সাউথ এশিয়ান মনিটর:
ট্রাম্পের নির্দেশে পরিচালিত ড্রোন হামলায় ইরানের পারসদারান (রেভ্যুলশনারি গার্ডস) প্রধান মেজর জেনারেল কাসেম সোলাইমানি নিহত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সঙ্ঘাত ত্বরান্বিত হওয়ায় ভারতীয়রা ব্যাপকভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল। কারণ মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ভারতে স্বার্থের জন্য বিপর্যকর বিষয়।

ভারত তার চাহিদার ৮৩ ভাগ তেল বিদেশ থেকে আমদানি করে এবং মার্কিন অবরোধের কারণে বন্ধ হওয়ার আগে পর্যন্ত ইরান ছিল ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম সরবরাহকারী।

ইরান বেপরোয়াভাবে ভারতের কাছে দিনে ৫ লাখ ব্যারেলের বেশি তেল বিক্রি করতে আশা করেছিল এবং এজন্য তারা প্রায় বিনামূল্যে পরিবহন ও বিক্রি বাড়ানোর জন্য ঋণের মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভীত হয়ে তা গ্রহণ করেননি।

অর্থাৎ মার্কিন ভীতির কারণে ভারত খুবই সস্তা ও সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তেলের উৎসটি গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব থেকে ভারতের তেল আমদানি বেড়েছে, তবে এতে ভারতকে অনেক বেশি দাম দিতে হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে তেলের দাম ভারতে ব্যাপকভাবে বেড়ে যাবে।

আর এতে যুক্তরাষ্ট্র (বর্তমানে তেল রফতানিকারক) ও সৌদি আরব লাভবান হলেও আমদানি ব্যয় ও মুদ্রাস্ফীতি মাত্রা বেড়ে গিয়ে (পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায়) ভারতের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে ফেলবে। ভারত সরকার অবশেষে জিডিপি প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা ২০২০-০১ সময়কালের জন্য হ্রাস করে করেছে ৫ ভাগ (২০১৯-২০ সময়কালে ছিল ৬.৮ ভাগ)। ম্যানুফেকচারিং, কৃষি ও এমনকি ভারতের বিশাল আইটি খাতে হতাশাজনক অবস্থার কারণে এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে সরকার।

এখন তেল আমদানির ব্যয় ব্যাপকভাবে বেড়ে গেলে তা অর্থনীতিকে বিচ্যুত করতে পারে। অর্থনীতিবিদেরা বলেন, ২০১৬ সালে মোদির নোট বাতিল করার ফলে ভারতের অর্থনীতি মন্থর হয়ে পড়তে থাকে। এখন তার ‘ভালো বন্ধু ট্রাম্প’ যদি ইরানের সাথে যুদ্ধ শুরু করেন, তবে তিনি মোদিকে ধরাশায়ী করে ফেলতে পারেন।

ভারতীয় চায়ের একক বৃহত্তম আমদানিকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে ইরান। ২০১৯ সালেই কিনেছে ৫০ মিলিয়ন কেজির বেশি। পরিমাণটি সিআইএস দেশগুলোর (রুশ ফেডারেশনসহ) চেয়ে বেশি। এটি ভারতের মোট চা রফতানির ১০ ভাগ। চা শিল্প হলো ভারতের খামারভিত্তিক বৃহত্তম বিনিয়োগকারী খাত। ইরানি বাজার হাতছাড়া হওয়া ভারতের জন্য খুবই খারাপ বিষয়, যেমনটা হয়েছিল ১৯৯০-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর।

ইরানের চাবাহার বন্দর উন্নয়নের সাথে ভারত ব্যাপকভাবে জড়িত। ভারতের কৌশলগত স্বার্থের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় সুবাদে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এ ব্যাপারে ছাড় পেয়েছিল দিল্লি।

ভারত-ইরান-আফগানিস্তান ত্রিমুখী সমঝোতার কারণে চাবাহার-হাজিজাগ করিডোরের জন্য ২১ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। এর মধ্যে ভারতের চাহাবার বন্দরের জন্য ৮৫ মিলিয়ন ডলারও রয়েছে। আর ইরানকে ঋণবাবদ দেয়ার কথা রয়েছে ১৫০ মিলিয়ন ডলার। চাবাহার বিশেষ অর্থনৈতিক জোনের জন্য ভারত-ইরান সমঝোতা স্মারকে ভারতের শিল্প বিনিয়োগের পরিমাণ হচ্ছে ৮ বিলিয়ন ডলার।

