– রায়হান আজাদ 

দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ বাংলাদেশে গত ২১ নভেম্বর ২০১৯ সাল বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ও দৈনিক যুগান্তরের যৌথ উদ্যোগে যুগান্তর অফিসে ‘বেইজিং + ২৫: নারীর মানবাধিকার অর্জন, চ্যালেঞ্জ এবং করণীয়’ শীর্ষক একটি গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করা হয়। এ বৈঠকে ‘পিতার সম্পত্তিতে নারীর সমান অধিকার’ দাবি করা হয়। তারা কোন বিশ্বাস-নীতি ও যুক্তির তোয়াক্কা না করে পাশ্চাত্যের প্ররোচনায় এ জাতীয় পুরনো দাবি পূণর্ব্যক্তকরণের মাধ্যমে এদেশের ৯০% ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হেনেছে । বৈঠকে তারা বলেছে, “সাংবিধানিকভাবে নারী-পুরুষের সমান অধিকার দেয়া হলেও বাস্তবে তা দেখা যায় না। ধর্মীয় আইনের কারণে নারীরা উত্তরাধিকারসূত্রে পিতার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে দীর্ঘকাল ধরে সম্পদ পুরুষদের দখলে রয়ে যাচ্ছে। আইন সংশোধন করে পিতার সম্পত্তিতে সমান অধিকার নিশ্চিত করতে হবে”

(দৈনিক যুগান্তর,২২ নভেম্বর-২০১৯)।

গোলটেবিল বৈঠকে অংশ গ্রহণকারীদের বক্তব্যে ঘুরে ফিরে ঢং করে একটি কথাই বারবার উচ্চারিত হয় আর তা হচ্ছে নারীর পৈত্রিক সম্পত্তিতে সমান অধিকার প্রদানে ইসলামের উত্তরাধিকার আইন সংশোধন করা। আসলে এটি অবান্তর ও অগ্রহণযোগ্য দাবী। খোদায়ী আইন পরিবর্তনের দু:সাহসিক ধৃষ্টতা। ইসলামের পারিবারিক আইন অত্যন্ত ভারসাম্যমূলক। পৈত্রিক সম্পত্তি বন্টনের নীতিমালা সম্পর্কে আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে“ এক পুত্র সন্তানের অংশ হবে দুই কন্যা সন্তানের সমান।”-(সুরা নিসা-১১) অনেকে প্রশ্ন তুলতে পারেন, এখানে কন্যা সন্তানকে ছেলে সন্তানের চেয়ে কেন কম দেয়া হচ্ছে। মূলত ইসলামে পারিবারিক ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করা হয়েছে সততা, ভালবাসা ও পারস্পরিক দায়িত্বশীলতা দিয়ে। কোন বালেগ পুরুষই পরিবারের দায়িত্ব এড়াতে পারবেন না। নারীদের যে কয় অবস্থা রয়েছে তার প্রতিটি অবস্থায় তাদের ভরণ-পোষণসহও সার্বিক বিষয়ে দেখাশোনার জন্য পুরুষদের উপর কঠোরভাবে দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। একজন কন্যা সন্তান জন্মের পর থেকে বিয়ে দেয়া পর্যন্ত বাবা ও ভাইয়েরা লালন পালন করবেন। বিয়ের পর স্বামী তার খোরপোষ দেবেন। স্বামী মারা গেলে উপযুক্ত সন্তান অথবা ভাই তার সার্বিক দায়িত্ব নেবেন। পিতার আত্মীয়-স্বজনদের দেখাশুনা ও মেহমান রেওয়াজি করাসহ পিতৃভিটায় চিরাগ জ্বালানোর দায়িত্ব কেবল ভাই-ভাইপো তথা পুরুষের উপর বর্তায়। এ রকম কোন দায়িত্ব নারীদেরকে আল্লাহর তরফ থেকে দেয়া হয়নি। দায়িত্বানুপাতে সম্পদ বন্টনের এ সুষম নীতি কখনোই নারীদের প্রতি বৈষম্য নয়। অথচ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান ধর্মসহ বহু ধর্মে নারীদের অধিকার ও অবস্থানকে যেভাবে খাটো করে দেখা হয়েছে সেভাবে মি‘রাসী সম্পত্তিতে তাদেরকে কোন হিস্যাও দেয়া হয়নি। অথচ ইসলাম ধর্মমতে একজন নারী তার বাবার কাছ থেকে স্বাভাবিকভাবে এক তৃতীয়াংশ সম্পদ লাভ করলেও সে আবার স্ত্রী হিসেবে স্বামী থেকে,মা হিসেবে পুত্র থেকেও স্থাবর সম্পদ পেয়ে থাকেন তদুপরি মোহরানা নামক তার সতীত্বের বিনিময় সম্পদ একান্ত তারই। এতে তাকে ঠকানোও যাবে না, কেউ কোন ধরণের ভাগও বসাতে পারবে না। তাছাড়া অসিয়ত, হিবা ও ওয়াক্ফের দরজা তো সব সময় খোলা রয়েছে। নারী যদি স্বামীর হক আদায় করে ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা শালীনতার ভেতরে কোন ধরণের চাকরি-বাকরির মাধ্যমে টাকা-পয়সা আয়-উপার্জন করে তাহলে তা একান্ত তারই। এসব ছিনিয়ে নেয়ার জন্য স্বামী-সন্তান চাপ সৃষ্টি করতে পারবে না। স্বামী যদি স্ত্রীকে দরিদ্রাবস্থায় রেখে মারা যান,তাহলে পুত্র, নাতী ও ভাইপোর দায়িত্ব উক্ত মহিলার সার্বিক দেখাশোনা করা। এতেও যদি কোন সমস্যা দেখা দেয় তাহলে এ অসহায় বিধবা নারীর দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই নিতে হবে।

বস্তুতপক্ষে বর্তমানে বিদ্যমান আইনানুসারে পৈত্রিক সম্পত্তিতে নারীরা যথাযথ সম্পদ পায় না। নানান তালবাহানা করে তাদেরকে বঞ্চিত করা হয়। সেক্ষেত্রে এ আইন যথাযথ বাস্তবায়নে সোচ্চার হওয়াই ছিল যৌক্তিক দাবি, তারা কিন্তু সেটা না করে শরঈ আইন সংশোধনের নানা বাড়ির আবদার করে বসে। কেন জানি আমাদের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের বক্র দৃষ্টি সবসময় স্বজাতির ধর্ম ও ঐতিহ্যের দিকে। এরকম একদেশদর্শী ধর্ম বিদ্বেষমূলক চিন্তা থেকে তারা বেরিয়ে আসতে না পারলে আমাদের সামাজিক স্থিতিশীলতা ভেঙ্গে যেতে পারে!

সহজ ভাষায় একটি যুক্তি না দিলে নয়,নারী সম্পদে সমানাধিকার অর্জন করে কিংবা তাকে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতায়নের পর তিনি কি করবেন? তিনি কি বাবা,ভাই, স্বামী ও পুত্রের বন্ধন ছেড়ে আলাদা ঘর করে থাকবেন? তার কি সম্পদ প্রয়োজন নাকি ভালোবাসা প্রয়োজন প্রশ্ন থেকেই যায়! আসলে যারা নারীদেরকে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতায়নের পক্ষে কথা বলছেন তারা পুরুষ তথা বাবা,ভাই, স্বামী ও পুত্রের বন্ধন থেকে নারীদেরকে কি আলাদা করে দিতে চান? এভাবে যারা আলাদা থাকতে পারে,যেদেশে আলাদা থাকার নিয়ম রয়েছে কিংবা যারা স্ত্রী, মা-বোনদের আলাদা করে দিয়ে পাশবিক জীবন যাপন করে তারাই এদেশের হাজার বছরের শান্তিপূর্ণ পারিবারিক কাঠামো ধ্বংস করে দিতে এ ধরণের ষড়যন্ত্রমূলকভাবে সম্পত্তিতে সমানাধিকারের বুলি আউড়াচ্ছে।

উত্তরাধিকার সংক্রান্ত ইসলামী আইনে প্রায় দেড় হাজার বছরেও কেউ সামন্যতম ত্রুটিও দেখাতে পারেনি। তাই এ শাশ্বত আইন কখনো সংশোধনেরও প্রয়োজন পড়েনি। এদেশে বৃটিশরা ২০০বছর দেশ পরিচালনা করলেও তারা মুসলমানদের পারিবারিক আইনে কোন ধরণের পরিবর্তনের চিন্তা করেনি। ওআইসির অর্ধশতেরও অধিক রাষ্ট্রে এ আইন বলবৎ আছে। কুরআন-সুন্নাহর পারিবারিক আইন যারা মেনে চলতে চায় তাদেরকে এ আইন পরিত্যাগ করতে বাধ্য করার অধিকার কারো নেই। পার্শ্ববর্তী বৃহত্তর ধর্মনিরেপক্ষ রাষ্ট্র ভারতে মুসলিম আইনে কোন ধরণের রদবদল করা হয়নি। ভারতে যদি প্রত্যেক ধর্মীয় গোষ্ঠীর জন্য ধর্মীয় উত্তরাধিকার স্বত্ব আইন বলবৎ থাকতে পারে তাহলে আমাদের দেশে খ্রিষ্টান,হিন্দু,বৌদ্ধদের জন্য তাদের উত্তরাধিকার সংক্রান্ত স্ব স্ব ধর্মীয় আইন বহাল থাকবে আর ৯০% মুসলমান নাগরিকের আইনে কোন যুক্তিতে হস্তক্ষেপ করা হবে? মানব সভ্যতাকে রক্ষা করার জন্য জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল কিন্তু এই সভ্যতার সূতিকাগার পারিবারিক ব্যবস্থা রক্ষা করার জন্য জাতিসংঘ অদ্যাবধি কোন যৌক্তিক উদ্যোগ নিতে পারেনি। বরং যা নিয়েছে তা সম্পূর্ণ উল্টো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্যের পারিবারিক ধ্বংসলীলাকে এই প্রতিষ্ঠান সারা দুনিয়া বিশেষত মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে মিশন নিয়ে নেমেছে।

সমানাধিকারের এই প্রবক্তা যারা নারী-পুরুষের প্রকৃতিগত পার্থক্যকে মিটিয়ে দিতে চান, তাদেরকে আমি প্রথমেই বলব, তাহলে আপনারা এ বক্তব্য প্রদানের আগে মনে করে নিন যে এ যুগে পৃথিবীর আদতেই মাতৃত্বের কোন প্রয়োজন নেই। বলতে দ্বিধা নেই, আপনারা যদি সে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন তাহলে পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রের প্রয়োজন নেই। অল্পদিনের মধ্যেই মানবতার চূড়ান্ত সমাধি রচিত হবে। যদি আপনারা সে সিদ্ধান্ত নিতে না পারেন এবং নারীকে তার মাতৃত্বের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি পুরুষের মতো রাজনীতি,অর্থনীতি,শিল্প ও যুদ্ধ পরিচালনা ইত্যাদি ব্যাপারেও অংশ গ্রহণ করতে বাধ্য করেন তাহলে তার প্রতি নি:সন্দেহে চরম অবিচার করা হবে। আমরা সমাজের দিকে তাকালে দেখি মূলত এসব ভূঁইপোড় প্রগতিশীল নারী দরদীরাই কাজের মেয়েকে নির্যাতন করে,ননদ কিংবা ফুফু শ্বাশুড়ীদের ন্যায্য সম্পদ প্রদানে স্বামীকে বিরত রাখে এবং যৌতুকের দাবিতে পুত্রবধূকে মানসিক টর্চার করে। তারাই আবার মিডিয়ার সামনে বড় বড় কথা বলে। যারা নারীর সমানাধিকারের ছলছূতোয় আমাদের মহান ধর্মের বিরুদ্ধে অযৌক্তিক কথা বলবে তাদেরকে কোন প্রশ্রয় দেয়া হবে না। এসব ভৌতিক দাবি উত্থাপনকারীদের রুখে দাঁড়ানো আমাদের সকলের নৈতিক দায়িত্ব।

 

লেখক: এম.ফিল গবেষক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর।

ই-মেইল: raihanazadctg1980@gmail.com