অধ্যাপক রায়হান উদ্দিন:
হযরত শেখ শাদী রা: হাতেমতাইর সম্বন্ধে বলেছেন যে, হাতেমতাইর যত ঘোড়া ছিল তার মধ্যে একটি ঘোড়া খুব দ্রুতগামী ছিল , পাহাড় পর্বত বন জঙ্গল দিয়া একই রকম বিদ্যুৎবেগে চলতে পারত।এই ঘোড়াটি হযরত আলী (রা:) ও দুলদুল ঘোড়ার ন্যায় বিজলী গতিতে শত্রু সেনার মধ্যে বজ্রের ন্যায় পতিত হতো। মোট কথা সে কালে সকলের নিকট ঘোড়াটি অদ্বিতীয় বলে প্রসিদ্ধ ছিল। সেই যুগে হাতেমতাইর

সম্মান অধিক ছিল। তাঁর ন্যায় দানশীল সে যুগে কেউ ছিলেন না। একদিন কয়েকজন বিদ্ধান লোক রোমের বাদশাহর দরবারে বসিয়া হাতেমতাইর খুব উচ্চ প্রসংশা করেন।বাদশাহ তা শুনে উজিরের নিকট বলেন,“ বিনা প্রমাণে কোন দাবীর কথা উলেখ করে লজ্জা দেওয়া উচিত নয়। আমি হাতেমতাইর নিকট আসল তেজী ঘোড়াটি চাহিব। যদি তিনি উহা দান করেন, তবে তাঁকে অদ্বিতীয় দানশীল মনে করবো।” একজন জ্ঞানী দূতের সাথে দশজন লোক সহ হাতেমতাইর নিকট পাঠালেন। খুব ঝড় তুফানের মধ্যেও তাঁরা অতি কস্টে হাতেমতাইর বাড়ীতে রাত্রে গিয়ে উপস্থিত হলেন।হাতেমতাই অতিথির জন্য উট জবাই করে খানা তৈরী করে অতিথিদের থেতে দিলেন। অতিথিরা খুব আরাম পেলো যেমন তৃষার্থ লোক কুপের নিকট গিয়ে আরামপায়।তৃপ্তি সহকারে খাওয়ার পর রাতে সবাই আরামে শুড়ে পড়লেন। সকালে উঠিয়া দূত যে কাজের জন্য গিয়েছিল তা হাতেমের কাছে খুলে বললো।হাতেমতাই তা শুনে দু:খে মুখে আঙ্গুল কেটে বললেন, “আপনি এসে প্রথমেই উহা বলেন নাই কেন? আমি তো সেই উট জবাই করে রাত্রে আপনাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করেছি। আমি সেই বাদল তুফানে উঠের মাঠে যাওয়া অসম্ভব ভেবে ঘরে সেই উটটি ছিল তা আপনাদের জন্য জবাই করে খাওয়ার ব্যাবস্থা করেছি। আমি আমার মেহমানদারী রক্ষাকরেছি। যদিও সেইরকম উট আমি আর মিলাইতে পারবোনা। আমার নামে কোন কালিমা না আসতে পারে , সেই জন্য মেহমানদারীতে আমি ত্রুটি করতে পারিনা।হাতেম তার পর মেহমানদের হাদিয়া তোহফা,টাকা কড়ি দিয়ে বিদায় করলেন। রোম দেশে যখন একথা প্রচার হয়ে গেলো , লোকে তাঁর প্রশংসা করলো। হাতেমতাই সম্পর্কে শুধু এই ঘটনা নয় আরো আশ্চর্যজনক দানের ঘটনা রয়েছে। হযরত শেখ সাদী রা: বলেন “আমার সঠিক মনে নাই, ইয়ামন দেশে একজন বাদশাহ ছিলেন:তিনি খুব দানশীল ছিলেন। অকাতরে গরীব দু:খীদের দান করতেন।তাঁর সম্মুখে কেহ হাতেমতাইর নাম নিতে পারতো না। তিনি খুব রাগান্বিত হতেন।একদিন তিনি শাহী মহলে ভোজের বন্দোবস্ত করেন। সেখানে তিনি সবাইকে খুব যত্ন করে খাওয়ালেন। প্রত্যেকে খুব আনন্দিত হলো।সভা মধ্যে একজন হাতেমতাইর সুখ্যাতি বর্ননা করতে লাগলো।অন্যান্য সকলেও হাতেমের তারিফ করতে লাগলো।বাদশাহ শুনে হিংসায় জ্বলে উঠলেন। তিনি হাতেমের হত্যার জন্য একজন লোক নিযুক্ত করে দিলেন।কারন , তিনি মনে মনে ভেবেছিলেন হাতেম জীবিত থাকলে , তাঁর সুনাম হবেনা। ঐ ব্যক্তি হাতেমকে হত্যার জন্য রওয়ান হয়ে গেলো হাতেমতাইর বাড়ীর নিকট গিয়ে এক ব্যক্তির সাথে দেখা হলো। সে তাহাকে অভ্যর্থনা করলো। মনে হলো যেন তারসাথে অনেক আগে থেকেই পরিচয় তার। রাত্রে তার বাড়ীতে খাওয়া দাওয়া করে শুয়ে পড়লেন। বাড়ীর কর্তা তাকে অনেক আদর যত্ন করলো। খুবভোরে উঠে মেহমানের হাত চুম্বন করে বললো, আপনি আমার এখানে আরো কয়েকদিন থেকে যান। সে বললো ‘‘ এখন আর থাকতে পারবো না। আমার একটা গুরুতর কাজ আছে। বাড়ীর মালীক বললো , যদি উহা আমার নিকট প্রকাশ করে বলেন,তবে আপনার কাজে আমি সাহায্য করতে পারি। সে বলিল , দেখুন বীর পুরুষরা অনেক সময়ই লোকের গুপ্ত কথা লুকাইয়া রাখে।তাই আপনার কাছে বলছি এই এলাকায় হাতেমতাইকে আপনি নিশ্চই চিনিয়া থাকিবেন।তিনি অত্যান্ত সম্ব্রান্ত এবং দানশীল লোক।তাঁহার মাথা ইয়ামেনের বাদশাহ চাহিয়াছেন। আমি জানিনা তাঁদের মধ্যে কি শত্রুতা আছে।আমি আশা করি , আপনি দয়া করে আমাকে তাহার বাড়ী পর্যন্ত পথ দেখায়ে দিবেন এবং তাঁকে চিনিয়ে দিবেন।তখন বাড়ীর মালিক হেসে বললেন “ হাতেমতাই তো আমিই।এই নাও আমার মাথা মজুদ আছে: দ্বিখন্ডিত করে নিয়ে যাও। তাড়াতাড়ি মাথা দ্বিখন্ডিত করে নিয়ে যাও। সকাল গড়ালে লোকে জানতে পারবে, তখন তোমার ক্ষতি হবে, অন্ধকার থাকতেই তোমার কাজ শেষ করে নাও।যখন হাতেমতাই নিশ্চিন্তায় মাথা নত করে দিল,তখন ঐ ব্যক্তি চিৎকার করে উঠলো। মাঠিতে পড়ে গিয়ে আবার উঠলো এবংহাতেমতাইর হাত ধরে চুম্বন করতে লাগলো। তরবারী দুরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে মাঠিতে বসে হাতজোড় করে অনুগত ভৃত্যের ন্যায় বলতে লাগলো, যদি আপনার শরীরে একটি ফুলও নিক্ষেপ করি, তবে আমি পুরুষ নই।এই বলে হাতেমতাইর নয়নযুগল চুম্বন করে আলিঙ্গন করলো। তারপর ঐ লোকটি হাতেমতাইর নিকট ক্ষমা চেয়ে ইয়েমেনে চলে গেলেন । এদিকে যখন ইয়েমেনে গিয়ে লোকটি উপস্থিত হলো , বাদশাহ তখন বুঝতে পারলেন যে, সে কাজ সম্পন্ন করতে পারেনাই।তাহাকে বলিলেন, “তোমার খবর কি?কাজ সম্পন্ন করতে পারলে না কেন? বোধ হয় তোমার উপর অন্য কেহ আক্রমন করেছে। দুর্ভাগ্যবশত: তুমি যুদ্ধ করতে সাহস কর নাই। চতুর লোকটি কুর্নিশ করে বাদশাহকে বললো,“ হে দানশীল বাদশাহ , দয়া করে হাতেমের কথা শুনুন।আমি তাহার নাম ঠিকানা পাইয়াছি এবং তাহাকেও পাইয়াছি। তিনি দেখতে অনেক সুন্দর, উত্তম চরিত্রবিশিষ্ঠ এবং জ্ঞানী। তাঁহার জ্ঞান ও বীরত্ব দেখে আমি অবাক হয়েছি। তাঁর দয়ায় আমি দুর্বল হয়ে পড়েছি। তাঁর মহত্বের তরবারী আমাকে আঘাত করে মেরে ফেলেছে। তারপর লোকটি হাতেমতাইর দান দয়া সম্মন্ধে যা যা দেখেছে তা বর্ননা করলো। বাদশাহ তাহার মুখে হাতেমের প্রশংসার কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। সহস্র স্বর্নমুদ্রা দিয়ে লোকটিকে পুরস্কৃত করলেন।