এক কেজি `ঘাম’ ৪ টাকা!

প্রকাশ: ২৯ অক্টোবর, ২০১৯ ০৫:৪৭ , আপডেট: ২৯ অক্টোবর, ২০১৯ ০৬:৩৮

পড়া যাবে: [rt_reading_time] মিনিটে


ইমাম খাইর, সিবিএন:
বাজারে লবণের কেজি প্রায় ৪০ টাকা। অথচ তা উৎপাদনের পর মাঠে বিক্রি হচ্ছে কমবেশি মাত্র ৪ টাকা। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যারা খাবার লবণ উৎপাদন করছে তাদের দাম নেই। বছরের পর বছর উপেক্ষিত। অথচ যারা লবণের ব্যবসা করছে; যারা শিল্প কারখানার মালিক, সব লাভ যাচ্ছে তাদের পকেটে। কেন এত ফারাক? এ কেমন তারতম্য? প্রশ্ন সবার।
খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, ৮০ কেজির লবণের বস্তা মাঠ পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে ৩০০-৩৫০ টাকা দরে। সে হিসেবে কেজিতে পড়ছে মাত্র ৪ টাকা। যা দিয়ে মজুরি বা উৎপাদন খরচও সামাল দিতে পারছেনা চাষিরা। অথচ বাজারে প্যাকেটজাত লবণ কেজিতে বিক্রি করা হয় প্রায় ৪০ টাকা। উৎপাদনের পর থেকে বাজারে পৌঁছা পর্যন্ত অন্তত ৩টি হাত বদল হয় লবণের। প্রত্যেক হাতে লাভ পড়ে। কেবল লোকসান সয়েই যেতে হচ্ছে ‘চিরবঞ্চিত’ চাষাদের।
লবণ মিল মালিকদের একটি সুত্র জানায়, অপরিশোধিত লবণ পরিশোধিত তথা খাবার উপযুক্ত ও বাজারজাত করতে কেজিতে সর্বোচ্চ ১ থেকে দেড় টাকা খরচ পড়বে। সে হিসেবে এক কেজি লবণের দাম হওয়ার কথা সাড়ে ৫ টাকার নীচে। কিন্তু বাজারে ভোক্তারা কিনছে প্রায় ৪০ টাকা। লবণ চাষিদের অবহেলা, রাঘববোয়াল ও শিল্প কারখানার মালিকদের প্রতি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ‘দরদি মনোভাব’-এর কারণে এমনটি হচ্ছে বলে ধারণা সাধারণ মানুষের।
মাত্র ১ সপ্তাহ পরেই লবণের মৌসুম। কিন্তু এখনো মাঠে নামার লক্ষণ নেই চাষিদের। রেকর্ড পরিমাণ উৎপাদনের পরও ধারাবাহিক গত কয়েক বছর ধরে লবণের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেনা প্রান্তিক চাষিরা। কক্সবাজারের মিল ও মাঠে লক্ষ লক্ষ মে.টন উৎপাদিত লবণ মজুদ থাকলেও চোরাই পথে আমদানি বন্ধ হয়নি। গেল মৌসুমেও অন্তত ৬ লাখ মে.টন লবণ উদ্বৃত্ত। তবু বিভিন্ন অজুহাতে ঢুকেছে ভারতীয় লবণ। সর্বশেষ জুলাই মাসের শেষের দিকে শুধু তৈয়বুর রহমান নামের এক ব্যক্তির আমদানি করা ১১ ট্রাক ভারতীয় লবণ জব্ধ করে প্রশাসন। এসব কারণে দেশীয় লবণ মাঠে মার খাচ্ছে। উৎপাদিত লবণে মজুরি খরচও উঠবেনা কিনা? সন্দেহে মাঠে নামতে চাচ্ছেনা চাষিরা।
অন্যদিকে, সরকারের পক্ষ থেকে লবণ ঋণের ঘোষণা দেয়া হলেও কার্যতঃ তা বাস্তবায়নের কোন লক্ষণ নেই। নানা জটিলতা দেখিয়ে ব্যাংকগুলো ঋণদানে অনাগ্রহী।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) কক্সবাজারের লবণ শিল্প উন্নয়ন প্রকল্প কার্যালয় সূত্র জানায়, ২০১৯-২০ মৌসুমে বিসিকের চাহিদা ১৮ লাখ ৪৯ হাজার মে.টন। লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৮ লাখ ৫০ হাজার মে.টন। ২০১৮-১৯ মৌসুমে কক্সবাজার জেলায় উৎপাদনযোগ্য লবণ জমির পরিমাণ ছিল ৬০ হাজার ৫৯৬ একর। চাষির সংখ্যা ২৯ হাজার ২৮৭ জন। এই মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৮ লাখ মে. টন। বিপরীতে উৎপাদন হয়েছে ১৮ লাখ ২৪ হাজার মে.টন। যা বিগত ৫৮ বছরের লবণ উৎপাদনের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। তবু, সামনের মৌসুতে অর্ধেক চাষিও মাঠে নামবে কিনা সন্দিহান।
লবণ মিল মালিক সমিতির সভাপতি শামসুল আলম আজাদ কক্সবাজার নিউজ ডটকম (সিবিএন)কে জানান, কালো বাজারি, উৎপাদিত লবণের ন্যায্য মূল্য না পাওয়া ও বিষাক্ত সোডিয়াম সালফেটের কারণে ধ্বংস হচ্ছে দেশীয় লবণ শিল্প। মাঠে ও মিলে পড়ে রয়েছে অন্তত ৬ লাখ মেট্রিকটন অবিক্রিত লবণ। কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে কালো বাজারিদের লবণ আমদানির কারণে দেশীয় লবণ খাত মাথা উচু করে দাঁড়াতে পারছেনা। পিছিয়ে যাচ্ছে দেশের এই গুরুত্বপূর্ণ খাত। দরপতন অব্যাহত থাকলে সামনের মৌসুমে লবণ চাষিরা মাঠে যাবে কিনা সন্দেহ রয়েছে।
লবনমিল মালিকদের একটি সুত্র জানিয়েছে, বিসিকের কিছু সিনিয়র পর্যায়ের অসাধু কর্তা কালোবাজারিদের আমদানির সুযোগ করে দেয়। অতীতের রেকর্ড এমনই। উদ্বৃত্ত থাকার পরও প্রতি বছর লবণ আমদানি করা হয়। রপ্তানীর কথা বলে আমদানিকৃত ‘টেক্স ফ্রি সোডিয়াম সালফেট’ ছড়িয়ে দিচ্ছে স্থানীয় বাজারে। যে কারণে বারবার দেশীয় লবণশিল্প মার খাচ্ছে।
সোডিয়াম সালফেটে পিএইচ হলো ৯। যা কলকারখানায় ব্যবহার হয়। এই লবণ খাদ্য অনুযযোগি ও স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। ভোজ্য লবণে পিএইচ থাকে ৭। এক শ্রেনীর অসাধু ব্যবসায়ী মানবদেহের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ সোডিয়াম সালফেট বাজারে বিক্রি করছে।
কক্সবাজার, চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও আনোয়ারা উপজেলা (আংশিক)সহ ৬৪ হাজার ১৪৭ একর জমিতে ৫৫ হাজারের বেশি লবণচাষি রয়েছে। কিন্তু দালাল, ফঁড়িয়াচক্রে পড়ে বারবার ন্যায্যমূল্য বঞ্চিত চাষিরা। পর্যাপ্ত মজুদ থাকার পরও সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলকে ম্যানেজ করে লবণ আমদানি হচ্ছে।
লবণ মিল মালিক, ব্যবসায়ী, চাষিসহ সংশ্লিষ্টদের দাবী, দেশীয় লবণশিল্প বাঁচাতে সমস্ত লবণ আমদানি বন্ধ করতে হবে। ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে না পারলে মাঠে ফেরানো যাবেনা চাষিদের। পরনির্ভর হবে দেশ। বাড়বে বেকারত্ব। সুডিয়াম সালফেটের আড়ালে যারা ইন্ডাস্ট্রিয়াল সল্ট, সোডিয়াম ক্লোরাইড আমদানি তাদের কঠোর হস্তে দমন করতে হবে।
বিসিক কক্সবাজারের উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) সৈয়দ আহামদ কক্সবাজার নিউজ ডটকম (সিবিএন)কে জানান, বিসিকের চাহিদার তুলনায় প্রচুর লবণ মজুদ আছে। তবু একটি অসাধু শ্রেনী সরকারকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল সল্ট’এর নামে চায়না-ইন্ডিয়া থেকে ‘সুডিয়াল সালফেট’ আমদানি করেছে। তারা স্থানীয় বাজার থেকে কোন লবণ কিনেনি। যে কারণে দাম পাচ্ছেনা লবণ চাষিরা।
তিনি জানান, ‘বন্ড সুবিধা’ নিয়ে কেউ যাতে নতুন করে লবণ আমাদনি করতে না পারে, সে বিষয়ে চলতি মাসের শেষের দিকে এনবিআরের সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে। লবণ চাষিদের আর্থিক প্রনোদনা দিতে ৪ শতাংশ সুদে ঋণ দেবে বিসিক। চাষিদের লবণ চাষে উদ্ভুদ্ধ করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। এজন্য ব্যানার, লিফলেট, হ্যান্ডবিল বিতরণসহ নানামুখি প্রচার কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে বলেও দাবী করেন বিসিকের ডিজিএম সৈয়দ আহামদ।