোহন ও খেঁজুর রস সংগ্রহকরণ ছিল আমার কাছে দারুণ মজার। আমি ছিলাম খেজুর রসের পোকা। চাঁদের রাতে চুরি করে খেজুর রস পিয়ে নিতাম আর পানি খাওয়ার বাহানা করে পাকঘরে ঢুকে ডেকছি থেকেও গ্লাসপুরে ঢকঢকে পান করতাম।

বাবা পাড়ার মসজিদে অনেকটা অবৈতনিকভাবে ইমামতি করতেন। তিনি প্রত্যহ ফজরে বাড়ির বারান্দা কিংবা কাছারি ঘরের চৌকাঠে বসে গলা ছেড়ে কুরআন তিলাওয়াত করতেন। এখনও বাড়ি গেলে সেই চিরচেনা সূর হৃদয়ে বাজে। আল্লাহ পাক বলেছেন, “ইন্না কুরআনাল ফজরে কা-না মাশহুদা” অর্থ্যাৎ নিশ্চয় সকালবেলা কুরআন তিলাওয়াত আবৃত্তিকারীর স্বপক্ষে সাক্ষী হয়ে দাঁড়াবে। বাবার ক্ষেত্রে ঘটছেও তাই, ইনশাল্লাহ।

আমার সময়ে আমরা দুইভাই শহরে পড়াশোনা করতাম। বড়ভাই আগেই পড়াশোনা শেষ করেছেন, সবার ছোটভাই তখনও শহরে আসার সময় হয়নি। আমার ইমিডিয়েট ছোটভাই (বর্তমানে জজ) চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে আর আমি দারুল উলূম আলিয়া মাদরাসায় পড়াশোনা করতাম। বাবা আমাদের খরচ যোগাতে কার্পণ্য করতেন না। তবে টাকা দেয়ার সময় তিনি যে কত কষ্ট করে পড়াশোনা করেছেন-সেটা তুলে ধরতেন। তিনি মাঝে মাঝে আমাদের কাছে চিঠি লিখতেন। বলতেন, “বাবা! লজিং-টিউশনি ও আজেবাজে কাজে সময় নষ্ট করিও না, পাঠ্যবই বেশী পড়িও। কারণ, রেজাল্ট ভাল করতে হবে। সবশেষে বলতেন, নামায-দু‘আ ঠিক মত আদায় করবে”। তিনি কারো মাধ্যমে শহরে টাকা পাঠাতে স্বাচ্ছন্দবোধ করতেন না; বলতেন, আমার ছেলের কাছে আমার টাকার প্রয়োজন, আমাকে দেখার কোন প্রয়োজন নেই? তাই আমরা প্রতিমাসে অন্ততপক্ষে একবার বাড়ি যেতাম। যেদিন বাড়ি যেতাম সেদিন ইশার পড়ে পাকঘরে ঈদের আমেজ বসে যেত। বাবা হিসেব করে আগেই আমাদের জন্য স্থানীয় বাজার হতে আম-কাঁঠাল ও তরমুজ নিয়ে আসতেন আর আমরাও শহর থেকে নানান ফল-ফলাদি নিয়ে যেতাম। রাতের খাবার শেষে এসব ফলমূল খেতে খেতে খোশ-গল্পে কখন যে মধ্যরাত্রি গড়িয়ে যেত টেরও পেতাম না। আমাদের গল্পের শিরোনাম ছিল দেশের চলমান রাজনীতি ও মুসলিম উম্মাহর সমসাময়িক পরিস্থিতি।

চাঁদোয়া রাতে বাড়ির উঠোনে চেয়ারে বসে বাবা উর্দু-ফার্সি বয়ত আবৃত্তি করতেন। বাবাদের আমলে মাদরাসায় উর্দু-ফার্সি সিলেবাস ছিল,আমরা পাইনি। আল্লামা ইকবাল, সাদী, জামী ও রুমির প্রচুর শে‘র আব্বার মুখস্থ ছিল। তিনি সুরেলাকন্ঠে এসব আউড়ালে আমার কচিমনে আনচান শুরু হয়ে যেত। একদিন আমি বললাম,বাবা! আপনার থেকে আমাকে কিছু শ্লোক শিখিয়ে দেন। তখন তিনি বললেন, তুমি খাতা-কলম নিয়ে এসো এবং লিখ: মাদরাসা হি বাগে বেহেশত, মুআল্লিম খোশগওয়ারে ফুল/ শহদ উস্ মে ইলমে দ্বীনউ তালেবানে বুলবুল/ ওয়াতান ছে কিয়া মুরাদ হি, মাদরাসা হি ওয়াতান আপনা/মরঙ্গে হাম কিতাবউ ছে ওয়ারক হু গা কাফন আপনা ॥ অর্থ্যাৎ মাদরাসা হচ্ছে বেহেশতের বাগান। শিক্ষকগণ হলেন ঐ বাগানের সুবাসিত পুষ্প। সে পুষ্পের মধু হচ্ছে দ্বীনী ইলম আর শিক্ষার্থীরা মধুকর সদৃশ। বৎস, বাড়ি-ঘরের সাথে তোমার কীসের সম্পর্ক? মাদরাসাই হবে তোমার আসল নীড়। মরে গেলে বইয়ের পাতা যেন হয় তোমার কাফনের কাপড়। এ কবিতায় তিনি কী ম্যাসেজ দিয়েছেন, সেটা আমি পরবর্তী জীবনে হাড়ে হাড়ে টের পাই। তাইতো বাড়ির পাশে সেরকম একটি স্থায়ী আবাস হোক- সে প্রত্যাশায় তারই ইছালে সাওয়াবের নিয়্যতে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছি, আলহামদুলিল্লাহ।

