আন্তর্জাতিক ডেস্ক :

দীর্ঘ দেড় যুগেরও বেশি সময় পর ঐতিহাসিক চুক্তির মাধ্যমে আফগান সশস্ত্র গোষ্ঠী তালেবানের সঙ্গে যুদ্ধের সমাপ্তি টেনেছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন প্রেসিডেন্টে ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছেন, নিজেদের সেনা সদস্যদের দেশে ফিরিয়ে আনার ইচ্ছা থেকেই এই চুক্তি করেছেন তারা। তবে সেই ইচ্ছা জাগ্রত হতে সময় লেগে গেছে ১৮ বছরেরও বেশি। এতদিন যুদ্ধ পরিচালনা, সেনা প্রশিক্ষণ, অবকাঠোমো নির্মাণসহ বিভিন্ন খাতে হাজার কোটি ডলার গচ্চা গেছে যুক্তরাষ্ট্রের।

২০০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত আফগানিস্তানে কী পরিমাণ ব্যয় করেছে যুক্তরাষ্ট্র তা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি। চলুন দেখে নেয়া যাক-

কী বাহিনী পাঠিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র?
তালেবানদের উৎখাত করতে ২০০১ সালের অক্টোবরে আফগানিস্তানে অভিযান শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। তাদের দাবি ছিল, টুইন টাওয়ারে হামলায় জড়িত ওসামা বিন লাদেনসহ অন্যান্য আল-কায়েদা নেতাদের লালন করেছে তালেবান। এ অভিযানে তালেবানদের অভ্যুত্থান ঠেকানো এবং তহবিল পুনর্গঠনের জন্য হাজার কোটি ডলার ব্যয় করে পেন্টাগন।

যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি হিসাবমতে, ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে আফগানিস্তানে অন্তত এক লাখ মার্কিন সেনা ছিল, যাদের পেছনে ব্যয় হয়েছে ১০০ বিলিয়ন ডলার। পরে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক অভিযানে নিজেদের সেনা পাঠানোর বদলে আফগান বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করলে ব্যয় বেশ কমে আসে। ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালে তাদের বার্ষিক ব্যয় ছিল ৪০ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হিসাব থেকে জানা যায়, এ বছর ব্যয় হয়েছে ৩৮ বিলিয়ন ডলার।

US-1

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের হিসাবমতে, ২০০১ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আফগানিস্তানে মার্কিন প্রশাসনের সামরিক ব্যয় হয়েছে ৭৭৮ বিলিয়ন ডলার। এর সঙ্গে মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগ যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডি এবং অন্য সরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে আরও ৪৪ বিলিয়ন ডলার পুনর্নির্মাণ প্রকল্পে ব্যয় করেছে।

সব মিলিয়ে ২০০১ সালে আফগান যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ৮২২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে আফগানিস্তানে সামরিক অভিযানের ঘাঁটি হিসেবে পাকিস্তানকে ব্যবহার করলেও সেখানকার ব্যয় ধরা হয়নি এই হিসাবে।

ব্রাউন ইউনিভার্সিটির যুদ্ধ প্রকল্পের ব্যয় বা কস্ট অব ওয়্যার প্রজেক্ট নামে এক গবেষণায় দাবি করা হয়, আফগান যুদ্ধে ব্যয়ের যে সরকারি হিসাব দেখানো হয়েছে তা প্রকৃত ব্যয়ের চেয়ে অনেক কম। আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের জন্য মার্কিন কংগ্রেস এক ট্রিলিয়ন ডলারের তহবিল অনুমোদন করেছিল।

ওই প্রকল্পের সহ-পরিচালক নেটা ক্রফোর্ড বলেন, এই ব্যয়ের মধ্যে যুদ্ধফেরত সেনাদের জন্য ব্যয়, যুদ্ধ সম্পর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য সরকারের বিভিন্ন বিভাগের ব্যয় এবং সংঘর্ষে অর্থায়নের জন্য নেয়া ঋণের সুদ অন্তর্ভুক্ত হয়নি। এসব যোগ করা হলে মোট ব্যয় দুই ট্রিলিয়ন ডলারে গিয়ে দাঁড়াবে।

কোথায় ব্যয় হয়েছে এই অর্থ?
বিবিসি বলছে, যুক্তরাষ্ট্র বেশিরভাগ অর্থ ব্যয় করেছে জঙ্গিবিরোধী অভিযান এবং মার্কিন সেনাদের জন্য খাদ্য, পোশাক, চিকিৎসা, বিশেষ ভাতা জাতীয় খাতে।

US-2

সরকারি তথ্যমতে, গত ১৭ বছরে আফগানিস্তানে যে অর্থ ব্যয় করা হয়েছে তার ১৬ শতাংশ বা প্রায় ১৩৭ বিলিয়ন ডলারই ব্যয় হয়েছে পুনর্নির্মাণ কাজে। এর আবার অর্ধেক ব্যয় হয়েছে আফগান বাহিনী পুনর্গঠনে। বাকি অর্থ গেছে শাসন ও অবকাঠামো বিনির্মাণ, অর্থনৈতিক ও মানবিক সহায়তা এবং মাদকবিরোধী কার্যক্রমে।

তবে এসব ব্যয় সুষ্ঠুভাবে করা হয়নি বলে দাবি প্রকল্প পর্যবেক্ষণকারী মার্কিন সংস্থাগুলোর। ২০১৭ সালে তারা জানায়, গত ১১ বছরে ১৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার নষ্ট হয়েছে অপচয়, জালিয়াতি ও অপব্যবহারের কারণে। তাদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ প্রায় সবখানেই সংঘাত বাড়িয়েছে, দুর্নীতির জন্ম দিয়েছে এবং জঙ্গিবাদে সমর্থন জুগিয়েছে।

প্রাণহানি কত?
২০০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত আফগানিস্তান যুদ্ধে অন্তত ২ হাজার ৩০০ মার্কিন সেনা নিহত হয়েছেন, আহত অন্তত ২০ হাজার ৬৬০ জন।

যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি হিসাব মতে, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর নাগাদ আফগানিস্তানে প্রায় ১৩ হাজার মার্কিন সেনা ছিল। এছাড়া অন্তত ১১ হাজার মার্কিন নাগরিক আফগানিস্তানে ঠিকাদারির কাজ করেছেন।

US-3

তবে তালেবানবিরোধী লড়াইয়ে আফগান বাহিনী ও বেসামরিক নাগরিকদের নিহত হওয়ার তুলনায় মার্কিন সেনা নিহত হওয়ার সংখ্যা যথেষ্ট কম। গত বছর আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি জানিয়েছিলেন, ২০১৪ সালের পর থেকে আফগান বাহিনীর ৪৫ হাজারের বেশি সদস্য নিহত হয়েছেন।

সংবাদমাধ্যমের দাবি, গত কয়েক বছরে আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য নিহত হওয়ার সংখ্যা বেড়েছে। লড়াইয়ে প্রতিদিন গড়ে ৩০ থেকে ৪০ জন আফগান সেনা নিহত হন বলে জানানো হয়েছে।

জাতিসংঘের সংস্থা ইউনাইটেড নেশন অ্যাসিসটেন্স মিশন ইন আফগানিস্তান জানিয়েছে, ২০০৯ সালে তারা হিসাব শুরু করার পর এ পর্যন্ত আফগানিস্তানে এক লাখেরও বেশি বেসামরিক নাগরিক হতাহত হয়েছেন।