আলমগীর মানিক, রাঙামাটি:
পর্যাপ্ত জনবল ও চিকিৎসক সংকটসহ অন্তহীন সমস্যার আবর্তনে বেহাল অবস্থায় পার্বত্য জেলা রাঙামাটির স্বাস্থ্যসেবা। ১২টি থানা ও ১০টি উপজেলা নিয়ে গঠিত পুরো জেলার প্রায় সাড়ে ৬ লক্ষ জনসংখ্যার স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতে সরকারী মঞ্জুরিকৃত পদের অনুকুলে চিকিৎসক নিয়োজিত থাকার কথা ১৭৬জন। কিন্তু বর্তমানে জেলায় কর্মরত দেখানো হয়েছে ৮৪জন চিকিৎসককে। বাকি ৯২টি পদ বিগত বছরের পর বছর খালি রাখা হচ্ছে। কাগজে কলমে কর্মরত ৮৪জনের মধ্যেও আবার ১৩জন চিকিৎসক রাঙামাটি সরকারী মেডিকেল কলেজে শিক্ষকতা এবং জেলার একমাত্র গাইনী কনসালটেন্টও চট্টগ্রামস্থ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট্য জেনারেল হাসপাতালে প্রেষণে চলে গেছেন। সবোর্পরী রাঙামাটির সাড়ে ছয়লাখ জনসংখ্যার চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত রাখা হয়েছে মাত্র ৭১জন চিকিৎসককে। জেলার অধিকাংশ চিকিৎসকের পদ শূন্য থাকার পাশাপাশি নার্স ও কর্মচারী সংকটও তীব্র থাকায় কাঙ্খিত চিকিৎসা সেবা থেকে বরাবরের মতোই বঞ্চিত থাকছে রাঙামাটিবাসী।
জেলার স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানাগেছে, রাঙামাটিতে সরকারী সিদ্ধান্তনুসারে চিকিৎসকদের ১৭৬টি মঞ্জুরিকৃত পদ থাকলেও বর্তমানে জেলায় কর্মরত দেখানো হয়েছে ৮৪জন চিকিৎসককে। বাকি ৯২টি পদ বিগত বছরের পর বছর খালি রাখা হচ্ছে। জেলার স্বাস্থ্য বিভাগে দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা পর্যায়ে ২৬৯টি মঞ্জুরীকৃত পদের বিপরীতে কর্মরত রয়েছে ১৮৪টি। তারমধ্যে ৮৫টি পদ এখনো খালি রয়েছে। তৃতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তাদের জন্য সরকারী মঞ্জুরীকৃত পদ রয়েছে সর্বমোট ৫৫১টি। তারমধ্যে কর্মরত রয়েছে ৩৮৯জন। এখনো পর্যন্ত শূন্য রয়েছে ১৬২টি পদ। চতুর্থশ্রেণীর কর্মচারি পদে মঞ্জুরিকৃত পদ ২৬৯টি হলেও কর্মরত দেখানো হয়েছে ২১৪, আর শূন্য রয়েছে ৫৫টি পদ। তার মধ্যে খালি রয়েছে ৫৫টি পদ।
সিভিল সার্জন অফিস থেকে প্রাপ্ত তথ্যে উপজেলাগুলোর মধ্যে জেলা শহরেই সিভিল সার্জন অফিসের জন্য মঞ্জুরিকৃত ৫ জন চিকিৎসকের বিপরীতে বর্তমানে তিনজন কর্মরত আছে। আরো দুইটি পদ শূন্যই রয়েছে। শহরের একমাত্র চিকিৎসাস্থল জেনারেল হাসপাতালে ৩১টি পদের মধ্যে ১৩টি পদই খালি রয়েছে। কাগজে কলমে জেনারেল হাসপাতালে দায়িত্বপালন করছেন ১৮জন চিকিৎসক। সদরের একমাত্র বিদ্যালয় স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ০২ জন চিকিৎসকের পদ থাকলেও কর্মরত আছেন ০১জন। বাকি ০১ চিকিৎসকের পদ শূন্য রয়েছে। শহরের বক্ষব্যাধি স্বাস্থ্য কেন্দ্রটিতে ০২টি পদে মধ্যে কোনো চিকিৎসককেই নিয়োগ প্রদান করা হয়নি। জেলা কারাগারে একজন চিকিৎসকের পদ থাকলেও সেখানে কোনো চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়নি। এদিকে দীর্ঘদিন ধরেই জেনারেল হাসপাতাল থেকে একজন চিকিৎসককে পুলিশ হাসপাতালে প্রেষণে কর্মরত রাখা হয়েছে।
