বিবিসি বাংলা

হঠাৎ ঠান্ডা লাগা বা সর্দিজ্বর হওয়া যে কারো জন্য খুবই সাধারণ একটি বিষয়। ঠান্ডা বা সর্দিজ্বর মানুষকে খুবই সামান্য কারণে যেমন ভোগাতে পারে, তেমনি সহজেই সেরেও যেতে পারে।

সাধারণত ঠান্ডা লাগা বা সর্দিজ্বরের বেশকিছু সাধারণ উপসর্গ থাকে যেগুলো শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে একইরকম হয়ে থাকে।

  • নাক বন্ধ হওয়া, সর্দি থাকা
  • গলা ব্যাথা
  • মাথা ব্যাথা
  • মাংসপেশীতে ব্যাথা
  • কাশি
  • হাঁচি
  • জ্বর
  • কানে ও মুখে চাপ অনুভব করা
  • স্বাদ ও ঘ্রাণের অনুভূতি কমে আসা

কেন সর্দি হয়?

সর্দিজ্বর পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি হওয়া রোগগুলোর একটি।

ওষুধ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান অ্যাকমে’র সিনিয়র ম্যানেজার ও চিকিৎসক আফরোজা আখতার বলেন, “একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির বছরে ৪ থেকে ৬ বার এবং একটি শিশুর বছরে ১০ থেকে ১২ বার সর্দিজ্বর হওয়া স্বাভাবিক বিষয়।”

অর্থাৎ, আপনার জীবদ্দশায় ২০০ বারের বেশি সর্দি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে আপনার।

woman sneezing

এই সর্দিজ্বর বা ঠান্ডা লাগার কারণ ভাইরাস সংক্রমণ।

একসময় ধারণা করা হতো একটি বিশেষ গোত্রের ভাইরাসের মাধ্যমেই শুধু সর্দি হয়। তবে ৮০’র দশকে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয় যে মোট সাতটি গোত্রের ভাইরাসের কারণে সর্দিজ্বর হয়ে থাকে।

ঠান্ডার মৌসুমে বা শীতের সময় এই ভাইরাসগুলো দ্রুত সংক্রমিত হওয়ার মত পরিবেশ পায় বলে শীতের সময় সর্দি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পায় এবং শীতের সময় মানুষের বেশি সর্দি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

সর্দিজ্বর সংক্রমিত থাকা অবস্থায় নাসারন্ধ্রের ভেতরে মিউকাস লাইনিং অতিক্রম করে প্রবেশ করে সংক্রমণকারী জীবাণু। এর ফলে নাাসরন্ধ্রের ভেতর অতিরিক্ত সর্দি জমা হয়, ডাক্তারি শাস্ত্র যেটিকে ‘রাইনোরেয়াা’ বলা হয়।

সর্দি যেন ছড়িয়ে না পড়ে

ঠান্ডা বা সর্দিজ্বরের উপসর্গ দেখা দেয়ার কয়েকদিন আগে থেকেই সর্দিজ্বর আক্রান্ত কোনো ব্যক্তি অন্যের মধ্যে রোগ ছড়াতে পারেন। ঠান্ডা যেন ছড়িয়ে না পরে সেজন্য কয়েকটি পদক্ষেপ মেনে চলা যায়।

  • গরম পানি ও সাবান দিয়ে হাত ধোয়া
  • ঠান্ডায় আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে তোয়ালে বা গৃহস্থালির দ্রব্যাদি (যেমন কাপ, প্লেট) শেয়ার না করা।
  • ঠান্ডা আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার পর নিজের চোখ বা নাক স্পর্শ না করা।
honey and lemon drink

যেভাবে ঠান্ডা বা সর্দি থেকে দ্রুত উপশম লাভ করা সম্ভব

খুব সামান্য কারণেই ঠান্ডা বা সর্দিজ্বরে আক্রান্ত হতে পারে যে কেউ। সাধারণত কয়েকদিনের মধ্যেই মানুষের সর্দিজ্বর ভালও হয়ে যায়। তবে কয়েকটি উপায়ে স্বাভাবিকের চেয়ে দ্রুত সময়ে সর্দিজ্বর ভাল করা সম্ভব বলে বলছেন চিকিৎসকরা।

  • ঘুম বা বিশ্রাম

ঘুম মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। কাজেই ঠান্ডা বা সর্দিজ্বরের সময় বিশ্রাম নিলে বা বেশি ঘুমালে দ্রুত আরোগ্য লাভ সম্ভব।

  • উষ্ণ পরিবেশে থাকা

সর্দিজ্বরের সময় উষ্ণ পরিবেশে থাকা বা উষ্ণ পোশাক পড়ে থাকলে ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

  • প্রচুর পরিমাণ তরল পানীয় গ্রহণ করা

প্রচুর পরিমাণ পানি বা ফলের রস পানের মাধ্যমে পানিশূন্যতা রোধ করলে ঠান্ডা থেকে দ্রুত আরোগ্য লাভ করা যেতে পারে।

