মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :

একজন পুলিশের “আদর্শ প্রিয়তমা” হবার প্রথম শর্ত আপনাকে অপরিসীম ধৈর্যশীলা হতে হবে। “সহ্যের সীমারেখা” বলতে কোন কিছু নেই-এটাই হতে হবে পুলিশের একজন আদর্শ স্ত্রী’র জীবনদর্শন। যদি কোন পুলিশের সহধর্মিণী ধৈর্য ও সহ্যের সীমারেখা ধরে বসে থাকেন, তাহলে বিপদ আপনার ভ্যানিটি ব্যাগে সবসময় থেকেই যাবে। যেমন ধরুন- আপনি সারাদিন ভরে প্রিয় মানুষটাকে দারুনভাবে মিস করছেন। কিন্তু তিনি রাষ্ট্রের ডিউটির কারণে আপনাকে কোনভাবেই রেসপন্স করতে পারছেন না। দিনশেষে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে শরীরে ঘুম ঘুম চোখে আপনার সারাদিনের মিসিং এর রেসপন্স করল নামমাত্র অথবা একেবারে করলোই না। এক্ষেত্রে ধৈর্যশীলা না হলে আপনার চোখের জলে পদ্মার নীল পানি সাদা হয়ে যাবে, তবুও বেচারা আপনার পুলিশ স্বামীর কিছুই করার থাকবেনা। কারণ, “আগে রাষ্ট্রের ডিউটি, পরে প্রিয়তমা ও অন্যসব”

আপনাকে উদার এবং উদাস হতে হবে যদ্দূর পারেন। যদি আপনি উদার না হন, তবে আপনার পুলিশ প্রিয়তমকে জড়িয়ে যে স্বপ্নগুলো দেখবেন, তার বাস্তবায়ন না করতে পারলে অশান্তি শুরু হয়ে যাবে। যে অশান্তি স্থায়ী রূপও নিতে পারে। কল্পনা করার আগে, চিন্তা করার আগে আপনাকে ধরে নিতে হবে, “ওইদিনে ওর অবশ্যই ডিউটি থাকবে, আমাকে একাই যেতে হবে সে অনুষ্ঠানে অথবা অন্যকাজে”। আর উদাস হতে হবে, যাতে আপনার পুলিশ স্বামীর কর্মব্যস্ততার জন্য আপনার মন খারাপ হলে আকাশের দিকে থাকিয়ে, প্রকৃতির দিকে থাকিয়ে চীন, ফ্রান্স, জাপান, ইউকে, আমেরিকা সহ সব আধুনিক দেশ কল্পনার রাজ্যে উনার হাত ধরে ঘুড়ে বেড়াতে হবে। আর পারলে পর্যটন রাজধানী কক্সবাজারে বিশ্বের দীর্ঘতম বালুকাময় সমুদ্র সৈকতের ঘুরে বেড়াতে পারেন, সমুদ্রের বিশাল ঢেউর লোনাজলে নিজেদের ভিজিয়ে নিতে হবে কল্পনার সাগরে হাবুডুবু খেয়ে। সৈকতে হাঁটতে হাঁটতে নিতে পারেন, নির্মল হাওয়ার শ্বাসপ্রশ্বাস, দেখতে পারেন, সূর্যাস্থের অপরূপ লালাভ দৃশ্য।

আপনাকে অসীম সাহসী ও দেশপ্রেমী হতে হবে। তা না হলে, উনি যখন হন্তদন্ত হয়ে অনেকটা মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে কোন কঠিন অপারেশনে যেতে চাইবেন, তখন আপনি ভয়ে কুঁকড়াবেন, আবেগে কান্নাকাটি করবেন। ভেঙ্গে পড়বেন ওই সময়ে উনি আপনাকে সামলাবে, নাকি ওয়ারলেসের ডাকে সেই সাড়াশি অপারেশনে ছুটে যাবেন? বরং তখন অদম্য সাহসী ও দেশপ্রেমের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে শক্ত গলায় বলতে হবে, “বেখেয়ালি হইও না, সাবধানে সব সামলে নিও, ইনশাল্লাহ অপারেশন সাকসেস করে বিজয়ীর বেশে ফিরো”।

আপনাকে অল্পতে তুষ্ট হতে হবে। সব ব্যস্ততা ছাপিয়ে তিনি যে কিছু সময় বা ঘণ্টাখানেক সময় আপনাকে দেবেন, সে এক ঘন্টাকে পুরো একদিন ভেবে, বা এক সপ্তাহ ভেবে উৎফুল্ল চিত্তে প্রচুর আনন্দ উপভোগ করতে হবে। মনে করতে হবে, এটাই যেন সর্বোচ্চ বিনোদন।

স্বামী কেন্দ্রিক অসীম চাওয়া ও প্রত্যাশার বিপরীতে সীমিত ও ন্যূনতম পাওয়া নিয়ে হাপিত্তাস করা যাবেনা, কথায় কথায় রাগ দেখানো যাবেনা। আপনাকে মাথায় রাখতে হবে, আপনি একজন ব্যতিক্রমী পেশাধারী পুলিশের প্রিয়তমা। যিনি চাইলেও আবেগী হতে পারেননা, তিনি একজন আইনপ্রয়োগকারী, দেশের বৃহৎ শৃংখল বাহিনীর সদস্য। যিনি রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে, সহজে সময় বের করতে পারেন না। যেটা ওনার জন্য কঠিন ও দুরূহ কাজ। শুক্র, শনি, ঈদ, বিয়ে, শাদী, জন্মদিন, সামাজিক অনুষ্ঠান বলতে যার জীবনে খুব একটা নেই।