আজ আমার এ পর্যায়ে আসার পেছনে স্বাভাবিকভাবে আমার বাবার ভূমিকাই হচ্ছে সবচে‘ বেশী। তিনি ২০০১ সালে আমার প্রথম প্রকাশিতব্য গ্রন্থের জন্য এককাীলন অনুদান দিয়েছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত, তিনি জীবদ্দশায় এ বই দেখে যেতে পারেননি। ছোটকালে আমি ছিলাম ছটফটে ও সমাজমুখী কিশোর। ১৯৯১ সালের এম.পি ইলেকশানে অনেক দৌড়াদৌড়ি করেছিলাম। আমি একটি পথসভার আয়োজন করলে বাবা হলেন ঐ সভার সভাপতি। তখনকার সময়ে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে একজন মেম্বারের পক্ষে আমি জীবনে প্রথম মাইক্রোফোনে কথা বলি। সেখানেও বাবা ছিলেন সভাপতি। তখন তিনি আমাকে অভয় দিয়ে বলেছিলেন, “ অ পূত! আমি পাশে আছি, তুমি বক্তৃতা শুরু কর।” এরপর বাবা মাঝে মাঝে আমাকে জুম‘আর খুতবার পূর্বে আলোচনা রাখার সুযোগ করে দিতেন। ফলে কোনদিন তিনি হাজির হতে না পারলে খুৎবা দেয়াসহ জুমআর নামাযও আমি পড়িয়ে দিতাম। এভাবে পরে আমি আরো বহুবার জুমআর নামাযের ইমামতি এমনকি ঈদের নামাযের ইমামতিও করেছি আমার সেই বাল্য বয়সে। বাবার অসুস্থতাকালে বাবার বিকল্প হিসেবে স্কুলে গিয়ে ক্লাসও নিতাম মাঝে মাঝে। আমার সেই ছাত্রছাত্রীরা আমার চেয়ে দুয়েক বছরের বেশী ছোট হবে না।

বাবা ছিলেন খুবই কর্মমুখর সাংসারিক ব্যক্তি। তিনি যেমনি স্কুল ফেরত হলেই কাজে লেগে যেতেন তেমনি আমাদেরও ডাক পড়ত এই কাজ, ওইকাজে। আমি ছিলাম বাবার বেশ ভক্ত। রাত্রে শু‘তামও বাবার সাথে। কৃষি গেরস্থের হেনকাজ বাকী নেই যা আমি কৈশোরে করিনি। এখন এসব কল্পনা, বিরানভূমি!। সবাই দেখি মোবাইল টেপাটেপি করে।

আরো বহুত স্মৃতি আজ হৃদয়ে এসে ভীড় জমিয়েছে। পাঠকের ধৈর্যচ্যূতি ঘটার আশংকায় সেসব আর উল্লেখ করছি না। বাবার ইন্তেকালের বছর দৈনিক ইনকিলাবসহ চট্টগ্রামের বহু পত্র-পত্রিকায় বাবার জীবন বৃত্তান্ত নিয়ে আমার একটি লিখা ছাপা হয়েছিল। সেটি হয়ত অনেকে পড়েছেন। আজ লকডাউনের এই অবসরে যৎকিঞ্চিত স্মৃতিচারণ করলাম।

বাবা ৬৩ বছরের এ হায়াতকালে আমাদেরকে শিক্ষানুরাগ, সহজ-সরল, নিরহংকার ও ধার্মিক জীবনের একটি চিত্র দিয়ে গেছেন। তাইতো আমরা বাবার বেশকিছু কারামতও লক্ষ্য করেছি। আজ পহেলা রমজানের রহমত দশকে মহামহিম পরওয়ারদেগারের কাছে ফরিয়াদ! আয় আল্লাহ, আমার বাবা মরহুমকে মাফ করে দিন এবং সর্বোচ্চ জান্নাতের মেহমান করে নিন। আমীন। ইয়া রাব্বাল আলামীন ॥

লেখক: সহকারি অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ ডিপার্টমেন্ট, কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।