আলমগীর মানিক,রাঙামাটি:
স্বাধীনতা পরবর্তী ৫০ বছরেও জিম্মি দশা কাটেনি রাঙামাটির যাত্রী সমাজের। ক্ষমতা ও পেশী শক্তির জোরে চট্টগ্রাম-রাউজান ও রাঙামাটির একটি মাস্তান সিন্ডিকেট বাস মালিক সমিতির নামে বছরের পর বছর তাদের অবৈধ কার্যক্রম চালিয়ে গেলেও টাকা ও পেশী শক্তির কাছে বিক্রি হয়ে যাওয়া প্রশাসনযন্ত্র তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করছেনা। উন্নত সামাজিক প্রেক্ষাপটে সারাদেশে বিলাসবহুল ভ্রমনের নানামুখি ব্যবস্থা থাকলেও পর্যটন শহর রাঙামাটিতে আসা পর্যটক এবং এই এলাকার সাধারণ যাত্রীদের এখনো মান্ধাত্তা আমলের যাত্রীসেবা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। ১৯৫২ সালে প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম-রাঙামাটি মোটর মালিক সমিতির ২৫৬টি বাস রয়েছে কাগজে পত্রে। তার মধ্যে রাঙামাটি থেকে চট্টগ্রামগামী চলাচলকারি বাসগুলোর মধ্যে অন্তত শতাধিক বাসের কোনো ধরনের রুট পারমিট নেই বলে নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে। এসব দেখভালে থাকা প্রশাসনিক যন্ত্রগুলো নীরব দর্শকের ভূমিকায় রয়েছে। রাঙামাটি থেকে চট্টগ্রাম, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি রুটে চলাচলকারি যাত্রীদের মাধ্যমে চলছে মোটর মালিক সমিতির প্রায় ২৫৬টি বাস। যাত্রী সাধারনের দাবি বাস্তবায়নসহ পরিবহন সেক্টরের উন্নয়ন ও অসঙ্গতি নিয়ে প্রতিমাসে বিআরটিএ কর্তৃক আরটিএ মিটিং করার কথা থাকলেও রহস্যজনক কারনে রাঙামাটিতে এই বৈঠক হয় বছরে দু’একবার।
এদিকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সেবা দেওয়া বিলাসবহুল বাসগুলোর মালিকপক্ষ রাঙামাটি রুটে বাস চালানোর সরকারী অনুমোদন পেলেও চট্টগ্রাম-রাঙামাটি মালিক সমিতির বাধার মুখে চালু করতে পারছেনা। এরআগে রাঙামাটি রুটে বিলাশ বহুল কয়েকটি বাসের মালিকদের কাছ থেকে সদস্য ফি’র নামে নেওয়া হয়েছে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা করে। রাঙামাটি থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া এসি ও ননএসি গাড়িগুলো থেকে সংগঠনের রাউজান কার্যালয়ের সামনেই প্রতিদিন প্রতিটি যাত্রীবাহি বাস থেকে আদায় করা হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৫১০ টাকা। তারমধ্যে মালিক সমিতি ৩৫০, শ্রমিক ফেডারেশন-১০ ও শ্রমিক ইউনিয়নের নামে নেওয়া হচ্ছে ১৫০ টাকা। এছাড়াও এই রুটে চলাচলকারি পাহাড়িকা বাসগুলো থেকেও নির্দিষ্ট্য সময়ে গন্তব্যে না পৌছুনোর অজুহাতে মিনিট হিসেব করেই জরিমানা নেওয়া হয় ১০ থেকে ২০টাকা হারে।
বানিজ্য মন্ত্রণালয়ের শর্তানুসারে যাত্রী পরিবহনে জেলা ভিত্তিক রেজিষ্টেশন “টিও” নাম্বার না থাকলেও শ্রমিক ইউনিয়নের জন্য প্রাপ্ত রেজিষ্টেশন নাম্বার-১৩৩ এর মাধ্যমে চট্টগ্রাম-রাঙামাটি মোটর মালিক সমিতির নামে রাঙামাটির রুট থেকে বছরে আদায় করা হচ্ছে কোটি টাকার চাঁদা। এই সংগঠনের নামে শতকোটি টাকার সম্পদ থেকে ভাড়াসহ বিভিন্ন খাত থেকে নিয়মিতই আদায় করা টাকার সিকি ভাগও রাঙামাটির যাত্রী এবং মালিক-শ্রমিকদের কল্যাণে ব্যয় করা হচ্ছেনা বলেও অভিযোগ উঠেছে। আদায়কৃত চাঁদার টাকার সুনির্দিষ্ট্য হিসেব নেই কারো কাছেই।
এদিকে, রাঙামাটি থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত প্রায় ৬৯ কিলোমিটার সড়ক। কিলোমিটার প্রতি সরকারী হিসেবে রাঙামাটি হতে ছেড়ে যাওয়া বাসগুলো মুরাদপুর পর্যন্ত ভাড়া হওয়ার কথা সর্বোচ্চ ৯০ টাকা। কিন্তু ১২০ টাকা ভাড়া নিয়ে যাত্রীদের নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে চট্টগ্রামের অক্সিজেন পর্যন্ত। এই ক্ষেত্রে একজন যাত্রী অক্সিজেন থেকে নিউ মাকের্টে অটোরিক্সায় যেতে আরো খরছ করতে হয় অন্তত ২শ টাকা।
জানাগেছে, এই রুটটিতে চলাচলকারি বাসগুলোর এক তৃতীয়াংশই হচ্ছে সমতলে চলা হানিফ-এস আলম কোম্পানীর মেয়াদোত্তীর্ণ বাসগুলো। মালিক সমিতির এক শ্রেণীর অসাধু নেতার মাধ্যমে কোম্পানীগুলোর কাছ থেকে মাত্র কয়েক লাখ টাকায় এসব লক্কর-ঝক্কর বাস কিনে এনে নতুনভাবে রং করে ৪২ সিটের বাস বানিয়ে পাহাড়িকা নাম দিয়ে চালানো হচ্ছে। মেয়াদোত্তীর্ণ এসকল বাসের একটিরও রাঙামাটির রুট পারমিট নেই। তারপরও প্রশাসন এসব বাসের বিরুদ্ধে রহস্যজনকভাবে নীরব ভূমিকা পালন করছে। এতো কিছুর পরও রাঙামাটির যাত্রীরা বিগত কয়েক দশকে রাঙামাটি বিআরটিএ অফিসের কোনো অভিযান এসব বাসের বিরুদ্ধে দেখেনি। বিষয়টি নিয়ে বিআরটিসি কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চাইলে তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। তবে বিষয়টি স্বীকার করে সংগঠনের সভাপতি মোঃ ছৈয়দ আহাম্মদ বলেছেন, আমরা ৬০/৭০ লাখ টাকা ব্যয়ে নতুন গাড়ি কিভাবে দিবো। মাসে ২৪টা সার্ভিস দিয়ে আমাদের এই টাকা তুলবো কিভাবে?।
এদিকে, রাঙামাটি শহরে বিপুল অংকের টাকা ব্যয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের অর্থায়নে একটি বাস টার্মিনাল নির্মাণ করে দেওয়া হলেও বাসগুলো সেখানে অবস্থান করেনা। বর্তমানে টার্মিনালটি মাদকসেবীদের নিরাপদ আড্ডাস্থলে পরিণত হয়েছে। এছাড়াও রাঙামাটির যাত্রীদের জন্য শহরের দোয়েল চত্বরে বিশাল একটি জায়গা বরাদ্ধ দেওয়া হয় কয়েক দশক আগে। এই স্থানটিতে মার্কেট নির্মাণ করে সেগুলো ভাড়া দিয়ে টাকা পকেটেও পুড়লেও টার্মিনালের কোনো ব্যবস্থাই সেখানে নেই। যাত্রীসেবার জন্য জায়গা নিয়ে চালানো হচ্ছে ব্যবসা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন বাস মালিক জানিয়েছেন, গত ৮ থেকে ১০ বছর যাবৎ চট্টগ্রাম-রাঙামাটি মোটর মালিক সমিতির কোন নির্বাচনও দেওয়া হয়নি।