আপনাকে যৌক্তিক ও গ্রহনযোগ্য প্রতিবাদী হতে হবে। পুলিশের প্রিয়তমা হবার কারণে আপনাকে অনেকে টিপ্পনি কাটবে। পুলিশকে দেয়া গালি সমান তালে পুলিশের সহধর্মিণী হিসাবে আপনার কপালেও জুটবে। এক্ষেত্রে আপনাকে পুলিশের সততা, নিষ্ঠা, পেশাদারিত্ব, কল্যানকর কাজ ও মহান মুক্তিযুদ্ধ সহ যেকোন দুর্যোগ ও দেশের সংকটময় মুহূর্তে পুলিশের অনন্য ব্যাপক অবদানকে গোছালোভাবে তুলে ধরতে হবে তাদের সামনে অত্যন্ত ঠান্ডা মস্তিষ্কে। অন্যান্য পেশাতেও অসততার সুযোগ, তুলনামূলক ঝুঁকিহীনতা, কর্মস্থলে নেতিবাচক কর্মকান্ডের কথা আপনার মুখস্ত থাকতে হবে। যাতে টিপ্পনি কিংবা গালির বিনিময়ে কৌশলে এগুলো বর্ননা করে তাদের মুখটা ফ্যাঁকাসে করে দেয়া যায়। আপনার স্বামী ও পুলিশ বাহিনীকে ইতিবাচক ধারায় আনতে হবে। “যত দোষ নন্দ ঘোষ”-বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে এ গতানুগতিক অপবাদ ভুল প্রমাণ করতে হবে।

বাহিরে যেতে পাঁচ মিনিটের মধ্যে রেডি হবার দক্ষতা থাকতে হবে আপনাকে। কখন উনি বিনা নোটিশে ঘন্টা খানেক সময় বের করে আপনাকে নিয়ে কোথাও বের হতে চাইবে, তার হদিস কিন্তু ফোন পাওয়ার আগে মিলবেনা। তখন সাংসারিক ঝামেলা গোছাতে, সাজতেই যদি লাগান আধাঘণ্টা তবে ঘুরবেন কখন?

অভিমানী হতে পারবেন। তবে তা হতে হবে, একেবারে ক্ষনিকের জন্য। কারণ অভিমান ভাঙ্গানোর জন্য আপনার প্রিয়তম আপনাকে যথেষ্ট সময় দেবেন, এরকম চিন্তা মোটেও করা যাবেনা। ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে আপনার কাছে ওনি যখন আসবেন, আপনার স্বামীর তখন আর অভিমান ভাঙ্গানোর মানসিক অবস্থা থাকবেনা।

এরকম আরো অনেক বিষয় আছে, যে ক্ষেত্রে আপনাকে অন্যান্য নারীদের থেকে একটু বেশি এগিয়ে থাকতে হবে। বেশী ছাড় দিতে হবে ও ত্যাগ করতে হবে বেশী। তবে এতে এটা ভাবার কারণ নেই, পুলিশ বিয়ে করা মানে লাইফটা নষ্ট হয়ে যাওয়া। সমস্ত ব্যস্ততা ক্লান্তি মাথায় নিয়ে যখন মানুষটা আপনাকে বলবে, “মিস ইউ, লাভ ইউ”, পৃথিবীর সবচেয়ে সুখি প্রিয়তমা আপনি নিজেকে তখন ভাবতে বাধ্য।

পুলিশেরাও ভালোবাসে, শুধু সেই ভালোবাসা প্রকাশের জন্য কোন আয়োজন করতে পারেন না সময়ের অভাবে, আনুষ্ঠানিকতা করতে পারেন না দায়িত্বশীলতার কারণে। প্রিয়তমার প্রতি ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে তাদের ইউনিফর্মের ভাজে, অনুভূতি গুলো পুড়তে থাকে ঝলমলে রোদের আলোতে, আবেগগুলো ভিজতে থাকে ভালোবাসার বৃষ্টিতে। ভালোবাসে.. তারাও তাদের প্রিয়তমাকে ভালোবাসে। মুখে না থাকলেও অনুভূতিতে ঠিকই থাকে তার প্রিয়তমা, চোখের লেন্সে ঠিকই লেগেই থাকে তার প্রিয়তমার মুখ সবসময়। প্রকৃতপক্ষে ভালোবাসে… পুলিশও আসলে ভালোবাসে। আপনাকে শুধু মানুষটাকে বুঝার ক্ষমতা থাকতে হবে। আর পুলিশটাকে ছাড় দিতে হবে। স্থান দিতে হবে মনের মনিকোঠায়। তখনই এ প্রবাদ বাক্য সফল হবে “মাছের রাজা ইলিশ, জামাইর রাজা পুলিশ”।

লেখক : আইনজীবী বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, ঢাকা, বাংলাদেশ। কলামটি লেখকের একান্তই নিজস্ব মতামত।)