সিবিএন ডেস্ক:

বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে নভেল করোনাভাইরাস। কিন্তু মানবদেহে এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য এখন পর্যন্ত কোনো ভ্যাকসিন নেই। এই অবস্থার পরিবর্তনে বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানী ও মেডিকেল গবেষকরা অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

বহুল প্রত্যাশিত করোনার ভ্যাকসিনের ব্যাপারে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি। প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন বিবিসির স্বাস্থ্য ও বিজ্ঞানবিষয়ক প্রতিনিধি জেমস গ্যাল্লাঘের। চলুন জেনে নেয়া যাক এই ভ্যাকসিনের আদ্যোপান্ত

করোনার একটি ভ্যাকসিন কেন গুরুত্বপূর্ণ?

ভাইরাসটি সহজেই ছড়িয়ে পড়ছে এবং বিশ্বের অধিকাংশ মানুষই এই ভাইরাসের ঝুঁকিতে আছে। ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে কিছুটা প্রশিক্ষণ দিতে পারে একটি ভ্যাকসিন; যাতে আক্রান্ত হলেও অসুস্থ না হয়।

ভ্যাকসিন পাওয়া গেলেই লকডাউন নিরাপদে তুলে নেয়া যাবে। শিথিল করা যাবে সামাজিক দূরত্বের নিয়ম।

ভ্যাকসিনের অগ্রগতি কতদূর?

দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণার কাজ। করোনার ভ্যাকসিন তৈরির কাজ নিয়ে এই মুহূর্তে বিশ্বের ৮০টিরও বেশি গবেষণা চলছে; এর মধ্যে কয়েকটি ইতোমধ্যে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালও চালিয়েছে।

** গত মাসে প্রথমবারের মতো মানবদেহে করোনার ভ্যাকসিনের ট্রায়াল চালান যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলের বিজ্ঞানীরা। ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা এবং নিরাপত্তা যাচাইয়ের জন্য প্রাণীর দেহে ভ্যাকসিনটির পরীক্ষা চালানোর নিয়ম থাকলেও তা করা হয়নি; সরাসরি মানবদেহে প্রয়োগ করা হয়।

** বিশ্বখ্যাত ফার্মাসিউটিক্যালস জায়ান্ট কোম্পানি গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইন (জিএসকে) ও সানোফি যৌথভাবে একটি ভ্যাকসিন তৈরি করছে।

** অস্ট্রেলিয়ার বিজ্ঞানীরা প্রাণীর দেহে সম্ভাব্য দু’টি ভ্যাকসিনের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করেছে। এটাই প্রাণীর দেহে প্রথম কোনো করোনার ভ্যাকসিনের প্রয়োগ। চলতি মাসের শেষ দিকে অস্ট্রেলীয় এই বিজ্ঞানীরা ভ্যাকসিনটি মানবদেহে প্রয়োগের প্রত্যাশা করেছেন।

** যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানী আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে একটি ভ্যাকসিনের কয়েক লাখ ডোজ তৈরির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন। মানবদেহে ভ্যাকসিনটির পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু করছেন তারা।

তবে এসব ভ্যাকসিনের কোনটি কার্যকরী হবে সে সম্পর্কে কেউই জানেন না।

ভ্যাকসিন কীভাবে তৈরি হয়?

ক্ষতিকারক ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া (বা তাদের ছোট অংশগুলো) মানবদেহের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাতে দেখা যায়। তখন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা এই ভাইরাসকে আক্রমণকারী হিসেবে শনাক্ত করে এবং সেখানে এটির সঙ্গে কীভাবে লড়াই করতে হবে সেটি শিখে যায়। তখন বাস্তব পরিস্থিতিতে এই ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই শুরু করে; কারণ সে আগেই জেনে গেছে কীভাবে এটিকে লড়াই করে হারাতে হবে।

