এইচ. এম. ই রিমন

দেশের উন্নয়নের স্বার্থে মহেশখালীর স্থানীয় জনগনের সহযোগিতার কারণে মাতারবাড়ি, ধলঘাটা এলাকায় নির্মিত হয়েছে এলএনজি টার্মিনাল, কাজ এগিয়ে চলছে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্পের। সারা দেশের বিদ্যুত ও জ্বালানী ঘাটতি মেটাতে এই অঞ্চলে চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ, বিনিয়োগে আগ্রহী বিভিন্ন দেশ। অথচ সুন্দরবন সহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরিতে স্থানীয় জনগন এবং বুদ্ধিজীবীরা নানারকম বাধা দিয়েছিলেন। কিন্তু মহেশখালীতে বাধাহীনভাবে এগিয়ে চলছে একের পর এক প্রকল্প, দেশী-বিদেশী উন্নয়নের মহোৎসব।

উন্নয়ন কাজ করতে গিয়ে যেন অবহেলিত জনগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকে নজর দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু বাস্তবে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ বিপরীত। স্থানীয় বাসিন্দা এমনকি আশে পাশের কালারমারছড়া , বদরখালী, হোয়ানক এলাকার যোগ্য প্রার্থীদেরও অফিসের চাকরির সুযোগ দেয়া সম্পূর্ণ নিষেধ বলা চলে। এলাকার ঠিকানায় কোন প্রার্থী আবেদন করলে তার চাকরি পাওয়ার সুযোগ আর থাকেনা।

একসময় কক্সবাজারের মাতারবাড়ি, ধলঘাটা এলাকার জনগন ছিল সবচেয়ে সচ্ছল। উন্নয়ন আর উন্নতির বুক ভরা আশা নিয়ে অত্র এলাকার মানুষ সহযোগিতা করে আসছিল প্রকল্পের কাজে। বর্তমানে স্থানীয় জনগন কর্মহীন হয়ে পড়ছে, সম্প্রতি মাতারবাড়ি এলাকার স্থানীয় শ্রমিকরা সমাবেশ করেছিল কাজের সুযোগের জন্য। সমাবেশে স্থানীয়দের ভাষা ছিল খুবই হতাশাজনক, সাধারণ চাষীরা আয়ের প্রধান উৎস হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছে। তাদের জায়গা জমিন নিয়ে এদেশের সিংহভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে, আলোকিত হবে বাংলাদেশ, এই এলাকায় গড়ে উঠবে বড় বড় অট্টালিকা, আর সে অট্টালিকায় বসবাস করবে বিদেশীরা। কিন্তু স্থানীয়দের ভবিষ্যত কি ? এই এলাকার মানুষ গুলো বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে কাজের সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছে, অর্ধাহারে অনাহারে রয়েছে মাতারবাড়ীর হাজারো পরিবার।
মাতারবাড়ীর মানুষ চাই দু’মুঠো পেট ভরে ভাত। এলাকার বাইরে থেকে সিংহভাগ শ্রমিক এনে কাজ করানো হচ্ছে, অথচ স্থানীয়রা কর্মহীন হয়ে পড়েছে। এলাকার মানুষের মাঝে বঞ্চনার ক্ষোভ বেড়েই চলছে।

মহেশখালীর সন্তান বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী সলিমুল্লাহ খানের লেখার একটি অংশ তুলে ধরা হল-

” আপাতদৃষ্টিতে অকূলের কূল মহেশখালি নামের একটি বিন্দু। কিন্তু এই বিন্দুর মধ্যে একটি মহাসিন্ধুর কল্লোলও যাহারা কান পাতিবেন শুনিতে পাইবেন বলিয়া আমার বিশ্বাস। সারা দুনিয়ায় কি ঘটিতেছে তাহা দেখিবার জন্য আপনাকে আজ বর্ধমান কি সিঙ্গাপুর যাইতে হইবে না। হয়তো মহেশখালি দেখিলেও চলিবে। আজ সারা দুনিয়া যেখানে কয়লা পোড়াইয়া বিদ্যুৎ উৎপাদনের কৌশল হইতে সরিয়া আসিতেছে সেখানে বাংলাদেশে একের পর এক খাল কাটিয়া জগতের যত ময়লা তত কয়লা আনা হইতেছে। বাংলা মুলুকের যে সকল ম-প এই মহাযজ্ঞের পীঠস্থান হইতে চলিয়াছে নাতিক্ষুদ্র মহেশখালি ও মাতারবাড়ী প্রভৃতি দ্বীপ তাহাদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয়। শুদ্ধ একটা নহে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত গোটা পাঁচটা কয়লা-পোড়ানো বিদ্যুৎকেন্দ্রের ফাঁদ এক মহেশখালিতেই পাতা হইতেছে। ইহার একটা তাৎপর্য কাহারও পৌষমাস। আরেকটা তাৎপর্য কাহারও বা সর্বনাশ। প্রশ্ন হইতেছে, পৌষমাসটা কাহার আর কাহারই বা সর্বনাশ!

বর্তমানে মহেশখালির অন্তর্গত তিনটি দ্বীপ সোনাদিয়া, মহেশখালি ও ধলঘাট-মাতারবাড়ী ন্যূনাধিক তিন হইতে সাড়ে তিন লাখ মানুষের বাসভূমি। এতগুলি কয়লা-পোড়ানো বিদ্যুৎকেন্দ্র পাতানোর ফল এই সকল মনুষ্যসন্তানের জীবনে কী ফল বহন করিয়া আনিবে তাহা বুঝিবার জন্য পরিবেশ বিজ্ঞানী হইবার আবশ্যক করিতেছে না। এই সকল দ্বীপে যাহারা আজও বসবাস করিতেছেন তাহাদিগকে একান্তে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেই চলিবে। শুদ্ধ কি তাহাই? কথায় বলে ‘গোদের উপর বিষফোঁড়া’। আজ এই দ্বীপে বসানো হইতেছে কয়লার উপর তেলের ডিপো। একটার উপর আরটা। মহেশখালি দ্বীপের যেটুকু জায়গা পর্বতময় যেখানে বিচিত্র প্রকৃতি জীবনের বৈচিত্র্য আজও কিছুটা ধরিয়া রাখিয়াছেন সেখানেও আজ বিদেশ হইতে আমদানি করা তেল আর তরল করা

প্রাকৃতিক গ্যাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হইতে চলিয়াছে। কবুল না করিয়া উপায় নাই এই দুই সর্বনাশ নিশ্চয়ই কাঁহারও কাঁহারও ঘরে পৌষমাসের দানের ফসল তুলিতেছে। দুঃখের মধ্যে, আপনার সর্বনাশ সাধিত হইল। তবুও আপনাকে বলিতে হইবে এ সর্বনাশ সর্বনাশ নহে, এ সর্বনাশেরই অপর নাম যেন পৌষমাস। বর্তমানে এই করুণনাট্যের সর্বশেষ পালার অভিনয় করিতেছে কক্সবাজার জেলার অন্তঃপাতী মহেশখালি। একদা ইহার নাম ছিল আদিনাথ-মহেশখালি। ইহার ঘাটের নাম ছিল ‘গোরক্ষনাথের ঘাট’ অপভ্রংশে ‘গোরকঘাটা’। মহেশখালি একদা নাথধর্মের প্রান্ত স্পর্শ করিয়া থাকিবে। নহিলে ইহার নাম শিবের নামে হয় কি করিয়া! ইহাতেই প্রমাণ হাজার বছর আগেও এ দ্বীপে মানুষের বাস ছিল। আজ সেই বাস বিপন্ন।”

ফ্রিল্যান্স লেখক – এইচ. এম. ই রিমন