এছাড়া হাজিজাগ লোহা ও স্টিল খনি প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১১ বিলিয়ন ডলার। আর আফগানিস্তানের বিভিন্ন সহায়ক অবকাঠামো নির্মাণের জন্য ধার্য করা হয়েছে ২ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া ইউরোপ ও তুরস্ককে সংযুক্তকারী ৭,২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ মাল্টি মোড নর্থ-সাউথ ট্রান্সপোর্ট করিডোরের সম্ভাবনার কথাও বলা হয়েছে। তারপর আসে আর২৯৭ আমুর মহাসড়ক ও ট্রান্স-সাইবেরিয়ান হাইওয়ে, যা রাশিয়ায় যাওয়ার কথা। তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান ও কিরগিজস্থানে যাওয়ার সুবিধা-সংবলিত হেরাত থেকে মাজার-ই-শরিফ রেলওয়ের কথাও আলোচনায় রয়েছে।

চাবাহার বন্দরের ফলে তাজিকিস্তানে অবস্থিত ভারতের ফার্কহর বিমান ঘাঁটিতে সরাসরি যাওয়া যাবে। এর ফলে মধ্য এশিয়ায় যেতে জাহাজ খরচ ৬০ ভাগ হ্রাস পাবে। পাকিস্তানকে এড়িয়েই মধ্য এশিয়ার জ্বালানি ও খনিজসম্পদ এলাকায় প্রবেশের সম্ভাবনা ছিল ভারতের সামনে।

এখন যুক্তরাষ্ট্র-ইরান যুদ্ধের কারণে চাহাবার ও অন্যান্য প্রকল্পের কাজে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হবে।

ভারতের নিরাপত্তা পরিকল্পনাকারীরা আইএস/আল কায়েদা ধরনের ইসলামি উগ্রপন্থীদের বিরুদ্ধে রক্ষাপ্রাচীর মনে করে ইরানকে। দিল্লির অনেকে কাসেম সোলাইমানিকে হত্যা করায় উদ্বিগ্ন। কারণ এতে দায়েশের প্রত্যাবর্তনের আশঙ্কা বাড়ল। হিজবুল্লাহ ও হামাসের মতো ইরানি প্রক্সিগুলো হয়তো যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের ঘনিষ্ঠ আরব সরকারগুলোকে ভয় পায়, কিন্তু তারা ভারতকে নিয়ে চিন্তিত নয়।

সর্বোপরি ১৭ মিলিয়ন ভারতীয় মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত। যুদ্ধ মানে মানবিক সঙ্কট এবং তা সামাল দিতে তাদেরকে ভারতে ফিরে আসতে হবে।

ফলে ভারতীয় জনমতে ঐকমত্য রয়েছে যে ট্রাম্পকে সংযত রাখা প্রয়োজন এবং তার ইমপিচমেন্ট জনিত মনোযোগ সরিয়ে নেয়ার এই চেষ্টা থেকে বিরত থাকা উচিত। নিউ ইয়র্কে ইতোমধ্যেই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেইওর সাথে দুবার কথা বলেছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। তখন নিশ্চিতভাবেই উত্তেজনা ত্বরান্বিত হওয়া নিয়ে ভারতের উদ্বেগের বিষয়টি উত্থাপিত হয়েছে। আর মোদি কথা বলেছেন ট্রাম্পের সাথে।

সূত্রগুলো জানায়, মোদি ও জয়শঙ্করের উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ হলো এই যে ইরানের সাথে যুদ্ধ শুরু হলে ভারতীয় সামরিক ঘাঁটিগুলো মার্কিন বাহিনীর ব্যবহারের ইস্যুটি ইতোমধ্যেই উত্থাপন করেছেন। ওয়াশিংটনে ২+২ সংলাপে পম্পেইও ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্ক এস্পার বিষয়টি উত্থাপন করেছিলেন। তবে তাতে ভারত আপত্তি জানায়।

দিল্লির এলিট সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের প্রসেফর এমিরেটাস ভারত কারনাড তার কলামে লিখেছেন, যুদ্ধের সময় ভারতের বিমান ও সেনা ঘাঁটিগুলো ব্যবহার করতে আগ্রহী হবে যুক্তরাষ্ট্র।

মোদির মতো ট্রাম্পও নজর সরিয়ে নেয়ার রাজনীতিতে দক্ষ। ফলে একে অপরকে ভালোমতোই বোঝেন। ইমপিচমেন্ট প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় ও মার্কিন নির্বাচন এগিয়ে আসায় ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে মোদির মতো জয় নিশ্চিত করার জন্য বালাকোট ধরনের কিছু করার চেষ্টা করতে পারেন। ফলে তার পক্ষে সংযত হওয়ার পরামর্শ অগ্রাহ্য করাই স্বাভাবিক।

পাকিস্তানসহ ইসলামি এশিয়ার বেশির ভাগেরই ট্রাম্পের যুদ্ধ চেষ্টায় সমর্থন না দেয়ার সম্ভাবনা বেশি। ইরানের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানতে পশ্চিমে তুরস্ক ও পূর্বে ভারতের সমর্থন পাওয়ার আশা করতে পারে ভারত।

কিন্তু তুর্কি লৌহমানক এরদোগন ২০১৪ সাল থেকেই ইরানের সাথে বিরোধ মিটিয়ে ফেলার কাজ করে আসছেন। রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কেনা নিয়ে বিবাদের জের ধরে আঙ্কারার পক্ষে তার দেশের ঘাঁটি যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যবহার করতে দেয়ার সম্ভাবনা কম। ফলে ভারতের ওপরই বেশি চাপ সৃষ্টি হবে। ট্রাম্পের সাথে ব্যক্তিগত উষ্ণ সম্পর্ক নিয়ে সবসময়ই গর্ব করেন মোদি, যদিও মোদিকে নিয়ে কৌতুক করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।

আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তথাকথিত বন্ধুত্ব ভারতের জন্য লাভজনক হয়েছে সামান্যই। আর ট্রাম্পের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে মোদি বেশি বেশি মার্কিন সামরিক সরঞ্জাম কেনা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্য চুক্তি করতে পারেনি ভারত।

ভারতের প্রযুক্তিবিদদের জন্য ভিসা বাড়ানোর আবেদনেও সাড়া দেননি ট্রাম্প, অথচ মার্কিন পণ্যের জন্য শুল্ক ছাড় দেয়ার জন্য চাপ দিয়ে আসছেন। ভারতে ৫জি পরীক্ষায় যোগ দিতে চীনের হুয়াওয়েকে আমন্ত্রণ জানানোর ইঙ্গিত দিয়েছে নয়া দিল্লি। তবে তা ভারতের কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন প্রদর্শনের জন্য পর্যাপ্ত নয়।

বেশির ভাগ ভারতীয় মনে করে, ভারতের উচিত স্বকীয়তা প্রদর্শন করা। তবে পুরনো আমলের লোকজন বলেন যে ভারত বেশির ভাগ সময়েই যুক্তরাষ্ট্রের মোকাবিলা করতে গিয়ে সাহস হারিয়ে ফেলে। ব্যতিক্রম ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী ও তার ছেলে রাজীব গান্ধী।

বাংলাদেশ সঙ্কটের সময় ১৯৭১ সালে নিক্সন-কিসিঞ্জারকে সামাল দিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। আর মার্কিন চাপ প্রত্যাখ্যান করে শ্রীলঙ্কায় সৈন্য পাঠিয়েছিলেন রাজীব গান্ধী। চেন্নাইয়ের কছে এলটিটিইর আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিহত হওয়ার দুদিন আগে আগরতলা বিমানবন্দরে রাজীব গান্ধীর একটি সংবাদ সম্মেলনের কথা মনে পড়ছে। তিনি তখন দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছিলেন যে বাংলাদেশে সাইক্লোন ত্রাণের জন্য মার্কিন সামরিক বাহিনী মোতায়েন ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ বিষয়।

ওই সময় রাজীব কংগ্রেসকে ক্ষমতায় ফেরানোর প্রয়াস চালাচ্ছিলেন। তার কথাগুলো এত বছর পরও আমার কানে বাজে: ‘সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ক্রমবর্ধমান হারে একক মেরুর হতে থাকা বিশ্বের জন্য একটি বিপর্যয়। আর ভারতের মতো আত্মমর্যাদাশীল দেশের জন্য পরিবর্তিত বাস্তবতার সাথে খাপ খাওয়ানো বেশি বেশি কঠিন হয়ে পড়ছে।’