মুহাম্মদ হোসাইন

পৃথিবীর নৃতাত্তিক জাতিগোষ্ঠীদেরএকটি হলো রোহিঙ্গা যারা মায়ানমারের একটি মুসলিম সংখ্যালঘু জাতি হিসাবে সমধিক পরিচিত। রোহিঙ্গারা পশ্চিম মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের একটি রাষ্ট্রবিহীন ইন্দো-আর্য জনগোষ্ঠী। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তথ্যমতে, ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দের আইনে ‘রোহিঙ্গাদের জাতীয়তা অর্জনের সম্ভাবনা কার্যকরভাবে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। ৮ম শতাব্দী পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের ইতিহাসের সন্ধান পাওয়া সত্তেও, বার্মার আইন এই সংখ্যালঘু নৃতাত্তিক জনগোষ্ঠীকে তাদের জাতীয় নৃতাত্তি¡ক জনগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করছে। এছাড়া তাদের আন্দোলনের স্বাধীনতা, রাষ্ট্রীয় শিক্ষা এবং সরকারি চাকুরীর ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

নিপীড়িত এই রোহিঙ্গারা প্রজন্মে পর প্রজন্ম মায়ানমারে বসবাস করছে ঠিকই কিন্ত মায়ানমারের বৌদ্ধরা তাদেরকে বাংলাদেশি অবৈধ অভিবাসী গণ্য করে নানান সংঘাতের ইস্যু বানিয়েছে। মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী ও চরমপন্থী বৌদ্ধরা সম্মিলিতভাবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর বিভিন্ন সময়ে দমন পীড়ন অব্যাহত রাখায় রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ, শিশুরা বারবার তাদের হাতে নৃশংস নির্যাতনের শিকার হয়ে স্বদেশ ত্যাগে বাধ্য হয়েছেন।। মূলত ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দ থেকে রোহিঙ্গারা শরণার্থী হয়ে বাংলাদেশে আসতে শুরু করেন। রোহিঙ্গারা ১৯৭৮, ১৯৯১-১৯৯২,২০১২, ২০১৫ ও ২০১৬-২০১৭ খ্রিস্টাব্দে সামরিক নির্যাতন এবং দমনের সম্মুখীন হয়েছে।

তারা বাংলাদেশ মায়ানমারে সীমান্তের ৬৩ কিলোমিটারের নাফনদী পার হয়ে কক্সবাজার জেলার উখিয়া টেকনাফের নয়াপাড়া, কুতুপালং-বালুখালী,মরিচ্যার আশ্রয় শিবিরে থাকতেন। তবে ২০১৬ আর ২০১৭ খ্রিস্টাাব্দে রোহিঙ্গা শরণার্থী নতুন পুরাতন মিলে ১১ লাখে উন্নীত হলে তা আর নির্ধারিত এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকেনি ছড়িয়ে পড়ে কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলার পাহাড়ি বনজঙ্গলে। তারা সেখানে আশ্রয় নেন ত্রিপলের কুঁড়েঘর বানিয়ে। তারা সেখানে ছিলেন মাস-দুয়েক পরবর্তীসময়ে সরকার আরআরআরসির তত্ত¡াবধানে উখিয়া এবং টেকনাফে ৩৪টি ক্যাম্প স্থাপন করেন এবং সবাইকে সেখানে স্থানান্তর করা হয়। নিরাপত্তার খাতিরে সরকার প্রত্যেকটি ক্যাম্পে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে ক্যাম্পগুলো পরিচালনা করছেন। ২০১৭ খ্রিস্টাাব্দের ডিসেম্বর মাসের এক হিসাব অনুযায়ী ২৫ আগস্ট ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে মায়ানমারের সামরিক বাহিনীর দ্বারা শুরু হওয়া গণহত্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে ৭,০০, ০০০ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এছাড়া বিগত তিন দশক ধরে বিভিন্ন সময়ে আসা শরণার্থী শিবির গুলোতে ছিলো ৩,০০,০০০ রোহিঙ্গা।

এবারো রোহিঙ্গারা নির্যাতিত হয়ে আসলো বরাবরের ন্যায় উখিয়া-টেকনাফে সবুজ পাহাড়ে। তবে উখিয়া টেকনাফের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর তুলনায় এখন দ্বিগুন রোহিঙ্গা বসতি। খুব অল্প সময়ের মধ্যে ¯্রােতের মতো আসা রাহিঙ্গাদের চাপে কৃষি জমি, শ্রম বাজার ও শিক্ষাসহ এই অঞ্চলের মানুষজনের জীবনের নানা দিক ক্ষতিগ্রস্ত। রোহিঙ্গাদের দুঃখগাথা নিয়ে দেশবিদেশের গণমাধ্যমে অনেক তোলপাড় হয়েছে। তবে তারা যে জনপদটিতে আশ্রয় নিয়েছে, তার স্থানীয় অধিবাসীরা এসব বিপন্ন মানুষকে আশ্রয় দিতে গিয়ে নিজেরা কোথায় নেমেছে, তা কিন্তু তেমন আলোচিত হয়নি। আর যে টুকু বা হয়, তার বিহিত করার জন্য হয় না কোনো ব্যবস্থা। যা হয়েছে তাও উল্লেখযোগ্য নয়। ২০১৬ ও ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তীসময়ে যেসব রোহিঙ্গারা বাস্তচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে এতে কক্সবাজারের আর্থ-সামাজিক অবস্থার চরম বিপর্যয় ঘটে।