কয়েক দশক ধরে ভ্যাকসিন প্রয়োগের প্রধান পদ্ধতি হলো প্রকৃত ভাইরাসকে ব্যবহার করে এর প্রয়োগ করা। হাম, মাম্পস (লালাগ্রন্থির একধরনের ভাইরাস সংক্রমণে সৃষ্ট প্রদাহ) এবং রুবেলা (এমএমআর) ভ্যাকসিনগুলো সেই ভাইরাসের দুর্বল স্তরের ভাইরাসকে ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছিল; যে স্তরটি পুরোমাত্রায় সংক্রমণ ঘটাতে পারে না। কিন্তু মৌসুমী ফ্লুর ক্ষেত্রে এই ফ্লুর প্রধান প্রজাতিটির ব্যবহার করে ভ্যাকসিন তৈরি করা হয়; যা এই ফ্লুকে একেবারে নিস্ক্রিয় করতে পারে।

করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরির কাজ একেবারে নতুন এবং কম পরীক্ষিত উপায়ে করা হচ্ছে। এই উপায়টিকে বলা হচ্ছে ‘প্লাগ অ্যান্ড প্লে’। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, ইতোমধ্যে নতুন করোনাভাইরাস, সার্স-কোভ-২’র জেনেটিক কোড জানা গেছে এবং এই ভাইরাস তৈরির একটি অবিকল নকশাও পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা।

কিছু ভ্যাকসিন বিজ্ঞানী ইতোমধ্যে করোনাভাইরাসের জেনেটিক কোড থেকে কিছু অংশ তুলে নিয়ে তা নিরীহ প্রজাতির ভাইরাসের সঙ্গে রাখছেন। যেখানে নিরীহ প্রজাতির বাগের মাধ্যমে কাউকে সংক্রমণ করতে পারে এই ভাইরাস। এরপর তাত্ত্বিকভাবে সেখানে সংক্রমণের বিরুদ্ধে কিছুটা প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে।

অন্যদিকে, কিছু বিজ্ঞানী করোনাভাইরাসের একেবারে ‘র জেনিটিক কোড’ (ডিএনএ অথবা আরএনএ পদ্ধতি) ব্যবহার করে ভ্যাকসিন তৈরির কাজ করছেন। যা একবার মানবদেহে প্রয়োগ করা হলে তা ভাইরাল প্রোটিন উৎপাদনের কাজ শুরু করবে। ফলে এর মাধ্যমে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা আবারও করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে শিখবে। বহুল প্রতীক্ষিত এই ভ্যাকসিন কবে আলোর মুখ দেখবে এখন সেদিকে চেয়ে আছে বিশ্বের কোটি প্রাণ।

কখন পাওয়া যাবে করোনার ভ্যাকসিন?

যেকোনও ভ্যাকসিন তৈরির জন্য স্বাভাবিকভাবেই এক বছরের বেশি সময়ের দরকার হয়; দশক নয়। গবেষকরা আশা করছেন, আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই তারা একটি কার্যকরী করোনার ভ্যাকসিন তৈরি করতে সক্ষম হবেন।

অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের ধারণা ২০২১ সালের মাঝের দিকে একটি ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে; যা সার্স-কোভ-২ নামের নতুন এই ভাইরাসটির সন্ধান পাওয়ার পর প্রায় ১২ থেকে ১৮ মাস পর। যদি তাই হয়; তাহলে সেটি হবে বিজ্ঞানের অন্যতম আবিষ্কার। তবে এটি কাজ করবে কি-না সেই নিশ্চয়তা নেই।

মানবদেহে ইতোমধ্যে চার ধরনের করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে। সবগুলোর উপসর্গ সাধারণ জ্বর-সর্দি। তবে এসবের কোনোটিরই ভ্যাকসিন নেই।