এদিকে, ১৯৮৩ সালে ৫০ শয্যা দিয়ে চালু হওয়া রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালটি পরবর্তীতে ১০০ শয্যায় রূপান্তরিত হলেও ক্রমবর্ধমান প্রয়োজনীয়র স্বাস্থ্য সেবা দিতে গিয়ে নিজেই রোগীতে পরিণত হয়েছে হাসপাতালটি। রাঙামাটি সদর হাসপাতালে গুরুত্বপূর্ণ পদ মেডিসিন কনসালটেন্ট, সার্জারি কনসালটেন্ট, অর্থ সার্জারি কনসালটেন্ট, চক্ষু, অ্যানেসথেসিয়া ও প্যাথলজিক্যাল এবং রেডিও কনসালটেন্টসহ “কনসালটেন্ট” পদগুলোতে দীর্ঘদিন কোনো ডাক্তার নেই বললেই চলে। তবে প্রকট সংকটের মধ্যেও রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালে বর্তমান সময়ে নারী ও শিশুদের চিকিৎসা সেবা মোটামুটি নিশ্চিত করা হয়েছে এবং প্রতিমাসে গড়ে ১৩৭টি ডেলিভারি করানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন রাঙামাটির সিভিল সার্জন ডাঃ সহিদ তালুকদার।
এদিকে ডেপুটি সিভিল সার্জন ডাঃ নীহার রঞ্জন নন্দী জানিয়েছেন, আমাদের স্বল্প লোকবল নিয়েও আমরা যথাসাধ্য স্বাস্থ্য সেবা প্রদান করছি। তিনি বলেন, আমাদের স্থান সংকুলান না হওয়া অন্যতম একটি প্রধান কারন। অপারেশন থিয়েটার, কেবিনসহ ডাক্তারদের বসার স্থান অত্যন্ত স্বল্প হওয়ায় একটু কষ্ট হচ্ছে। তিনি জানান, ইতিমধ্যেই সরকার আমাদের জেনারেল হাসপাতালটিকে আরো উন্নতকরণসহ ২০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। সেটি হয়ে গেলে সেবার মান বহুগুন বেড়ে যাবে।
এদিকে সম্প্রতি জেলার আইনশৃঙ্খলা বিষয়টি সভায় সদস্যদের প্রশ্নের জবাবে সিভিল সার্জন জানিয়েছেন, খুব শীঘ্রই রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালটিতে ডিজিটাল এক্সরে মেশিনটি চালু করা হবে। এতে করে প্রয়োজনীয় অধিকাংশ পরীক্ষা-নীরিক্ষা অত্যন্ত স্বল্প খরছেই করতে পারবেন রোগী ও তাদের স্বজনরা।
বিগত কয়েক দশক ধরে রাঙামাটির স্বাস্থ্যখাতে আধুনিক প্রযুক্তি সম্বলিত যন্ত্রপাতি ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের নামমাত্র ছৌয়া লাগলেও দক্ষ জনবলের অভাব, স্থান সংকুলান না হওয়াসহ নানা মহলের খামখেয়ালীপনায় রাঙামাটিবাসী কাঙ্খিত স্বাস্থ্য সেবা থেকে এখনো পর্যন্ত বঞ্চিতই রয়ে গেছে। ২০১৪ সালে রাঙামাটিতে মেডিকেল কলেজের যাত্রা শুরু হলেও এখনো পর্যন্ত অত্র প্রতিষ্ঠানটি থেকে রাঙামাটির বাসিন্দারা তাদের কাঙ্খিত সেবা পাচ্ছেনা। নানা সমীকরণের আবদ্ধে থাকা পার্বত্য রাঙামাটির সংশ্লিষ্ট্য কর্তৃপক্ষ ও নীতি নির্ধারকদের অব্যবস্থাপনার কারনে রাঙামাটি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা জেনারেল হাসপাতালে বৈকেলিক পাঠদান (ইন্টার্নি ক্লাস) প্রক্রিয়া থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে।