অধ্যপক রায়হান উদ্দিন

ইতিহাসের পাতায় অনেক অসাধারণ জীবনের গল্পই স্থান পায়। যেসব গল্প মানুষের অন্তরে আলাদা স্থান করে নেয়। আর সেই গল্প যদি হয় রাজা-বাদশাহদের তবে তো আর কথায় নেই। আমাদের এই উপমহাদেশও এক সময় রাজা-বাদশাহদের অধীন ছিল। সেই সব রাজা বাদশাহদের অনেক ইতিহাস ঘটনা আমরা হয়তো শুনেছি। কিছু ইতিহাস আমাদের কাঁদিয়েছে, কিছু ইতিহাস আমাদের হাসিয়েছে আবার কিছু ইতিহাস করেছে অবাক।

আসলে এতক্ষণ যেই সময়ের কথা বলছিলাম সেই বিখ্যাত সময়ের বাংলার সুলতান ছিলেন একজন বিখ্যাত ব্যক্তি। তিনি হলেন গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ। তিনি প্রায় ১৮ বছর পর্যন্ত এই বাংলা রাজত্ব করেছিলেন।সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ কেবল শাসক ছিলেন না বরং তিনি ছিলেন ধার্মিক, ন্যায় পরায়ণ এবং সুবিচারক শাসক। তিনি অতান্ত নিষ্ঠার সাথে ইসলামি শরিয়ার নিয়ম কানুন পালন করতেন।গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ তাঁর আদর্শ চরিত্র, শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতা এবং সুশাসনের জন্য যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেন। আইনের প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধা ছিল।

সুলতান গিয়াাসউদ্দীন আজম শাহ নিজে বিদ্বান ও কবি ছিলেন। তিনি বিদ্বান লোকদের খুব সমাদর করতেন। মাঝে মাঝে তিনি আরবি ও ফারসি ভাষায় কবিতা লিখতেন। পারস্যের বিখ্যাত কবি হাফিজের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ ছিল। একবার তিনি হাফিজের নিকট কবিতার একটি চরণ লিখে পাঠান এবং কবিতাটিকে পূর্ণ করার জন্য কবিকে অনুরোধ জানান। তিনি তাঁকে বাংলায় আসার আমন্ত্রণও জানান। হাফিজ দ্বিতীয় চরণটি রচনা করে কবিতাটি পূর্ণ করে পাঠান। তিনি সুলতানের নিকট একটি গজলও লিখে পাঠান। গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ বাংলা সাহিত্যের উন্নতির ক্ষেত্রেও যথেষ্ট অবদান রাখেন। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় শাহ মুহম্মদ সগীর তাঁর বিখ্যাত কাব্য ‘ইউসুফ জোলেখা’ রচনা করেন। সম্ভবত সুলতান কৃত্তিবাসকেও বাংলায় রামায়ণ লেখার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ তাঁর পিতা (সুলতান সিকান্দার শাহ) ও পিতামহের (সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ) মতোই আলেম ও সুফিদের অত্যন্ত ভক্তি ও শ্রদ্ধা করতেন। তিনি বিদ্বান ও ধার্মিকদের উদার পৃষ্ঠপোষকতাও করতেন। তাঁর সমসাময়িকদের মধ্যে শেখ আলাউল হক ওনূর কুতুব আলম খুবই বিখ্যাত ছিলেন। তিনি বিহারের শেখ মুজাফফর শামস বলখীকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন। মুজাফফর শামস বলখীর সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ ছিল। তিনি পবিত্র মক্কা ও মদীনার তীর্থযাত্রীদের সব ধরনের সাহায্য দিতেন। তিনি একাধিকবার মক্কা ও মদীনা শহরের অধিবাসীদের জন্য প্রচুর উপঢৌকন পাঠিয়েছিলেন। কথিত আছে যে, তিনি ইসলামি শিক্ষা বিস্তারের জন্য মক্কার উম্মে হানির ফটকে একটি এবং মদীনার ’বাব আল-সালামে’র (শান্তির দ্বার) নিকটে অপর একটি মাদ্রাসা নির্মাণ করান। এ প্রতিষ্ঠান দুটির জন্য তিনি প্রয়োজনীয় অর্থও প্রদান করেন। এ দুটি মাদ্রাসা ’গিয়ানিয়াা মাদ্রাসা’ নামে পরিচিত। তিনি আরাফা নদীর সংস্কারের জন্য ত্রিশ হাজার স্বর্ণ মুদ্রা (মিছকাল) প্রেরণ করেন।