আরও যা করতে হবে

** বেশ কিছু গবেষক দল সম্ভাব্য করোনা ভ্যাকসিনের নকশা করেছেন। তবে এখনও অনেক কাজ করার বাকি আছে।

** পরীক্ষামূলক প্রয়োগে ভ্যাকসিনটি নিরাপদ কিনা; সেটি জানা দরকার। ভ্যাকসিনের কাজই হচ্ছে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। ফলে ভাইরাস সংক্রমিত হলেও ভ্যাকসিনটি নেয়া থাকলে কেউ অসুস্থ হবেন না

** ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে রোগটি সাড়ানোর পরিবর্তে যদি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বেশি দেখা দেয়; তাহলে ভ্যাকসিন প্রত্যাহার করতে হবে

** ভ্যাকসিন উৎপাদনের সময় বিশাল পরিমাণে কোটি কোটি ডোজ উৎপাদনের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে

** মানবদেহে প্রয়োগের আগে ওষুধ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন অবশ্যই নিতে হবে

** অবশেষে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের শরীরে এই ভ্যাকসিন প্রয়োগের চূড়ান্ত চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে

এই প্রক্রিয়াকে ধীরগতির করতে পারে লকডাউন। যদি কম সংখ্যক মানুষ সংক্রমিত হন; তাহলে আসলেই ভ্যাকসিনটি কাজ করবে কিনা তা জানতে দীর্ঘ সময় লাগতে পারে

মানুষকে ভ্যাকসিন প্রয়োগ এবং ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের সংক্রমিত করার এই ধারণার (গবেষণার জন্য চ্যালেঞ্জ) জবাব পাওয়া যাবে দ্রুত। কিন্তু এটি খুবই বিপজ্জনক একটি কাজ। কারণ এই ভাইরাসের এখনও কোনো চিকিৎসা জানা নেই।

কতসংখ্যক মানুষকে ভ্যাকসিন দেয়া দরকার?

মানবদেহে প্রয়োগ ছাড়া ভ্যাকসিনটি কতটা কার্যকর সেটি জানা কঠিন। ভাইরাসটির সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে মানবদেহে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা থাকা দরকার। এই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বলা হয় হার্ড ইমিউনিটি; যা সংক্রমিত ব্যক্তির শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভাইরাসটিকে দমন করে ফেলতে সক্ষম।

কিন্তু ভ্যাকসিনটি যদি কার্যকরী হয়; তাহলে বিশ্বের শত কোটি মানুষকে তা প্রয়োগ করতে হবে।

সব বয়সী মানুষকে রক্ষা করবে ভ্যাকসিন?

এটা স্বাভাবিকভাবেই অনিবার্য যে ভ্যাকসিনটি বয়স্কদের শরীরে খুব কম ফলপ্রসূ হবে। কারণ বয়স্কদের ইমিউন সিস্টেম টিকা দেয়ার পরও তেমন সাড়া দেয় না। যা মৌসুমি ফ্লু ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে দেখা যায়।

একাধিক ডোজ অথবা অন্য কোনও রাসায়নিকের মাধ্যমে ভাইরাসটিকে প্রতিরোধ ব্যবস্থা সক্রিয় করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।

কারা পাবে ভ্যাকসিন?

একটি ভ্যাকসিন যদি তৈরি হয়ে যায়, তাহলে এর সরবরাহ হবে খুবই সীমিত। প্রাথমিকভাবে ভ্যাকসিনটি গুরুত্বের ভিত্তিতে সরবরাহ করা হবে।

তবে সবার আগে এই ভ্যাকসিনটি পাবেন কোভিড-১৯ রোগীর সরাসরি সংস্পর্শে আসা স্বাস্থ্যকর্মীরা। যদি কার্যকরী হয় তারপরই পাবেন বয়স্করা। কারণ তাদের জন্যই বেশি প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে এই ভাইরাস।

কিন্তু ভ্যাকসিন আসলে বয়স্কদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বাড়াবে কিনা সেটি নিয়ে রয়েছে নিশ্চিত সংশয়। এরপরই পাবেন বয়স্কদের সংস্পর্শে আসা লোকজন।