আজাদ মনসুর :

(পর্ব- চৌদ্দ)

বাংলাদেশের সাংবাদিকতা নিয়ে আজ বিভিন্ন মহলের মন্তব্যের সুনামি দেখে কষ্ট লাগলেও সাংবাদিকতার সাত সূত্রের ব্যতিক্রম কিছু এদেশে ঘটবে, এমন আশা মোটেও করিনা। নিন্মোক্ত সূত্রগুলো আমার একটি পর্বে উল্লেখ করলেও সংগত কারণে এই পর্বেও উল্লেখ করা উচিত বলে মনে হলো।

সেই সাংবাদিকতার সাত সূত্রগুলো কি? ১) গণমাধ্যম আসলে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক শক্তির এজেন্ট ২) যারা টাকা দেয়, তাদের স্বার্থই গণমাধ্যম রক্ষা করে; ৩) সব গণমাধ্যম ব্যবস্থা মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলে, তবে মত প্রকাশের স্বাধীনতার ব্যাখ্যা যার যার মত ৪) সব গণমাধ্যম ব্যবস্থা সামাজিক দায়িত্বের কথা বলে, তবে ব্যাখ্যা যার যার মত ৫) গণমাধ্যমের তিন ধরনের মডেলের প্রত্যেকে মনে করে তার মডেল ভালো, অন্যেরটা পঁচা ৬) সাংবাদিকতার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বিদ্যমান ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার উপায় শিখিয়ে দেয় এবং ৭) সাংবাদিকতার তাত্তিকতার সাথে বাস্তবতার ফারাক সব সময়ই থাকবে।

যেহেতু টিভি ও সংবাদপত্রের প্রতি মানুষ হতাশ। মানুষ যে হতাশ তা তাদের অভিযোগ থেকেই স্পষ্ট। প্রশ্ন হলো এ অবস্থা কেন হচ্ছে? এ বিষয়ে যতোদূর মনে হয়, তা হলো বিগত দুই দশকে এক শ্রেণীর সাংবাদিকদের জীবনমানের উন্নয়ন হলেও সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার উন্নয়ন হয়নি, বরং অবনতি হয়েছে। এ অবনতির কারণ সংবাদপত্রকে ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রভাব-প্রতিপত্তির হাতিয়ার হিসেবে গড়ে তোলা। এ সময় অধিকাংশ পত্রিকায় পেশাদার সম্পাদকের পরিবর্তে আমরা দেখেছি মালিক-সম্পাদক।

নয়তো আজ্ঞাবাহী মাফিয়া সম্পাদক। এ মালিক ও আজ্ঞাবাহী মাফিয়া সম্পাদকরা প্রথমেই ডিসি, এসপি, সরকারি বিভিন্ন অফিস আদালত ও ঢাকা শহরে সচিবালয়ে অবাধ যাতায়াতের অধিকার নিশ্চিত করেছে। এতে করে ওইসব সুবিধাবাদি সাংবাদিকরা তেল মালিশের মাধ্যমে সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছেন। এর মধ্য দিয়ে আজ্ঞাবাহী মাফিয়া ও মালিক-সম্পাদকরা সংবাদপত্র নয়, তারা তাদের অন্যান্য ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটিয়েছে। সংবাদপত্র মালিকরা যদি তাদের অন্য ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটায় তাতে আপত্তির কিছু নেই। বরং এ ক্ষেত্রে খুশী হবার কথা। কারণ ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার মানেই কর্মসংস্থান।

কিন্তু না, বিষয়টা এখানে সীমাবদ্ধ নয়। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব যেমন আছে তেমনি সাংবাদিকতায় এর প্রভাব পড়েছে তাৎক্ষণিক, যার পরিণতি হিসেবে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মালিকরা সরাসরি সংবাদপত্রের সঙ্গে জড়িত বলে সংবাদপত্রগুলোতে সাংবাদিকতার পরিবর্তে মালিকদের ব্যবসা-বাণিজ্য রক্ষা ও প্রসারের বিষয়টি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার লাভ করে। শুধু তাই নয়, নিরপেক্ষতা আর বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে সাংবাদিকতার নামে এখন মিথ্যাচার আর নির্লজ্জ দালালি চাটুকারিতার প্রতিযোগিতাসহ হলুদ সাংবাদিকতায় মাতোয়ারা।