একদিন তীর ছোঁড়াবার সময় সুলতানের অজান্তে এক বিধবার ছেলের গায়ে সুলতানের তীরের আঘাত লাগলো। কাজী সিরাজ উদ্দিন এর কাছে বিধবা গিয়ে নালিশ জানালো। কাজী সিরাজ উদ্দিন সুলতানকে বিচারালয়ে ডেকে আনার জন্য এক পেয়াদাকে পাঠালেন। এই দিকে কাজী বিচারাসনে বসার আগে আসনের তলায় একটি বেত রেখে দিলেন।

সুলতানের প্রসাদের কাছে পৌঁছে পেয়াদা দেখল সুলতানের কাছে পৌছানো এত সহজ নয়। তাই সে চিন্তা করতে লাগলো কি করে সহজে সুলতানের নজরে আসা যায়। এ নিয়ে অনেক চিন্তা ভাবনা করে অবশেষে তার মাথায় একটু বুদ্ধি বের হলো।

পেয়াদা আযান দিতে আরম্ভ করলো যদিও তখন নামাজের সময় ছিল না। এই আযান আবার সুলতানের কানে গেল। অসময় আযান শুনে সুলতান মুয়াজ্জিনকে তার কাছে হাজির করার হুকুম দিলেন। পেয়াদাকে সুলতানের সামনে হাজির করা হলো। সুলতান তাকে অসময়ে আজান দেয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করলো। পেয়াদা তখন বিনয়ের সাথে বলল, ”আপনি নাকি এক বিধবার ছেলেকে তীর মেরে আহত করেছেন। কাজী আমাকে পাঠিয়েছেন আপনাকে আদালতে হাজির করতে। আপনার কাছে সহজে পৌঁছাতে না পেরে অসময় আজান দিয়ে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বাধ্য হয়েছি। এখন আপনি বিচারালয়ে চলুন?”

সুলতান তখন তার বগলের নিচে একটি ছোট তলোয়ার লুকিয়ে নিয়ে কাজীর আদালতে হাজির হলেন। সুলতান কে কোন রকম সম্মান না দেখিয়ে, কাজী বিধবাকে হুকুম দিলেন, ”এ বুড়ী আপনার বিরুদ্ধে নালিশ করেছে, এর মনে সান্তনা দিন।”

সুলতান তখন সে বিধবাকে যথেষ্ট টাকা পয়সা দিয়ে সন্তুষ্ট করে দিলেন। কাজী সাহেব ফিরে জিজ্ঞাসা করলেন, ”তুমি কি ক্ষতিপূরণ পেয়েছ, খুশি মনে অপরাধীকে ক্ষমা করেছো?” বিধবা উত্তরে বলল, ”হ্যাঁ হুজুর, আমি খুশি হয়ে সুলতান কে ক্ষমা করেছি।”

তখন কাজী মহা আনন্দে উঠে দাঁড়ালেন এবং সুলতান কে যথাযথ সম্মান দেখিয়ে মসনদে বসালেন। সুলতান তখন তার তলোয়ার বের করে বললেন, ”কাজী সাহেব আইনের হুকুম মেনে আপনার আদালতে হাজির হয়েছি। আজ যদি আপনি আইনের বিধান না মেনে আমার পক্ষপাত করতেন, তাহলে এটি দিয়ে আপনার মাথা কেটে দুই ভাগ করে ফেলতাম। শুকরিয়া আল্লাহর আপনি ন্যায় বিচার করতে সক্ষম হয়েছেন।”

কাজিও কম যান না। তিনি তাঁর বিচারাসনের নিচের থেকে বেতটি বের করে বলেন, ”হুজুর শরীয়তের বিধান মতে বিচারের আদেশ অমান্য করলে আপনার প্রাপ্য শাস্তি ছিল বেত্রাঘাত। আল্লাহর কসম আপনি যদি পবিত্র আইনের বিধান পালন করতে ইতস্তত করতেন, তাহলে আমি এই বেত দিয়ে আপনার পিঠে আঘাত করতে এক মিনিটও বিলম্ব করতাম না। যাই হোক আমার উপর একটি বিপদ এসেছিল। আল্লহর হুকুমে বিপদ কেটে গেছে।”কাজী অবশ্য জানতেন সুলতানকে বেত্রাঘাত করলে তার প্রাণহানি সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু এত কিছুর পরেও ন্যায়পরায়ণ কাজীর কাছে তার জীবনের চেয়ে বড় ছিল আইনের মর্যাদা।