সর্বশেষ ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে ২৫ আগস্ট, ৭ লাখ রোহিঙ্গার আগমনে আমাদের দেখার আলোকে ব্যাপক সমস্যার উদ্ভব হয়েছে। এক সমীক্ষায় দেখা যায়, কক্সবাজার জেলার মানুষের ২০১৫/১৬ সালে যে দ্রব্যমূল্য তা বর্তমানে তিন থেকে পাঁচগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষকরে জনজীবনের মৌলিক চাহিদায় বিস্তর পরিবর্তন ঘটেছে যেমন, আবাসন, খাদ্যদ্রব্য, যোগাযোগ ব্যাবস্থা, পানির লিয়ার শূন্যতা, মাদকের সয়লাব, নানান অপরাধের সৃষ্টি, বনভূমির উজাড়, ক্ষেতফসলের সমস্যা, শিক্ষপ্রতিষ্ঠানের ফলাফল বিপর্যয়, ভাষাগত মিলের কারণে চেকপোস্টের হয়রানি, পরিবহন সমস্যা, রাস্তাঘাটের খানাখন্দ, দুর্ঘটনার মতোন প্রাণহানি, পর্যটন শিল্পসহ ইত্যাদি অনেকাংশে বেহাল পরিস্থিতি হয়েছে যা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর আগমণের কারণে সৃষ্টি। অন্যদিকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দাতাসংস্থার সরব কার্যক্রমে পাঁচ লাখ জনবলের লোকালয়ে নিত্য বিচরণে আগেকার তুলনায় নিত্যপণ্যের দাম অনেকগুন বৃদ্ধি পেয়েছে। সে হিসেবে রোহিঙ্গা সমস্যা ও সেবায় এটিও বড়কারে স্থানীয়দের ঘাড়ে বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে আমি স্থানীয় একজন ব্যক্তি হিসাবে ২০১৭ খ্রিস্টাাব্দের ২৫ আগস্ট পরবর্তী বাস্তচ্যুত হয়ে আসা রোহিঙ্গাদের দরুণ স্থানীয় জনগোষ্ঠীর যে মৌলিক চাহিদার আমূল পরিবর্তনে আর্থ-সামাজিক ব্যাবস্থায় মারাত্মক প্রভাব পড়েছে তারবেশ কিছু দিক আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি। অন্যদিকে সরকার ও দাতা সংস্থাদের সমন্বিত কার্যক্রমে নানান প্রজেক্টের প্রতিবেদনের কয়েকটি প্রতিবেদনও এনেছি।ব লতে গেলে স্থানীয় পর্যায়ে রোহিঙ্গা ¯্রেেত কেমন প্রভাব ও আর্থ-সামাজিক অবস্থানে কি রকম পরিবর্তন ও প্রভাব দেখা দিয়েছে তার মৌলিক দিক সমূহ প্রতিয়মান করা হয়েছে।

রোহিঙ্গা সমস্যা :

বর্মীরা ১৭৮৪ খ্রিস্টাাব্দে রাখাইন ও মুসলিম অধ্যুষিত আরাকান দখল করে, যা স্বাধীন ছিল। ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে বর্মীদের গ্রেপ্তার এড়াতে এবং আশ্রয়ের জন্য নিকটবর্তী চট্টগ্রামে চলে আসে। বার্মার শাসকরা আরাকানের হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে। ব্রিটশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলাকে আরাকান পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিল। আরাকানে হালকা বসতি এবং উর্বর উপত্যকায় কৃষিকাজের জন্য স্বদেশি হওয়ায় ব্রিটিশ রাজ বাঙালি অধিবাসীদের অভিবাসনের নীতি গ্রহণ করেছিল। ঊনবিংশ শতকে হাজার হাজার বাঙালি কাজের সন্ধানে চট্টগ্রাম থেকে আরাকানে গিয়ে বসবাস শুরু করে। আবার হাজার হাজার রাখাইন আরাকান থেকে বাংলায় চলে আসে। এরই মধ্যে রোহিঙ্গা মুসলিম ও আরাকানের বৌদ্ধদের মধ্যে শত্রুতার সৃষ্টি হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানিরা বার্মা আক্রমণ করে এবং ব্রিটিশরা পরাজিত হয়ে চলে যায়। রোহিঙ্গারা মিত্র শক্তিকে সমর্থন করায় জাপানি সৈন্যরা হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা, নির্যাতন ও ধর্ষণ করেছিল। একইভাবে জাপানি ও বর্মীদের দ্বারা বারবার গণহত্যার শিকার হয়। তখন ২২ হাজার রোহিঙ্গা স্থায়ীভাবে চট্টগ্রামে এসে বসতি স্থাপন করে। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারত বিভাগের সময় রোহিঙ্গারা পাকিস্তানের গর্ভনর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সঙ্গে বৈঠক করে পাকিস্তানের সঙ্গে থাকার ইচ্ছা ব্যক্ত করে। ফলে তাদের কপালে বার্মা কর্তৃক ‘বেঈমান’ তকমা লেগে যায়। তারপর রোহিঙ্গারা আরাকানকে স্বাধীন করার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে জেনারেল নে উইনের নেতৃত্বে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করলে রোহিঙ্গাদের উপর অত্যাচার বেড়ে যায়। ১৯৭৮-১৯৯২ খ্রিস্টাব্দ থেকে তাদের ওপর সামরিক নির্যাতন চালালে ৫ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী পৃথিবীতে সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ এবং সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর অন্যতম। তারা স্বাধীনভাবে চলাফেরা এবং বার্মিজ জাতীয় শিক্ষা ও উচ্চশিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত। ‘বার্মিজ জাতীয়তা আইন’ প্রণীত হওয়ার পর থেকে তাদের নাগরিকত্ব হরণ করা হয়েছে। তারা নিয়মিত জবরদস্তি ও বাধ্যতামূলক শ্রমদানের মাধ্যমে নিগৃহীত। রোহিঙ্গা পুরুষদের সপ্তাহে একদিন সামরিক ও সরকারি প্রকল্পে কাজ করতে হয় এবং এক রাতের জন্য প্রহরীর দায়িত্ব পালন করতে হয়। মিয়ানমারের অন্যত্র থেকে আনীত বৌদ্ধদের জন্য তাদের অনেক আবাদি জমি ছেড়ে দিতে হয়। কট্টর জাতিয়তাবাদী বৌদ্ধরা প্রায়ই বৌদ্ধ ও মুসলিম রোহিঙ্গাদের মধ্যে উত্তেজনা ও দাঙ্গা ছড়িয়ে দেয়। রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন শুরু হয় ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দ থেকে। ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দ সামরিক একনায়কতান্ত্রিক সরকারের সময় নির্যাতনের শিকার হয়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নেয়। ২০১২ খ্রিস্টাব্দ সা¤প্রদায়িক দাঙ্গার পর ১ লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমারের আইডিপি ক্যাম্পে অবস্থান করে। এ সময় ২০০ রোহিঙ্গা দাঙ্গায় মারা যায়। সর্বশেষে ২০১৭ খ্রিস্টাব্দ চরম পর্যায়ে নির্যাতন হয় এবং লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে শরণার্থী হয়।

আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি বা আরসা (অজঝঅ) রাখাইন রাজ্যের একটি সক্রিয় রোহিঙ্গা বিদ্রোহী সংগঠন, যারা আরাকানের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম শুরু করে। এর পূর্ব নাম ছিল হারাকাহ আল-ইয়াকিন। পাকিস্তানি (করাচিতে জন্ম) বংশোদ্ভূত এবং সৌদি আরবে শিক্ষিত আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনী এ সংগঠনের নেতা। ২০১২ খ্রিস্টাব্দে সা¤প্রদায়িক দাঙ্গার পর ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে আরসার কার্যক্রম শুরু হলেও ২০১৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে আরসা সক্রিয়ভাবে ও সামরিকভাবে কার্যক্রম চালাচ্ছে। মিয়ানমার সরকার আরসাকে একটি সন্ত্রাসীগোষ্ঠী আখ্যা দিলেও আরসা রোহিঙ্গাদের অধিকার রক্ষার জন্য সংগ্রাম করছে বলে ঘোষণা করেছে। আরসা এখনও সুসজ্জিত বাহিনী হিসেবে গড়ে ওঠেনি। এর সদস্যরা ইউনিফরম বা সামরিক পোশাক পরে না। এখনও তারা অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত নয়। তারা লাঠি, ছুরি এবং সাধারণ অস্ত্র ব্যবহার করছে। ২০১৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে তারা চোরাগোপ্তা হামলা করছে।

দীর্ঘ দুই বছর ধরে কূটনৈতিক তৎপরতা চালালেও মিয়ানমার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফেরত নিতে টালবাহানা করছে। অবশেষে আন্তর্জাতিক চাপে ও বিভিন্ন লবির কারণে অনেকটা হঠাৎ করেই রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে তৎপর হয়ে ওঠে। ২২ আগস্ট ২০১৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ছোট আকারে প্রত্যাবর্তন শুরু হওয়ার দিন-তারিখ ধার্য হয়। ৩ হাজার ৫৪০ শরণার্থীকে প্রথম পর্যায়ে ফেরত নেওয়া হবে বলে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার দুপক্ষই সম্মত হয়। উদ্দেশ্য, তবু শুরু হোক। আয়োজন প্রস্তুত। বাংলাদেশের দেওয়া ২২ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা থেকে ৩ হাজার ৫৪০ জন যাওয়ার জন্য নির্বাচিত হয়। কিন্তু শরণার্থীরা বেঁকে বসে। তাদের দেওয়া পাঁচ দফা দাবি পূরণ না হলে তারা ফেরত যাবে না স্থির করে। এর আগে প্রথম ধাপে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের তারিখ ঠিক হয়েছিল নভেম্বর ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে । কিন্তু তা-ও বাস্তবায়িত হয়নি মিয়ানমারের অনীহার কারণেই। এরই মধ্যে বাংলাদেশ দুই দেশের সমঝোতার ভিত্তিতে এ পর্যন্ত ১ লাখ ৬০ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা দিয়েছে মিয়ানমারকে। রোহিঙ্গাদের পাঁচ দফা দাবি হচ্ছেÑ নাগরিক অধিকার প্রদান/ফেরত এবং পরিচিতি কার্ড, জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা, জাতিগত নৃগোষ্ঠী রোহিঙ্গা হিসেবে স্বীকৃতি, হারানো সম্পত্তি পূর্ণ প্রাপ্তি, চাকরির অধিকার এবং সংশ্লিষ্ট দাবি-দাওয়া এরই মধ্যে ২৮ আগস্ট প্রায় ২ লাখ শরণার্থী এক মহাসমাবেশ করে কক্সবাজারে। তারা সেখানে তাদের দাবি-দাওয়া সম্পর্কে সোচ্চার হয় এবং ২৮ আগস্টকে রোহিঙ্গা নিধনের দ্বিতীয় বার্ষিকী হিসেবে পালন করে।

স্থানীয় জনদুর্ভোগ :

মানবিক কারণে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় পেয়েছে। কিন্তু এই মানবিকতার কারণেই এখন সবচেয়ে বেশি কক্সবাজার জেলায় দেখা দিয়েছে নানা ঝুঁকি ৷ খুব সহসাই এ সংকটের সমাধান না হওয়ায় সারাদেশে রোহিঙ্গারা যেমন ছড়িয়ে পড়ছে তেমনিভাবে নিত্যদিন তৈরি হচ্ছে নানা চ্যালেঞ্জও। বিশেষত স্বাস্থ্যঝুঁকি, বন উজাড়, আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা ছাড়াও অর্থনৈতিক ঝুঁকি, মাদকের বিস্তর সয়লাব, পর্যটনশিল্প , নিরাপত্তা ঝুঁকি, শিক্ষা ব্যাবস্থা ও পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা, রাস্তাঘাটে দীর্ঘযানজট , তরুণ প্রজন্মের শিক্ষাবান্ধবতার চেয়ে এনজিও আর আইএনজিও কেন্দ্রিক দৌড়ঝাঁপ, আবাসন ব্যাবস্থায় ব্যাপকতর মূল্যবৃদ্ধি, পানির লেয়ার শূন্যতাসহ এসব সমস্যার দরুন স্থানীয়রা দীর্ঘতম সময় ধরে রোহিঙ্গাদের অবস্থান জনদুর্ভোগে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের মধ্যে আছে এইডস আক্রান্ত মানুষ। যদিও বাংলাদেশে এখন কলেরা নেই তবে রোহিঙ্গাদের মধ্যে রয়েছে সেই সমস্যাও।

বর্তমানে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয় শিবিরে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ১১ লাখ ৮৫ হাজার ৫৫৭ জন, যার মধ্যে নারী ও শিশুই বেশি।