এদিকে রাঙামাটি চট্টগ্রাম মোটর মালিক সমিতির সভাপতি মোঃ ছৈয়দ আহাম্মদ জানিয়েছেন, আমরা সমিতির সদস্য অর্ন্তভূক্তির জন্য বাহিরের বাসগুলো থেকে একটি নির্দিষ্ট্য পরিমান অর্থ নিই এটা ঠিক। সমিতির জায়গার ভেল্যুয়েশন ধরেই চার লাখ টাকা করে নেওয়া হয়েছে। সরকারী নির্দেশনা ব্যতিত এই টাকা কিভাবে নেওয়া হচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি কোনো উত্তর দেননি। তিনি জানান, চট্টগ্রাম-রাঙামাটি মোটর মালিক সমিতি মূলত চট্টগ্রাম জেলার অধীনে। তিনি বলেন, রাঙামাটি থেকে চট্টগ্রামের অক্সিজেনে যাওয়ার পাহাড়িকা বাসে জনপ্রতি ১২০টা যে ভাড়া নেওয়া হচ্ছে সেটি প্রশাসনের সাথে সমঝোতা করেই নেওয়া হচ্ছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম রাঙামাটি কার্যকারী সভাপতি মঈন উদ্দীন সেলিম জানান, অবৈধ দখলদার ও অবাধে মাদক ব্যবহার করার কারণে বাস রাখার পরিবেশ নাই। প্রশাসন বাস টার্মিনালে সুষ্টপরিবেশ সৃষ্টি করলে আমরা অবশ্যই যাব। সমিতির উদ্বর্তন নেতৃবৃন্দ যাত্রী সেবা ও টাকা নেওয়ার জবাব দিতে পারবে বলেও তিনি জানিয়েছেন।
উপরোক্ত বিষয়াবলী নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে রাঙামাটির জেলা প্রশাসক একেএম মামুনুর রশিদ বলেছেন, সংশ্লিষ্ট্য কেউই আমাদেরকে জানায়নি আর আমরা কাউকে কোনো অপকর্মের অনুমতিও দেইনি। এসব বিষয়ে সুনির্দিষ্ট্য অভিযোগ কেউ দিলে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবো।
অনুসন্ধানে জানাগেছে, এক সময়ে রাঙামাটি রুটে বাসের চালক থাকা ব্যক্তিরাই সংসদ সদস্যের আর্শিবাদে এখন চট্টগ্রাম-রাঙামাটি মোটর মালিক সমিতির নিয়ন্ত্রক হিসেবে রয়েছে। মাত্র এক দশক সময়ের ব্যবধানেই এরা এখন ব্যক্তিগত কয়েকটি ইটভাটা থেকে শুরু করে ৩/৪টি বাসের মালিকও বনে গেছেন। তাদের রয়েছে আলিশান বাড়ি ও গাড়ি। চাঁদাবাজির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আদায় করে কোটিপতি বনে যাওয়া মালিক সমিতির এসব নেতার আসল আয়ের উৎস্য খোঁজার দাবিও তুলেছে সাধারণ বাস মালিক ও শ্রমিকরা। একজন সংসদ সদস্যের আর্শিবাদে তার নাম ব্যবহার করে যাত্রীসেবার নামে যাচ্ছেতাই সেবা দিলেও এই সিন্ডিকেট চক্রের বিরুদ্ধে কথা বলেনা কেউই। রাউজানের এমপির নাম বিক্রি করে চলা এই বাস মালিক সিন্ডিকেটের নিকট জিম্মি হয়ে আছে প্রায় ছয় লাখ রাঙামাটিবাসী।