এ প্রতিযোগিতায় জয়ের জন্য কতিপয় সাংবাদিক নামধারী টিভি মাধ্যমের বিভিন্ন পদে নিয়োজিত কুলাঙ্গার ও সংবাদপত্রে কর্মরত সম্পাদক থেকে শুরু করে সহসম্পাদক, রিপোর্টার কমবেশি সবাই যাচ্ছে তাই লিখে যাচ্ছে।

এতে পাঠক শুধু বিভ্রান্তই হচ্ছে না, নানানভাবে ক্ষতিগ্রস্তও হচ্ছে। কারণ চাটুকারিতা করার জন্য প্রায়ই তথ্য বিকৃতি ও বিভ্রান্তিকর তথ্য পরিবেশন করতে হয়। এরপর আছে প্রকৃত তথ্য গোপন। ফলে পাঠক সংবাদপত্রের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। এ জন্য শুধু মালিক, সম্পাদক বা তাদের খাস নিয়োগকৃত লোকই নয়, এ জন্য অনেক পেশাদার সাংবাদিকও দায়ী।

এভাবে সাংবাদিকতায়-আসা মেধাহীন মূর্খরা দু’লাইন লিখতে না পারলেও টিভি ও সাংবাদপত্রের বড় বড় পদ এদের দখলে। কক্সবাজারের একটা কথা মনে পড়ে গেল, অনেকে প্রকাশ্যে বলে, আমি তো লিখি না, লিখে কী হবে? ভালোই তো আছি। এতোকাল জানতাম, যে সাংবাদিক ভালো লেখেন, বেশী লেখেন এবং যার লেখার ধার যত বেশি তিনিই তত বড় সাংবাদিক, নামকরা সাংবাদিক। কিন্তু আজকের অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন।

এ অবস্থায় সাংবাদিকতায় কি ধার থাকে, না থাকতে পারে? তারপর আরো একটা বিষয় আছে তা হলো, সবকিছু সয়ে যাওয়া বা গা-সওয়া হওয়া। আগে সংবাদপত্রে কোনো দুর্নীতির খবর হলে তা নিয়ে হইচই হতো। বিশেষ করে রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের দুর্নীতি হলে তো কথাই নেই-এনিয়ে চর্চা হতো দিনের পর দিন। হাটে মাঠে ঘাটে। কিন্তু এখন আর তেমন হয় না। হওয়ার কথাও নয়।

কারণ ধারাবাহিক দুর্নীতিসহ বিভিন্ন ঘটনা ও সাম্প্রতিক সময়ের সৃষ্ট খবর দেখতে দেখতে পাঠক দেশবাসী ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে গেছেন। কারণ একজন দু’জন নয়, কমবেশি সবাই দুর্নীতি করছে আর ঘটনা একটা নয় দু’টা নয় প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে ছোট বড় ঘটনা। গ্রেপ্তারও হচ্ছে। জামিনও নিচ্ছে। শুধু তাই নয়, দুর্নীতিও নানা অপরাধের দায়ে গ্রেপ্তারের পর মুক্তি পেয়ে জেল গেটে পাচ্ছে ফুলেল মালা। কোনো লাজলজ্জা নেই। কোনো অনুশোচনা নেই।

চোরের মার বড় গলা, বলছে-সব মিথ্যা, ষড়যন্ত্রমূলক, দেখে নেবো, এক মাঘে শীত যায় না, হাবিজাবি ইত্যাদি। সে থেকে এমন মানুষ কোন সংবাদ নিয়ে মাতামাতি করে না। কারণ পাঠক জানে এসব কিছু না। ক’দিন বাদে টিভি ও পত্রিকাই নেতাদের ফুলের মালা দেয়ার ছবি প্রকাশ করবে, লিখবে সব মিথ্যা। এই অবস্থায় পাঠক টিভি ও সংবাদপত্রের ওপর আস্থা রাখবে কী করে? চলবে…

 

আজাদ মনসুর (এম.এ, এলএল.বি) শেষবর্ষ

আইটি স্পেশালিষ্ট, প্রণেতা-কক্সবাজার সাংবাদিক কোষ, সভাপতি-কক্সবাজার সাংবাদিক সংসদ (সিএসএস)

azadcox90@gmail.com 01845-69 59 16