তেমনি ইতিহাসের আরেকটি গল্পে আছে প্রেম, ধর্ম আর ন্যায়বিচারের অনুপম দৃষ্টান্ত। তখন দিল্লির সিংহাসনের ক্ষমতা ছিল বাদশাহ জাহাঙ্গীরের। তার পূর্ণ নাম নুরুদ্দীন মুহম্মদ সেলিম । মুঘলদের মধ্যে তিনি ছিলেন চতুর্থ সম্রাট। তিনি প্রায় ২২ বছর রাজত্ব করেন।বাদশাহ জাহাঙ্গীরের স্ত্রী ছিল বেগম নুর জাহান। নুর জাহান ছিলেন অসম্ভব সুন্দরী। তাইতো সম্রাট জাহাঙ্গীর তার নাম দেন নূর জাহান। নুর জাহান শব্দের অর্থ জগতের আলো। শুধু রূপের রানী ছিলেন না নুর জাহান, জ্ঞানে, বুদ্ধিতে, চারুকলা সব কিছুতে সমান পারদর্শী ছিল। উচ্চ শিক্ষিত হওয়ায় তিনি সেই সময় সবচেয়ে প্রভাবশালী নারী ছিলেন। আতর, গোলাপ পানি তিনি প্রথম তৈরি করেন। সালোয়ার, কুর্তা ও দোপাট্টার হরেক রকম ব্যবহার তিনি চালু করেছিলেন। কবিতা লিখতে বেশ হাত চলতো তার। আর ছিল রাজনীতিতে তার আশ্চর্য দখল। বিশাল মোঘল বাদশাহির শাসন বিষয়েও তিনি বুদ্ধি যোগাতেন বাদশাহ জাহাঙ্গীরকে।

ন্যায় বিচারের দিকে মোগল বাদশাহ ছিল সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টি। শহরে শহরে থাকত কাজী। তাদের সবার উপর ছিলেন কাজী উল-কুজ্জাত। কিন্তু বাদশাহর দরবার ছিল সুপ্রিম কোর্ট। দরবারে বসে বাদশাহ নিজেই ফায়সালা করতেন।

বাদশাহ জাহাঙ্গীরের ছিল ন্যায় বিচারের সজাগ দৃষ্টি। বাদশাহ হয়েই তিনি সদর দরজায় একটি শিকল ঝুলিয়ে দিলেন। আর খাস কামরায় একটা ঘন্টা বেঁধে দিলেন তার সাথে। ফরিয়াদি এসে শিকল বাজিয়ে দিতো আর খোদ বাদশাহ নালিশ শুনতেন নিজের কানে। পাইক-পিয়ন, উকিল-মোক্তার কারো দরকার হতো না।

একদিন বেগম নুর জাহান সখীদের নিয়ে তীর ছোঁড়ার খেলায় মেতেছেন। তীর খেলে ছিল তার সবচেয়ে প্রিয় খেলা। তাই তো তার লক্ষ্য ছিল অব্যর্থ ও ভীষণ শক্তিশালী। সেদিন বেগমের তীর খেলায় এক গরীব নিরীহ ধোপার মৃত্যু ঘটে গেল। বেগমের এক তীর আচমকা এসে ধোপার বুকে বেঁধে গেল। বেচারা ধোপা সাথে সাথে মারা গেল। তার দুঃখিনী বউ রক্তমাখা দেহ জডায়ে অজ্ঞান হয়ে গেল। ধোপা এবং গ্রামবাসীদের মধ্যে উঠল কোলাহল, আর্তনাদ আর আহাজারি।নুর জাহানের এসব খবর নেই। তার তীরে যে কেউ মারা গেছে সেটা তার জানাও ছিল না। তীর খেলা শেষে সখীদের নিয়ে আনন্দে মেতেছেন। বাদশাহ তার পাশে বসে তার আনন্দ উপভোগ করছে। সহসা শিকল সদর দরজার শিকল বেজে উঠল ঝন ঝন ঝন। সবাই থেমে গেল। বাদশাহ উঠে পড়ল, দরবারে যেতে হবে কর্তব্যের ডাক এসেছে। কোন ফরিয়াদি এসেছে নালিশ নিয়ে। আর এক মুহূর্ত দেরী করা চলবে না।

ধোপার বৃদ্ধ বউ সেদিনের ফরিয়াদে। চোখের পানিতে ভাসতে ভাসতে করুন কণ্ঠে বিলাপ করতে করতে বর্ণনা দিলেন কিভাবে ধোপা মারা গেছে। তীরটা এসেছিল অন্দর মহলের দিক থেকেই। আর এমন তেজে এসেছিল যে, কলিজা পর্যন্ত ভেদ করে গিয়েছে।

ধোপার বউ দাবি করল, দোষীকে দরবারে হাজির করা হোক, আর দেশের আইন অনুসারে তার শাস্তির বিধান করা হোক খুনের বদলা খুন। তীরটাও হাজির করা হয়েছিল দরবারে। সবাই সভয়ে দেখল, তীরের মাথায় বেগম নূর জাহান লিখা।তীর দেখেই বাদশাহ জাহাঙ্গীর দিশেহারা, কি করবেন সহসা ঠিক করতে পারলেন না। তিনি সাত দিন সময় চাইলেন। তাই মেনে নিয়ে চলে গেল ধোপার স্ত্রী কিন্তু আর একবার দাবি জানিয়ে গেল খুনের বদলা খুন ছাড়া আর কোন বিচার সে মেনে নিবে না। বাদশাহ কেবল ভাবে আর ভাবে, খানাপিনা উৎসব শব বন্ধ। ধর্ম ও পতি প্রেমের এক আশ্চর্য বিরোধ। হক বিচার করলে তা নিজের বুকে লাগে আর না করলে ধোপার স্ত্রীর প্রতি করা হবে অন্যায়।শেষে বাদশাহ মনস্থির করলেন। নুর জাহানকে শাহী কারাগারে আটক করা হবে। সাধারণ কয়েদীর মতই বেগম নুর জাহানের বিচারের অপেক্ষা করতে লাগলো।সাত দিন পর আবার দরবার বসলো। সাধারণ কয়েদীর মত বেগম নূর জাহান আসামীর কাঠগড়ায় আর ধোপার বউ ফরিয়াদির কাঠগড়ায়। বাদশাহ রায় দিলেন এটা নিয়ে নুর জাহানের স্বামী জাহাঙ্গীরের বুকে সজোরে নিক্ষেপ করবে, যাতে তার কলিজা ভেদ করে সাথে সাথে মৃত্যু ঘটে ঠিক হতভাগ্য ধরার মতো। এর ফলে নুর জাহান হবে ধোপার বউয়ের মতো বিধবা আর বিধবা হওয়ার কষ্ট তিনিও মর্মে মর্মে অনুভব করবে। বাদশাহ তীরটি নিয়ে ধোপার স্ত্রীর হাতে দিয়ে বললেন, নাও তোমার খুনের বদলা খুন।

সমস্থ দরবার নিস্তদ্ধ। নূর জাহান মূর্ছা যাওয়ার মত। ধোপার বউ কাঁপতে লাগলো, ধীরে ধীরে নেমে এলো ফরিয়াদের কাঠগড়া থেকে। এরপর কাঁপতে কাঁপতে ভাঙ্গা গলায় বলল মহামান্য বাদশাহ আমি এ বিচার চাই না। আমি বিধবা হযয়েছি বটে কিন্তু ইয়াতিম হতে চাইনি। আমার স্বামী শুধু আমারই আহার যোগাতো আর আমারই আশ্রয় ছিল। কিন্তু মহামান্য বাদশাহ সারা দেশের লোকের মা-বাপ পরম আশ্রয়। আমি সারাদেশকে ইয়াতিম করতে চাই না। বেগম দীর্ঘজীবী হন. আমি আমার দাবি ফিরিয়ে নিচ্ছি। আবার দরবারে যেন প্রাণ ফিরে পেল, সবাই বাদশাহর বিচার আর ধোপার বউয়ের দাবি ফিরিয়ে নেয়ার জন্য প্রশংসায় মুখর হয়ে উঠল।বাদশাহ বহু টাকা দিয়ে ধোপার বউকে বিদায় করলেন।