বৈশ্বিক খাদ্য সংকট প্রতিবেদন-২০১৯’ এর ওপর। প্রতিবেদনটির ভূমিকায় জাতিসংঘের মহাসচিব লিখেছেন । এটি যৌথভাবে প্রণয়ন করে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট, যুক্তরাস্ট্র সরকারের বৈদেশিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডি, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইউনিসেফসহ মোট আটটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। প্রতিবেদনে কক্সবাজারের স্থানীয় ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক অবস্থা সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো রোহিঙ্গাদের খাদ্য ও অন্যান্য সহায়তা দিচ্ছে। শিবিরে আসার পর ৯১ শতাংশ রোহিঙ্গার খাদ্য পরিস্থিতি আগের চেয়ে উন্নত হয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গারা আসার পর স্থানীয় ব্যক্তিদের খাবার কেনার সামর্থ্য কমে গেছে। সামগ্রিকভাবে ৪৮ শতাংশ জনগোষ্ঠীর হাতে খাবার কেনার যথেষ্ট অর্থ নেই।’ চলছেন ধারদেনায় কিংবা সঞ্চয় ভেঙে। আশ্রয়শিবিরের দুই উপজেলার জনসংখ্যা সাড়ে ৫ লাখের মতো। আর অতিথি এখন দ্বিগুণ। রোহিঙ্গারা বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী। প্রাণভয়ে পালিয়ে এসেছে আমাদের দেশে। আশ্রয় দিয়েছে সরকার। সর্বতোভাবে সহায়তা দিয়েছে স্থানীয় জনগণ। দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় ভিত্তিতে রোহিঙ্গাদের জন্য সাহায্যও আসছে। অবশ্য তাদের অনেকের আবাসন ব্যবস্থা অনেকটাই ঝুঁকিপূর্ণ। তবে খাদ্যপ্রাপ্তির বিবেচনায় তারা নিজ দেশ মিয়ানমার থেকে ভালো আছে, স্থানীয় জনগোষ্ঠিরা যে পরিমাণ রোহিঙ্গাদের সহায়তা দিয়েছে এটা প্রতিবেদন থেকে সুস্পষ্ট। কিন্তু ঝুঁকির তুলনায় খুব কম সংখ্যক স্থানীয় লোক সহযোগিতার আওতায় এসেছে।

পরিবেশের ঝুঁকি :

রোহিঙ্গারা স্বভাবত আধুনিক চিকিৎসার সাথে পরিচিত হলেও রাস্ট্রীয় কাঠামোতে নাগরিক সুবিধার বাইরে থাকায় তাদের মধ্যে রয়েছে মারাত্মক নানান রোগের সয়লাব। রোহিঙ্গারা ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের ২৫ আগষ্ট বাস্তচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আসার পর এইডস রোগের মতোন মরণব্যাধী রোগের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোগী সনাক্ত হয়। এছাড়া তাদের মাঝে আরো জটিল জটিল রোগীর সন্ধান পাওয়া যায় যা ইতোপূর্বে কখনো কক্সবাজারের লোকজন পরিচিত ছিলো না এবং ক্যাম্পে নিয়োজিত দাতা সংস্থার হিসাব মতে কক্সবাজারে আশ্রয়রত রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৩৬৩ জনের দেহে এইচআইভি পজেটিভ বা এইডস জীবাণুর উপস্থিতি পেয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। এর মধ্যে ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্তদের মধ্যে হিজড়াও রয়েছে একজন। মিয়ানমারের জনসংখ্যা ৫ কোটি ২০ লাখের মধ্যে এইচআইভি বা এইডস নিয়ে বসবাসকারী ২ লাখ ৩০ হাজার বলে তথ্য আছে জাতিসংঘের এইডসবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইডসের কাছে। এ হিসাবে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া ১০ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে এইচআইভি বা এইডস নিয়ে বসবাসকারী রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৪ হাজার।

উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য বিষয়ক অফিস সূত্র বলেছে আক্রান্তদের ৩৬৩ জনের মধ্যে ১২২ জন পুরুষ, ১৯৫জন নারী, ছেলে শিশু ২৪জন, কন্যাশিশু ২১জন ও একজন হিজড়া জনগোষ্ঠীভুক্ত। মৃত্যুবরণকারী ১৬ জনের মধ্যে ৭ জন নারী, ৬ জন পুরুষ ও ৩ জন কন্যাশিশু।

অন্যদিকে চার পাঁচ দশক ধরে রোহিঙ্গারা শরণার্থী হয়ে যতদিন বাংলাদেশে রয়েছে ততদিন আমরা দেখেছি সবসময় উখিয়া টেকনাফের সবুজ পাহাড় সাবাড় করে বসতি স্থাপন করে ছিলো। এতে উল্লেখযোগ্য পাহাড়ের বনগুলো ধীরে ধীরে উজাড় হচ্ছিলো ঠিক তাতেও বেশ বনভূমির সবুজ বনজঙ্গল অনেকটা দৃশ্যত ছিল। কিন্তু ২০১৬ ও ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তীসময়ে উখিয়া আর টেকনাফের বনবিভাগের রক্ষিত ও সংরক্ষিত বনের ব্যাপক ক্ষতি সাধন হয়। যা সত্যিকারভাবে অনুমান করা যাবে বাস্তবে তার আগের পরিবেশে ফেরানো কঠিন হবে।

কক্সবাজার জেলা বনবিভাগের সূত্রমতে উখিয়া রেঞ্জে কুতুপালং, থাইংখালী ও আশপাশের পাহাড়ের প্রায় তিন হাজার একর জায়গায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয়কেন্দ্র করা হয়েছে৷ এছাড়া টেকনাফ রেঞ্জে ৪৫০ একর, পুটিবুনিয়া রেঞ্জের ৫০ একর এবং শিলখালী রেঞ্জের ৩৭৫ একর পাহাড়ি বন কেটে রোহিঙ্গা বসতি করা হয়েছে। এতে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর যেমন জ্বালানির সমস্যা হচ্ছে তেমনি পরিবেশের ক্ষতি হয়েছে অপ্রতুল। অন্যদিকে বনভূমির উজাড়ের সাথে পাহাড় কাটা হয়েছে হাজার হাজার একর এতে লোকালয়ের যে আগেকার পরিবেশ দৃশ্যমান ছিলো তা এখন সম্পূর্ণ মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। বলতে গেলে পাহাড়-বনের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেলো তা নিয়ে সর্বমহলে উদ্বেগের শেষ নেই।

পরিবেশবাদী সংঘটনের মতে রোহিঙ্গাদের বসতির কারণে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে ১ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকার বন ধ্বংস হয়ে গেছে। হুমকির মুখে পড়েছে স্থানীয় পরিবেশ, বনভূমি ও জীববৈচিত্র। ধ্বংস হয়েছে ৬ হাজার ১৬৩ হাজার একর বনও। এ ছাড়া রোহিঙ্গারা বসতি স্থাপন করতে গিয়ে এশিয়ান হাতির আবাসস্থল ও বিচরণ ক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

কক্সবাজারের উখিয়া থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সড়কের দু’পাশে কালো রঙের পলিথিন ও ত্রিপলি দিয়ে বানানো হয়েছে ১১ লাখ রোহিঙ্গাা ঝুপড়িঘর। যতদূর চোখ যায় একই চিত্র। পাহাড়-বনাঞ্চলের সবুজ বনভূমি এখন আর কিছুই চোখে পড়ে না। পাহাড়গুলো কেটে এই ঝুপড়িঘরগুলো বানানো হয়েছে। বন বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, সাড়ে চার হাজার একর পাহাড় কেটেছে রোহিঙ্গারা।

পরিবেশে বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবাদিদের আশঙ্কা এই পাহাড়গুলো ১৫-২০ মিলিয়ন বছরের (দেড় থেকে দু’কোটি বছর) পুরনো। পাহাড়গুলো কাটার ফলে এখন বৃষ্টি হলে পাহাড়ের মধ্যে পানি ঢুকে পড়বে৷ কক্সবাজার এলাকার পাহাড় ও বন নিয়ে গবেষণা করছেন চট্টগাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অফ ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের অধ্যাপক ড. দানেশ মিয়া। তিনি স¤প্রতি বিদেশী গণমাধ্যমে তথ্য দিয়েছেন ‘পরিবেশ এবং বনভূমির কথা চিন্তা করলে রোহিঙ্গাদের জন্য বিকল্প জ¦ালানির ব্যবস্থা করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সবাইকে রান্না করে খেতে হচ্ছে। এক লক্ষ চূলা যদি থাকে, সেই এক লক্ষ চূলার জন্য প্রতিদিন যদি ন্যুনতম পাঁচ কেজি জ্বালানি ধরি, তাহলে প্রতিদিন পাঁচ লক্ষ কেজি কাঠ পুড়ছে। এগুলো কোনো না কোনোভাবে আমাদের উখিয়া টেকনাফের জঙ্গল থেকে যাচ্ছে। এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে বনভূমির বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যাবে। স্থানীয় পরিবেশবাদী সংস্থা এনভায়রনমেন্ট পিপলসের হিসাব অনুসারে, পাহাড়ের আশেপাশের জায়গা ধরলে রোহিঙ্গাদের বস্তির জায়গার পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার একর। এই বিপুল পরিমাণে পাহাড় কাটায় এলাকায় মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়ের হয়েছে।

অন্যদিকে কক্সবাজারের বন বিভাগের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের জন্য কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগ নিয়ন্ত্রণাধীন উখিয়া ও টেকনাফে ২ হাজার ২৭ একর সৃজিত বন (প্রধানত সামাজিক বনায়ন) এবং ৪ হাজার ১৩৬ একর প্রাকৃতিক বন ধ্বংস হয়ে গেছে। এ পর্যন্ত ৮ লাখ ৭২ হাজার ৮৮০ জন রোহিঙ্গা বনাঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছে। রোহিঙ্গাদের জন্য ২ লাখ ১২ হাজার ৬০৭টি গোসলখানা, ত্রাণ সংরক্ষণের জন্য ২০টি অস্থায়ী গুদাম, ১৩ কিলোমিটার বিদ্যুতের লাইন, ৩০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ এবং ২০ কিলোমিটার খাল খনন করা হয়েছে। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক একটি অবকাঠামো তৈরি করবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার বনভূমি ও বনজ সম্পদ পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে। এ ছাড়া রোহিঙ্গারা মিয়ানমার ফিরে গেলেও জায়গা জবরদখল হয়ে যেতে পারে এবং স্থাপনাগুলো অপসারণ করে বনায়ন করা কঠিন হবে।

আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ঝুঁকি :

কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে এখন স্থানীয় নাগরিকরা রোহিঙ্গাদেরভীড়ে সংখ্যালঘুতে পরিণত বলতে গেলে সার্বিক পরিস্থিতি দিনদিন কঠিন হয়ে উঠছে।

স্থানীয় এলাকায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দুষ্প্রাপ্যের পাশাপাশি স্থানীয় জনগোষ্ঠীর স্বাভাবিক জীবন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নিয়ম অনুযায়ী শরণার্থীরা কোনো কাজে নিয়োজিত হতে পারবে না, কিন্তু তারা ক্যাম্প থেকে সুকৌশলে বের হয়ে অল্প পারিশ্রমিকের বিনিময়ে লবণ মাঠ, চিংড়ি হ্যাচারি, চাষাবাদের কাজসহ বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত হচ্ছে। এতে স্থানীয় দরিদ্র শ্রমিকরা কর্মহীন হয়ে পড়েছে। ক্যাম্পের অভ্যন্তরীণ সকল কাজে রোহিঙ্গা শ্রমিকরা স্বল্পবেতনে কাজ করায় স্থানীয় শ্রমজীবীরা সেদিক দিয়েও বঞ্চিত ফলে আরো নৈরাজ্যকর অবস্থা তৈরি হচ্ছে।

উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার আশ্রয় শিবিরের আশেপাশে শিক্ষাব্যবস্থাও একদম নাজুক অবস্থা। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রোহিঙ্গা জন¯্রােতে সেবা সংস্থায় চাকুরি নিতে চলমান শিক্ষার্থীরা একাডেমিক ইস্তাফা দিয়ে সেদিকে ঝুঁকে পড়েছে ফলে আগামি প্রজন্মের শিক্ষাবান্ধবতার জায়গাটি চরমভাবে উদ্বেগজক ।

এমনকি কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য বাহিনীর সদস্যরা নিরাপত্তার খাতিরে অবস্থান করছেন। সেখানে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি অর্ধেকেরও কম। তাছাড়া রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে বহু আগে থেকে। এর জন্য তাঁরা দেশীয় দালালদের সহায়তায় ভূয়া জন্মনিবন্ধন সনদ ও জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করে রাজনৈতিক দলের কর্মী হওয়ার চেষ্টা করে এবং বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশ চলে যাওয়ার নজিরও মিলেছে অহরহ। সরকারের সহযোগিতায় দাতা সংস্থা যে রেশন দিচ্ছে তাতে রোহিঙ্গারা অলস দিনযাপন করে বিভিন্ন অপরাধে সহসায় জড়িয়ে যায়।

এমনকি শরণার্থী হয়ে আশ্রিত জায়গায় ব্যবসা বাণিজ্যের নিয়ম না থাকলেও তারা উখিয়া টেকনাফের ৩৪ টি ক্যাম্প সংশ্লিষ্ট নিরাপদ স্থানে সানন্দে বিভিন্ন দোকানপাট ও বাজার খুলে বসে আছে। এতে একধরনের স্থানীয় ও রোহিঙ্গা প্রীতির ব্যবসায়িক সিন্ডিকেট তৈরির ফলে বহুমাত্রিক সংঘাতের উদ্ভব হয়।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা যায়, ‘২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট পরবর্তী মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার পর নিজেদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার, ত্রাণ সামগ্রী বণ্টন নিয়ে বিরোধ, পূর্ব-শত্রুতার জের, ইয়াবা কারবার, অভ্যন্তরীণ দ্বন্ধে অপহরণ, খুন, ধর্ষণের মতো অনেক ঘটনা ঘটেছে। গত দুই বছরে রোহিঙ্গা শিবিরে নিজেদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দে নিহত হয়েছেন ৪৩ জন রোহিঙ্গা। এছাড়া ‘বন্দুকযুদ্ধে’ আরও ৩২ রোহিঙ্গা নিহতের কথা জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী

তার মধ্যে উখিয়ায় ২৪ জন, টেকনাফে ৮ জন নিহত হয়। ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের ২৫ আগস্টের পর বাংলাদেশের প্রবেশের পর ডাকাতি, অপহরণ, ধর্ষণ, চুরি, মাদক ও মানবপাচারসহ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৪৭১টি। যার মধ্যে মাদক মামলা ২০৮, হত্যা মামলা ৪৩ ও নারী সংক্রান্ত মামলা ৩১ টি। এসব মামলায় আসামি ১০৮৮ রোহিঙ্গা।

আবার রোহিঙ্গারা সুকৌশলে জড়িয়ে যাচ্ছে মাদক ব্যবসায় ফলে স্থানীয় পর্যায়ে আরো অস্থিরতা বাড়ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে মরণ নেশা যা ইয়াবা ঢোকে তার ৯০ ভাগই মিয়ানমার থেকে। ইয়াবা এখন বাংলাদেশের অন্যতম বড় সমস্যা। তাঁদের এ সব কাজের সুযোগ করে দিচ্ছে এ দেশের কিছু মানুষ এবং ব্যবহার হচ্ছে বেশিরভাগ রোহিঙ্গা। অভিযোগ রয়েছে, পালিয়ে আসার সময় অনেক রোহিঙ্গা সঙ্গে করে কিছু ইয়াবাও এনেছেন। তাঁরা যখন দলে দলে এখানে ঢোকেন, তখন তাঁদের তল্লাশি করে ঢোকানোর কোনো সুযোগ ছিল না।

রোহিঙ্গা আসার আগে এখানে তরি তরকারিসহ অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় ফসল উৎপাদনে এই অঞ্চল উদ্বৃত্ত ছিল। একটু কম দামেই স্থানীয় ব্যক্তিরা এগুলো কিনতে পারত। এখন এত লোকের চাহিদা মেটাতে কক্সবাজার কিংবা চট্টগ্রাম থেকে এগুলোও আনতে হয়। স্বাভাবিকভাবে দাম গেছে চড়ে আর খেসারত দিচ্ছে স্থানীয় জনগণ।

আন্তর্জাতিক সংস্থা ও এনজিওগুলোর বেশ কিছু স্থানীয় কর্মী আবশ্যক হয়। বারবার দাবি করা হয়েছিল সম্ভাব্য ক্ষেত্রে কর্মী নিতে হবে স্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্য থেকে। দাবিটির যৌক্তিক ভিত্তি রয়েছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয় বিষয়টি। রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকেও কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়। অথচ তারা তো অনেক ধরনের ভোগ্যপণ্যই ত্রাণ সহায়তা হিসেবে পাচ্ছে। এ কাজগুলো স্থানীয় ব্যক্তিরা পেলে তাদের দুর্ভোগ কিছুটা কমত। স্থানীয় অবকাঠামো চুরমার হয়ে গেছে। এতে যাতায়াত ব্যয় ও সময় বেড়েছে। প্রভাব পড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্যে। খেসারত দিচ্ছে স্থানীয় জনগণ। এভাবে দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হচ্ছে তারা। মধ্যবিত্ত নেমে গেছে দরিদ্র শ্রেণিতে। শুরু থেকে সরকারি ত্রাণ বিতরণের সাংগঠনিক ব্যবস্থা তেমন কিছুই ছিল না। এদের ভাত পানিতে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছে স্থানীয় ব্যক্তিরাই। আর এখন সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন স্থানীয়রা।

নিরাপত্তা ঝুঁকি :

রোহিঙ্গারা বেপরোয়া হওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। তাদের বিভিন্ন অপকর্মের সয়লাবে অনেক স্থানীয়রা নিহত হয়েছে খোদ রোহিঙ্গাদের হামলায়। রোহিঙ্গাদের হামলার শিকার হয়েছে স্থানীয় অধিবাসী, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। স্থানীয় জনগণ রোহিঙ্গা আতঙ্কে ভুগছে। ভবিষ্যতে আরও কঠিন পরিস্থিতির শিকার হবেন স্থানীয়রা এমন আশঙ্কা করছেন। আগে রোহিঙ্গারা খাবারসহ নানা প্রয়োজনীয় জিনিসের জন্য দৌড়াদৌড়ি করতো। এখন তাদের খাবার ও সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিসের জন্য কোথাও দৌড়াতে হয় না। এনজিওরা তাদের ঘরে ঘরে সব প্রয়োজনীয় জিনিস পৌঁছে দিচ্ছে। কোনো কাজ ও সংসারের পিছুটান না থাকায় রোহিঙ্গারা নানা অপকর্মে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তারা রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে ইয়াবা রাজ্য বানিয়েছে। ধর্ষণ, খুন, হামলা তাদের নিয়মিত কাজে পরিণত হয়েছে। তাদের কারণে স্থানীয়রা এখন অসহায় হয়ে পড়েছে। নিরাপত্তা ঝুঁকি ও আতংকের মধ্যে রয়েছেন স্থানীয়রা।

১০ মে ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার খিলক্ষেতের একটি বাসা থেকে ডিবি পুলিশ ২৫ জন রোহিঙ্গা কিশোরীকে উদ্ধার করে। ১২ মে ২০১৯ খ্রিস্টাব্দ ইনানী থেকে ১৭ জন রোহিঙ্গা নারীকে পুলিশ উদ্ধার করে। ১৪মে ২০১৯ খিস্টাব্দ উদ্ধার করা হয় ১৭ জন নারীকে! জুন মাসে কক্সবাজার থেকে পাচারের সময় অন্তত ২১ জন নারীকে উদ্ধার করা হয়। ২০ জুলাই ২০১৯ খ্রিস্টাব্দ ঢাকা থেকে দুই রোহিঙ্গা নারীকে উদ্ধার করে র‌্যাব। এ ছাড়া শুধু কক্সবাজার নয়, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, খুলনাসহ বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকা থেকেও রোহিঙ্গা নারীদের উদ্ধার করা হচ্ছে এবং উদ্ধারের পর তাদের ক্যাম্পে ফেরত পাঠানো হয়। এমন পরিবেশ চলমান থাকলে স্থানীয়দের পাশাপাশি সর্বক্ষেত্রে চরম নিরাপত্রা ঝুঁকি দিতে পারে।

শিক্ষাব্যাবস্থা নাজুকতা ও রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি নাগরিকত্ব গ্রহণ :

রোহিঙ্গা সংকটের কারণে কক্সবাজারের টেকনাফ, উখিয়া এবং বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে জেএসসি পরীক্ষাসহ সব পাবলিক পরীক্ষায় শিক্ষার্থী ও পাসের হার কমেছে। একই সঙ্গে কমেছে অভ্যন্তরীণ সব পরীক্ষা ও ক্লাসে উপস্থিতির হার। অনেক শিক্ষার্থী পড়াশুনা বাদ দিয়ে বিভিন্ন এনজিওতে কাজ করছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একাডেমিক ও অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন স্থানীয়রা। রোহিঙ্গার চাপে স্কুলগুলোর স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। স্কুলের খেলার মাঠ, শ্রেণিকক্ষ, চেয়ার, টেবিল, বেঞ্চ, দরজা, জানালা, টয়লেট ও মেঝের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

সারাদেশের ন্যায় ৬মে ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত এসএসসি পরীক্ষায় এবার উপজেলায় ফলাফল বিপর্যয় ঘঠেছে রোহিঙ্গা আশ্রিত এলাকার স্কুল গুলোতে। অভিভাবকেরা এর জন্যে রোহিঙ্গা প্রভাবের কারণ বলে মনে করছেন।

প্রকাশিত ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৯ সালের ঘোষিত এসএসসি পরীক্ষায় রোহিঙ্গা আশ্রিত কুতুপালং উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশের হার ৬৫%। পাশপাশি বালুখালী কাশেমিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশের হার ৫৯%। থাইংখালী উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশের পাশের হার ৫৬%। এবং সর্বশেষ পালংখালী উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশের হার ৪৩%। যাহা উপজেলার সর্বনি¤েœ।

এক প্রতিবেদন থেকে উঠে আসে গত ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের ২৫ আগস্টের পর থেকে উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের যে সমস্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলো রয়েছে এসব বিদ্যালয়গুলোতে পড়ালেখায় প্রভাব পড়েছে। কারণ এসব বিদ্যালয়ে ম্যানেজিং কমিটির মাধ্যমে নিয়োগকৃত বেশ কিছু প্যারা শিক্ষক ছিল। এতে সম্মানী দেওয়া হত ৩ থেকে ৪হাজার টাকা। রোহিঙ্গা আসার পর বিভিন্ন এনজিও সংস্থা ৩০ থেকে ৪০হাজার টাকা বেতনের চাকরি দেওয়া শুরু করলে ওই সব প্যারা শিক্ষককেরা স্কুল ছেড়ে এনজিওতে চলে আসে। যার কারণে বিদ্যালয়ের ফলাফলের এই করুন অবস্থা। রোহিঙ্গাদের চৌকস কিছু যুবক স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালীদের নাগালে নিয়ে নিজের ও সংশ্লিষ্ট আত্মীয়দের বাংলাদেশি প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহে ভর্তি করে পরবর্তীসময়ে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে দেশব্যাপি ছড়িয়ে যাচ্ছে। শিক্ষার সুবাধে বাংলাদেশি মেয়েদের সাথে আত্মীয়তার পরিণয়ে কে রোহিঙ্গা কে বাংলাদেশি তা নিয়ে ধু¤্রজাল সৃষ্টি হচ্ছে।

পর্যটন শিল্পের জন্য হুমকি :

রোহিঙ্গাদের অবস্থান এখন কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পের জন্য এক বড় ধরনের হুমকি হয়ে আছে। কারণ তারা শরণার্থী শিবির পেরিয়ে বিশেষ দালাল চক্রের শক্তিশালী সিন্ডিকেটের হাত ধরে ভাষাগত মিলের কারণে রেস্টুরেন্ট চাকুরি, রিক্সা চালক, কাজের বোয়া, দোকানের কর্মচারির জায়গায় স্থলাভিষিক্ত হচ্ছে। এসবের ফলে সুযোগ নিয়ে গরীব পরিবারের মেয়েদেরও টার্গেট করে আত্মীয়তা তৈরি করে অভাবের তাড়নায় ছিনতাই অপকর্মে জড়িয়ে যাচ্ছে। তাদের বিশেষ টার্গেট থাকে পর্যটকদের কাছে পৌঁছা এবং মোবাইল ছিনতাই করা; তবে প্রশাসনের এ ক্ষেত্রে শক্ত অবস্থান থাকায় অনেকটা ঝুকিমুক্ত। এছাড়া রোহিঙ্গা তরুণীরা বিশেষ কৌশলে পর্যটন জোনের হোটেল মোটেলে অনৈতিক কর্মে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ছে এমন তথ্যও ছড়িয়ে পড়ছে। রোহিঙ্গা নারীদের কক্সবাজারে অবাধে চলাফেরা করতে দেখেছেন অনেকে। এ নিয়ে স্থানীয়রা উদ্বিগ্ন, উদ্বিগ্ন প্রশাসনও। এভাবে চলতে থাকলে কক্সবাজারকে অনেকেই পাশ কাটিয়ে অন্য পর্যটনকেন্দ্রে চলে যেতে পারেন। এমনটা হলে কক্সবাজারের পর্যটনে ভয়াবহ ধস নামতে পারে। নাম পরিচয় গোপন করে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার আশপাশে তাঁরা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকছেন। কক্সবাজারের উখিয়া, টেকনাফ ও বিভিন্ন এলাকায় ইতিমধ্যে অভিযান চালিয়ে পাঁচ শতাধিক রোহিঙ্গাকে আটক করে ক্যাম্পে ফেরত পাঠিয়েছে পুলিশ। তাদের একটা অংশ মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থান করছেন সেখান থেকে হুন্ডির মারফতে তাদের কাছে টাকা পাঠায়। ফলে নিয়মিত জীবনপ্রবাহে খরচ টানতে তেমন বেগ পেতে হয় না।

ফসলি জমির ক্ষতি ও পানির লিয়ার শূন্যতা :

রোহিঙ্গাদের আবাসভূমি করতে স্থানীয় ব্যক্তিদের কারও কারও ফসলি জমি গেছে। সেই আবাসস্থলের পাশাপাশি জমিগুলোও বর্জ্যে আবাদের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। মিষ্টিপানির নিরাপদ উৎস বন্ধ বা দূষিত হয়ে পড়েছে পাহাড়ি ছড়াগুলো। এত লোকের জন্য পানির ব্যবস্থা করতে ভূগর্ভে হানা দিয়ে কাজ চালাতে হয়। ফলে পানির স্তর ক্রমে নিম্নমুখি।

সড়কের যান্ত্রিকজট ও দুর্ঘটনা

রোহিঙ্গা আাসর পর তাদের সেবা দিতে নিয়মিত কক্সবাজারে অবস্থান করছেন ২ হাজার বিদেশিসহ অন্তত ১১ হাজার চাকুরিজীবী। তাঁদের যাতায়াতে ব্যবহার হচ্ছে ২ হাজারের বেশি প্রাইভেট গাড়ি। রোহিঙ্গা শিবিরে দৈনিক গড়ে ৪ শতাধিক ট্রাকে মালামাল পরিবহন হচ্ছে। এ ছাড়া টেকনাফ সীমান্ত বাণিজ্যে আমদানি-রপ্তানির ট্রাক, পর্যটকদের গাড়ি, যাত্রীবাহী বাস চলাচল করছে আরও এক হাজারের বেশি। ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক, অটোরিকশা, জিপ, মাইক্রোবাস ও ট্রাক চলে আরও ৭ হাজার। ফলে সড়কটিতে যানবাহনের চাপ অতিতের চেয়ে অনেক গুণ বেশি হয়ে পড়েছে। কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের ৭৯ কিলোমিটারের পথ পাড়ি দিয়ে কক্সবাজার পৌঁছাতে সময় লাগত এক ঘণ্টা। বর্তমানে কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কে এই দূরত্ব অতিক্রম করতে সময় লাগে প্রায় চার ঘণ্টা। সড়কজুড়ে শত শত খানাখন্দের কারণে তৈরি হচ্ছে তীব্র যানজট। যার ফলে অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সব ধরনের সরকারি-বেরসকারি দপ্তরে কর্মরত চাকুরিজীবীরা সঠিক সময়ে কর্মস্থলে পৌঁছতে না পেরে নানান সমস্যায় পড়তে হচ্ছে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর। এছাড়াও স্কুল,কলেজ,মাদ্রাসার ছাত্র/ছাত্রীরা যথাসময়ে প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত হতে পারছে না এমনকি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা আসলে পরীক্ষার্থীদের স্বাভাবিক নিয়মের চেয়ে ৩ ঘণ্টা আগে বাসা থেকে বের হতে হয়। এমন নানা অস্থির সময়ের মধ্যে লোকাল গণমানুষকে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। সরু সড়কে খানাখন্দে ইতোমধ্যে শতাধিক সড়ক দুর্ঘটনা হয়েছে এতে অন্তত বেশ হতাহত হয়েছে।

স্থানীয়ভাবে যে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে তার সমাধান কি করে সম্ভব! :

আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে যে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে তার সমাধান কি করে সম্ভব!

এই প্রশ্নটি আজকে সচেতন সব মানুষের। দেশের বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের আড্ডায়, জাতীয় ও স্থানীয় পত্রপত্রিকা, ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ায় রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান নানা ধরনের কথার গুঞ্জন আমরা শুনেছি, কিন্তু ফলাফল বা অর্জন নেই। এমত অবস্থায় আমাদের পর্যবেক্ষণ থেকে বলতে পারিÑবৃহৎ শক্তি চীন এবং রাশিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান ছাড়া কোন পথ খোলা নেই। যেভাবেই হোক চায়না এবং রাশিয়ার সম্মতি আদায় করতে পারলে বার্মার সামরিক জান্তারা রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে রাজি হতে পারে। অন্যথায় যে সমস্যা রোহিঙ্গরা বাংলাদেশে অবস্থানের কারণে সৃষ্টি হয়েছে, ভবিষ্যতে এই সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করবে। এমনিতেই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল’র দিকে যাচ্ছে না; এই অবস্থায় দশ লক্ষ রোহিঙ্গার দেশে দীর্ঘ মেয়াদী অবস্থান দেশের অর্থনীতি এবং আইনশৃঙ্খলার জন্য মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। সুতরাং যত শীঘ্রই সম্ভব জাতিসংঘের সহযোগিতায় চীন এবং রাশিয়ার সম্মতিতে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। অর্থাৎ রোহিঙ্গারা সম্মান ও মর্যাদার সহিত বার্মার নাগরিত্ব অর্জনের মাধ্যমে দেশে ফিরে যেতে পারে। জাতিসংঘের নিয়ন্ত্রণে বহুজাতিক বাহিনীর মাধ্যমে রোহিঙ্গাদেরকে পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। তা নাহলে এদিকের সমস্যার সমাধান হবে না, ও দিকের ও সমস্যার সমাধান হবে না।

মুহাম্মদ হোসাইন: স্টাফ রিপোর্টার, দৈনিক সকালের কক্সবাজার।