  • গলার যত্ন নিন

ঠান্ডার একটি সাধারণ উপসর্গ গলা ব্যাথা। লবণ পানি দিয়ে গার্গল করা অথবা লেবু এবং মধু দিয়ে হালকা গরম পানীয় তৈরি করে পান করলে গলা ব্যাথা দ্রুত উপশম হতে পারে।

ফ্লু বা ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং সর্দিজ্বরের পার্থক্য

ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের মাধ্যমে সংক্রমিত হওয়া ফ্লু এবং সর্দিজ্বরের উপসর্গ একই হওয়ায় এই দুই রোগের মধ্যে পার্থক্য করা অনেক সময় অসম্ভব হয়ে পড়ে।

তাই যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য বিভাগের ওয়েবসাইট সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের পরোমর্শ, প্রতিবছর একবার ফ্লু’র পরীক্ষা করানো।

এছাড়া বিভিন্ন গবেষণায় সর্দিজ্বর যেন না হয় তা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন রকম নিয়ম মেনে চলার বিষয়ে বলা হয়েছে।

শিশুদের ক্ষেত্রে বছরে ১০ থেকে ১২ বার সর্দিজ্বর হওয়া স্বাভাবিকশিশুদের ক্ষেত্রে বছরে ১০ থেকে ১২ বার সর্দিজ্বর হওয়া স্বাভাবিক

সর্দিজ্বর থেকে বাঁচবেন যেভাবে

মিষ্টি আলু, বিটের মূল, কয়েকটি বিশেষ ধরণের কুমড়ায় প্রচুর পরিমাণ বেটা-ক্যারোটিন থাকে যেটিকে আমাদের দেহ ভিটামিন এ’তে রূপান্তরিত করে। ভিটামিন এ আমাদের নাক এবং ফুসফুসের মিউকোসাল লাইনিংকে শক্ত রাখে যা নাগ ও ফুসফুসকে ইনফেকশনের হাত থেকে বাঁচায়।

পাশাপাশি কমলা, আম, তরমুজসহ লাল ফল একই ধরণের কাজ করে।

এছাড়া খাবারে যথেষ্ট পরিমাণ পেঁয়াজ ও রসুন থাকলেও ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের সম্ভাবনা অনেক কমে যায়। পেঁয়াজ ও রসুনে একধরণের তেল থাকে যা ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ থেকে দেহকে রক্ষা করে।

এছাড়া ঠান্ডা বা সর্দিজ্বর থেকে বাঁচার ক্ষেত্রে ভিটামিন সি’র ভূমিকা অনেক আগে থেকেই প্রমাণিত। ঠান্ডা পরিবেশে বসবাসকারী মানুষ উচ্চমাত্রায় ভিটামিন সি গ্রহণ করে সর্দিজ্বর বা ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচতে পারেন বলে প্রমাণিত হয়েছে।

সূর্যের আলো বা অন্য কোনো উৎসের মাধ্যমে পর্যাপ্ত পরিমাণ ভিটামিন ডি গ্রহণও শরীরকে ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচাতে সাহায্য করে।

শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণে ১৯৩০ এর দশকে ভিটামিন সি ছিল সবচেয়ে প্রচলিত চিকিৎসা। এটি সত্তরের দশকে এসে আরো বেশি জনপ্রিয় হয় যখন নোবেল বিজয়ী লিনাস পোলিং গবেষণা করে প্রমাণ করেন যে ভিটামিন সি ঠান্ডাজনিত রোগ উপশমে অনেকবেশি কার্যকর।

সম্প্রতি ককরেন গ্রুপের গবেষণায় দেখা গেছে যে, ঠান্ডা থেকে মুক্তিতে ভিটামিন সি’র ভূমিকা খুব বেশি নয়। এটি শরীরের জন্যে ক্ষতিকর নয় এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভিটামিন সি শরীর থেকে মুত্রের সাথে বেড়িয়ে যায়।

তবে জিঙ্ক ক্ষতিকর হয়ে দাড়াতে পারে যদি মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। সুতরাং সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলাই ভালো।

কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন?

ডাক্তার আফরোজা আখতার বলেন সর্দিজ্বর সাধারণত কয়েকদিনের মধ্যে সেরে গেলেও বেশিদিন সর্দিজ্বর থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত।

“টানা সাতদিনের বেশি সর্দিজ্বর থাকলে বা টানা তিনদিনের বেশি সর্দির সাথে উচ্চমাত্রায় জ্বর থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিৎ।”

শিশুদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়ার ক্ষেত্রে সাতদিন অপেক্ষা না করার পরামর্শ দেন মিজ আখতার। শিশুদের তিনদিনের বেশি সর্দি থাকলেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।

সর্দির সময় শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা হলে বা বুকে ব্যাথা হলেও অতিসত্বর চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন মিজ. আখতার।

এছাড়া হঠাৎ সর্দি পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে, ডায়বেটিস, হৃদরোগ, কিডনি বা ফুসফুসের রোগ থাকলেও দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত।